বর্তমানে ছোট ছোট রাষ্ট্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করে’ চলেছে৷ মানুষ ছোট ছোট রাষ্ট্র অপেক্ষা বড় বড় সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তুলে সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করতে আগ্রহী৷ সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্ট ধীরে ধীরে সরে’ যাচ্ছে৷ মানুষের মনে বিশ্বৈকতাবাদী ভাবধারার উদয় হচ্ছে৷ যে সমস্ত অন্ধ বিশ্বাস ও ভাবজড়তা এতদিন সমাজের অনেকের শ্বাসরুদ্ধ করে’ রেখেছিল আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে৷ যুক্তি–বিচার ও ‘সর্বজনহিতায়’ ভাবনাকে মানবতা এখন গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে৷ তাই প্রাউট বর্তমান পৃথিবীর সামাজিক–অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুসারে সর্বত্র স্বয়ং–সম্পূর্ণ অঞ্চল (unit) গড়ে’ তোলার নীতিতে বিশ্বাসী৷ এই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি আপন আপন এলাকায় জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণকে ত্বরান্বিত করবে, ও এক সাধারণ ভাবাদর্শের ভিত্তিতে সর্বমানবকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে৷ এই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি যতই শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে ততই ধীরে ধীরে এগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলে যাবে৷ বিশ্বরাষ্ট্র তৈরী হবার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর সকল মানুষের ও সকল নেশনের স্বার্থ রক্ষিত হবে, সবাই যথার্থ স্বীকৃতি পাবে৷ এইভাবে প্রাউট সর্বমানবের সার্বিক কল্যাণকে সুনিশ্চিত করবে৷
স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল
আমরা দেখতে পাই যখন কোনো নিপীড়িত গোষ্ঠী বা শ্রেণী কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছে, তখন তারাও আবার অন্য গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে৷
সামূহিক জীবনের মুক্তি তখনই সুনিশ্চিত হয়, যখন জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষ অবাধে সার্বিক অভিব্যক্তি ঘটাতে পারে৷ এই সর্বস্তরের মুক্তিকে প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা উচিত৷ মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারের সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে আমাদের কর্তব্য উপযুক্ত বাতাবরণ–উপযুক্ত সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে’ তোলা–যা আজকে নেই৷
বর্তমানে একই রাজনৈতিক প্রদেশের মধ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাবহুল স্থান রয়েছে৷ তাই অর্থনৈতিক কাজকর্মের সুবিধার জন্যে, দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির জন্যে, অর্থনৈতিক প্রদেশ (economic zone) অপরিহার্য৷
সামাজিক–অর্থনৈতিক আন্দোলন গড়ে’ তোলার সময় অনেক বিষয় বিবেচনা করা উচিত৷ এগুলি হ’ল ঃ–৪ * একই অর্থনৈতিক সমস্যা * একই ধরণের সম্পদ ও সম্ভাবনা * জাতিগত সাদৃশ্য * সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য * একই সাধারণ (common) সামাজিক–সাংস্কৃতিক বন্ধন যেমন ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির ভিত্তিতে গড়ে’ ওঠা সেণ্টিমেণ্টাল লিগ্যাসি (সাংবেদনিক উত্তরাধিকার)৷৫
একই অর্থনৈতিক সমস্যা
একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে একই ধরণের অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ এই সমস্যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত বাজারের অভাব, উদ্বৃত্ত বা ঘাটতি–শ্রম সমস্যা, যোগাযোগ ও পরিবহন–সমস্যা, সেচের জন্যে জল–সমস্যা ইত্যাদি৷ একটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তুলবার সময় ওই অঞ্চলে প্রথমেই উপরিউক্ত সমস্যাদি আছে কিনা সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে৷ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি ও তার সমাধানের উপায়ও ভাল করে’ বুঝে নিতে হবে৷
একই ধরণের সম্পদ ও সম্ভাবনা
কোন এক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে একই ধরণের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা উচিত৷ যদিও এটা স্বাভাবিক যে, একই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই, তবে পুরো এলাকার জনসাধারণের অর্থনৈতিক বিকাশের একই ধরণের সুযোগ আছে কিনা দেখে নিতে হবে৷
জাতিগত সাদৃশ্য
একই ভৌগোলিক পরিবেশ, একই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আবেষ্টনীর মধ্যে যাদের জন্ম ও লালন–পালন, সেই জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্নতর গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করে৷ পরবর্ত্তীকালে এই গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যগুলোই সমগ্র জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ভাবধারার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যে, এতে করে’ একটা জাতীয় ব্ধন্প্সুত্রপ্তগ্গ স্বভাব তৈরী হয়৷ তা দিয়েই একটা গোটা জাতির ব্ধন্প্সুগ্গ মানস–প্রবণতা, বাহ্যিক আচরণ, জীবন ও সমাজের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী–এককথায়, একটা বিশেষ জাতীয় ব্ধন্প্সুত্রপ্তগ্গ দৃষ্টিকোণ গড়ে’ ওঠে–যা সেই জাতিকে ব্ধন্প্সুগ্গ অন্য জাতি ব্ধন্প্সুগ্গ থেকে এক পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করে৷
একটি সামাজিক–অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে গোষ্ঠীগত মিল ড্রব্ধড়ুন্ন্তু ব্দন্প্পন্প্ত্ত্রব্জন্ব্ধ থাকা উচিত৷ অতীতে বহু জাতি ও উপজাতি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী জাতির দ্বারা অবদমিত ও শোষিত হয়েছে৷ এই প্রভাবশালী জাতি সমাজকে খণ্ড–বিখণ্ড করে’ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে জাতিবাদের প্রচার করেছে৷ এই সমস্ত ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্ট থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে৷ আর এটা সম্ভব হবে যদি প্রতিটি জনগোষ্ঠী তাদের অভিব্যক্তি ও বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ পায়৷ নানান বর্ণের পুষ্পে রচিত মানবতার মাল্যখানি সৌন্দর্যের পরম আকরে পরিণত হবে তখনই যখন নানান্ জনগোষ্ঠী ভয় ও বাধ্যবাধকতায় একত্রিত হতে বাধ্য না হয়ে আপন শক্তি ও স্বাধীনতার মর্যাদাপূর্ণ আসন থেকে প্রকৃত ভাই–বোনের ভালোবাসা নিয়ে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হবে৷ সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় এখানে আছে বরফাচ্ছন্ন মেরু প্রদেশ, আছে ঊষর ধূসর জ্বলন্ত খাঁ খাঁ মরুভূমি, আছে দিগ্দিগন্ত বিস্তৃত গর্জনমুখর অশান্ত নীলসমুদ্র, আর আছে নীরব নিথর বিপুল পাহাড়–পর্বতের দুর্ভেদ্য প্রাচীর৷ কোথাও নদী বইছে–তাদের দুই ধারে জেগে উঠেছে নদীবিধৌত বিশাল সমতল ক্ষেত্র, কোথাও ভূ–ভাগ বেষ্টিত জল–বলয় কলকল ছলছল শব্দে লীলায়িত হচ্ছে৷ এমনি ধরণের বিপরীতমুখী প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষকে পড়তে হয়েছে৷ এই বিপরীত পরিবেশে থেকে মানুষকে বিশেষ বিশেষ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে৷
সম–ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য (অর্থাৎ ভূমি–সংস্থান, নদী–ব্যবস্থা, বৃষ্টিপাত, সেচের জল–এগুলিও) সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরীর জন্যে বিশেষভাবে বিবেচ্য৷
সাংবেদনিক উত্তরাধিকার
সাংবেদনিক উত্তরাধিকারের মধ্যে এসে যাচ্ছে ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সাধারণ প্রথা, সংস্কৃতি প্রভৃতি৷ এ হ’ল এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর সামূহিক মনস্তত্ত্বের সাধারণ সূত্র যা ওই জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে অভিন্নতা ও আত্মীয়তা–বোধ সৃষ্টি করেছে৷৪
মানুষের সমস্ত ধরণের অভিপ্রকাশই সংস্কৃতি৷ মাতৃভাষার ব্যবহারই অভিপ্রকাশের স্বাভাবিক ও সহজতম উপায়৷ মাতৃভাষার মাধ্যমে জনগণের যে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি, তা যদি ব্যাহত হয় তাহলে তাদের মনে হীনম্মন্যতা বাসা বাঁধে৷ এর ফলে তাদের মধ্যে গেড়ে বসে পরাজিতের মনোভাব, ও শেষপর্যন্ত তাদের ওপর চলে মানস–র্থনৈতিক শোষণ৷ জনগণের সাংবেদনিক উত্তরাধিকারের উপযোগিতা নিতে হলে তাদের চেতনা বাড়িয়ে তুলতে হবে, জানতে হবে শোষক কারা, বুঝতে হবে মানস–র্থনৈতিক শোষণের কৌশল, আর উদ্বুদ্ধ হতে হবে সংগ্রামী চেতনায়৷ ভাষাটা নিজে কোন বিচার্য বিষয় নয়, বিচার্য বিষয় হচ্ছে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভাষা–সাম্রাজ্যবাদের ফলশ্রুতি৷
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে দেশকে কতকগুলি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করতে হবে৷ যদি রাজনীতি ও ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে রাজ্যের সীমানা নির্দ্ধারণ করা হয় তাহলে যথাযথ সামাজিক–অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনই রচনা করা যাবে না, ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার প্রতি যথাযথভাবে মনোযোগ দান করা সম্ভব হবে না৷ সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল অপরিহার্য৷
প্রশাসনিক প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলিকে এখনই একই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করলে জটিলতা দেখা দিতে পারে৷ তাই একটি অথনৈতিক অঞ্চলকে প্রয়োজনে দুটি রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করা যেতে পারে, আবার একই রাজনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকতে পারে৷
রয়্যালসীমা, শ্রীকাকুলাম ও তেলেঙ্গানা–একই রাজনৈতিক প্রদেশ অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রত্যেকের অর্থনৈতিক সমস্যা ভিন্ন৷ এগুলির ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে’ ওই অঞ্চলগুলিকে নিয়ে জনসাধারণের স্বার্থে পৃথক পৃথক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তোলা উচিত৷
বিহার রাজ্যে ৫টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ উঠতে পারে৷ যথা–অঙ্গিকা, মগহী, মৈথিলী, ভোজপুরী ও নাগপুরী৷
উপরি–উক্ত নীতিতে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষকে প্রায় ৪৫টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়৷ এই অঞ্চলগুলিকে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধমে পুরোপুরি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করার পূর্ণ স্বাধীনতার গ্যারাণ্টী থাকা উচিত৷
সমগ্র সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে ও সুষ্ঠু ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনা রচনা করতে হবে৷
প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের উচিত অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্যে আপন আপন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা রচনা করে’ তার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া৷ স্থানীয় অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বিরাট বিরাট পরিকল্পনা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না৷ ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর সমস্ত দেশের কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে৷ প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নীতি অনুসারে ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে একটি সুসংগ্রথিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (Co-ordinated plan) রচনা করার প্রয়োজন৷
দুর্নীতির করালগ্রাসে রাষ্ট্র
Editorial
দুর্নীতির করালগ্রাসে দেশ৷ যদিও কেন্দ্রের শাসকদল বেছে বেছে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধেই প্রশাসনকে সক্রিয় হতে নির্দেশ দিচ্ছে৷ এর অর্থ এই নয় যে শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা সব ধোয়া তুলসী পাতা৷ আসলে ভারত স্বাধীন হয়েছে মধ্যরাতের অন্ধকারে দুর্নীতির আঁতুড় ঘরে৷
দুর্নীতি, শ্লীলতাহানী,খুন, ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধের ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে৷ এক একটি ঘটনা ঘটে–রাজনৈতিক দল থেকে বুদ্ধিজীবী মহল গণমাধ্যম সমাজের সর্বস্তরে সরগোল শুরু হয়, কঠোর সাজার দাবী ওঠে, রাজপথে মোমবাতি জ্বলে তারপর সব স্তিমিত হয়ে যায়৷ আর একটা ঘটনার জন্যে অপেক্ষায় থাকে প্রতিবাদের রংমশাল জ্বালাতে৷ কিন্তু তাতে অন্ধকার দুর হয় না৷ ক্ষণিকের প্রভা অন্ধকার আরও গাঢ় করে দেয়৷
কিন্তু সমাজে এই অপরাধ বন্ধের জন্যে কী করা হচ্ছে? বড়জোর সমালোচকরা প্রশাসনকে গালমন্দ করছেন, প্রশাসনকে আরও শক্ত হতে উপদেশ দিচ্ছেন৷ আর একটু এগিয়ে কিছু বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবী আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও কড়া আইন প্রবর্তনের সুপারিশ করছেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যপক সমালোচনার চাপে পড়ে সরকার নোতুন আইন প্রবর্তন করছেন যেমন দিল্লীর ধর্ষণের ঘটনায় বিচলিত হয়ে সরকার ধর্ষণ বিরোধী নোতুন বিল এনে লোকসভায় ও রাজ্যসভায় পাশ করালেন৷ কিন্তু তাতেও তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না শুধু এই অপরাধই নয়, অজস্র এ ধরনের এমনি অপরাধ প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে৷ দুর্নীতিতে তো গোটা দেশটা ছেয়েই গেছে৷ আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই এসব ঘটছে আর যাদের হাতে আইনকে কার্যকরী করার ভার তারাই আইন ভঙ্গ করে বেআইনী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে৷
আসলে এটা যে একটা ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধি– এটা কি কেউ বুঝতে চেষ্টা করছেন না এই ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধি মহামারীর মত গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাই এই মারাত্মক ব্যাধির পেছনে কোন্ ভাইরাস কাজ করছে, এই ভাইরাস ধ্বংস করার কী উপায় –সেটাই আজ ভাবতে হবে৷ সমাজে চার ধরনের দর্শন রয়েছে৷ এক একটা দর্শনের প্রভাবে মানুষের এক এক ধরনের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী হচ্ছে৷ এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে আত্মস্বার্থ কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী তথা মনোভাব৷ এর পেছনে রয়েছে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক দর্শন, যেমন ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ৷ এই দর্শন মানুষকে শেখায় কেবল নিজের লাভ, নিজের সংকীর্ণ সুখটার দিকে তাকাতে৷ অন্যের তাতে সুখ বা দুঃখ– তাতে তাদের মাথাব্যথা নেই৷ সমাজজীবনে এ এক ভয়ঙ্কর ভাইরাস, যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷
দ্বিতীয় প্রকার দর্শন হ’ল জড়কেন্দ্রিক দর্শন যেমন মার্কসবাদ৷ এই দর্শন বলে জড়বস্তু ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই নেই৷ তাই এই দর্শনের প্রভাবে মানুষ ভাবছে, তার মনের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জড় ভোগ্যবস্তুকে দিয়েই মেটাতে হবে, তাই যত বেশি সম্ভব ভোগ্যবস্তুকে কেমন করে সে করায়ত্ত করবে, নিজে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবে, সেই চিন্তাতেই সে সদাব্যস্ত৷
তৃতীয় প্রকার দর্শন হ’ল ডগ্মা কেন্দ্রিক দর্শন৷ এই দর্শনের অনুগামীরা অন্ধভাবে কোনো কিছুকে বিশ্বাস করে তাকেই আশ্রয় করে মানুষকে সবকিছু করতে শেখায়৷ যুক্তি–বিজ্ঞানকে এরা মূল্য দেয় না, বিভিন্ন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসপূর্ণ তথাকথিত ধর্মমতাশ্রয়ী সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে চলার শিক্ষা এরা মানুষকে দেয়৷
এই তিনটি দর্শন ঘুরে ফিরে ভোগবাদকে প্রশ্রয় দেয়, যে ভোগবাদ ইন্দ্রিয় সুখকেই জীবনের চরম বলে ভাবতে শেখায়৷ তাই আজ সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে যে ব্যাভিচার, অনাচার, দুর্নীতি–তার কারণই হলো পুঁজিবাদী শোষণ ও ভ্রান্ত ভোগবাদী৷ এর প্রভাবেই রাষ্ট্র আজ দুর্নীতির করাল গ্রাসে৷
চতুর্থ দর্শন হল ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন৷ এই ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শন শেখায়, সমস্ত নদী যেমন সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হয়, তেমনি সমস্ত মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য ঈশ্বরের সঙ্গে অর্থাৎ ভূমাচৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া৷ তখনই মানুষ পাবে জীবনের পূর্ণ আনন্দ–পরিপূর্ণ প্রশান্তি৷ এই ঈশ্বর কেন্দ্রিক দর্শন ঈশ্বরকে ভালবাসতে শেখায়৷ আর ঈশ্বর সবার মধ্যে বিরাজিত৷ তাই এই দর্শন ঈশ্বরজ্ঞানে জগতের সবাইকেই ভালবাসতে শেখায়৷ সবার প্রতি পবিত্র কর্তব্যবোধ জাগিয়ে দেয়৷ ঈশ্বর ভাবনা মনকে পবিত্র করে –সূক্ষ্ম দিকে পরিচালিত করে, তাকে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করা৷ এটাই প্রকৃত আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ এই আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মানুষকে যথার্থ নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ এই আধ্যাত্মিক শিক্ষাই মানুষের মনকে সমস্ত কলুষতা থেকে মুক্ত করতে পারে৷ কিন্তু বর্তমানে দেশের নেতা–মন্ত্রীরা তথা আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এই আধ্যাত্মিকতাকে বর্জন করে সমাজের উন্নতি করতে চান– যা কখনোই সম্ভব নয়৷ আধ্যাত্মিকতা ছাড়া মানুষের মন কখনোই কলুষমুক্ত করা যাবে না৷ তাই দুর্নীতির করালগ্রাস থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার একটাই পথ–ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনকে অনুসরণ করে চলা৷