বিশশ্বৈকতাবাদ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ব্যষ্টিগত জীবনে মানুষের মন যত উদার বা পরিব্যাপ্ত হতে থাকে ততই সে উপজাতীয় মনোভাব, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা প্রভৃতির ঊধের্ব উঠতে থাকে৷ অনেককে বলতে শুণি জাতীয়তাবাদ (nationalism) জিনিসটা বেশ ভাল---তাতে কোনো সংকীর্ণতা নেই৷ কিন্তু কথাটা কি ঠিক? উপজাতীয়তা সাম্প্রদায়িকতা বা প্রাদেশিকতার মত জাতীয়তাবাদও একটি আপেক্ষিক তত্ত্ব৷ কোথাও এর মূল্য উপজাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা বা প্রাদেশিকতার চাইতে বেশী, কোথাও বা কম৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাক পর্তুগীজ জাতীয়তাবাদের কথা৷ একজন জাতীয়তাবাদী পর্তুগীজেদ্দর মানস-বিষয় যতটা বড় অর্থাৎ যতজন লোকের কল্যাণ কামনায় সে রত সেই তুলনায় একজন সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলমানের মানসবিষয় অবশ্যই বৃহত্তর৷ কারণ সে অধিকতর সংখ্যক মানুষের কল্যাণকামী৷ যেহেতু পৃথিবীতে পর্তুগীজ অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশী এ অবস্থায় একজন জাতীয়তাবাদী পর্দুগীজের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে একজন সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলমানের মনোভাবের নিশ্চয়ই নিন্দা করতে পারি না৷ অনুরূপভাবে একজন জাতীয়তাবাদী পর্তুগীজের চাইতে একজন জাতিবাদী (casetist) রাজপুতের মনোভাবকে অধিকতর উদার. বলেই মেনে নিতে হবে৷ কারণ তার মধ্যে অধিক সংখ্যক মানুষের কল্যাণবীজ নিহিত রয়েছে৷ জাতীয়তাবাদী পর্তুগীজের চাইতে একজন প্রাদেশিকতাবাদী অন্ধের মনোভাবকেও অধিকতর ব্যাপক বলে মেনে নিতে হবে৷৷ যদি কোনো ব্যষ্টি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে নিয়ে প্রাদেশিকতাকে প্রশ্রয় দেয় তবে তার মনোভাবকে পৃথিবীর অধিকাংশ নেশনের (পৃথিবীর অধিকাংশ নেশনই জনসংখ্যায় বাঙালীদের চাইতে কম) জাতীয়্ত্রাবাদী মনোভাবের চেয়ে উন্নততর বলেই স্বীকার করতে হবে ৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে জাতিবাদ (casetism) সাম্প্রদায়িকতাবাদ, প্রাদেশিকতাবাদ বা জাতীয়তাবাদ (nationalism) সবক্তলোই একই ধরণের জিনিস. যে যেটাকে নিয়ে আসর জমিয়ে বসেছে সে সেটার পক্ষেই ঢাক পেটায়৷ আসলে এক্তলোর প্রত্যেকটাতেই ইজমের দোষ আছে, সংকীর্ণতা, হিংসা, দ্বেষ, নীচাশয়তা সব কিছুই পুরোমাত্রায় রয়েচে৷ আমার তোমার ভেদ রেখে যারা জনকল্যাণে নামে তারা তাদের কার্যের দ্বারা মানব-সমাজের ভের্দুদ্ধির ফাটলক্তলোকেই আরো বাড়িয়ে দেয়. জীবমাত্রকেই ভেদবুদ্ধির ঊধের্ব থেকে জীব হিসেবে দেখে যারা তাদের কল্যাণ করতে চায় তাদের পক্ষে বিশ্বেকতাবাদকেই (universalism) মনে-প্রাণে গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই. বিশশ্বৈকতাবাদকে বাদ বা ইজ্ম্ বিশেষণে বিশিষ্ট না করাই উচিত৷ কারণ এতে ইজমের কোনো ক্তণই নেই৷ সকিছুকেই আপন বলে গ্রহণ করলে “পর” বলতে আর কেউই থাকে না৷ তাই হিংসা, দ্বেষ, সঙ্কীর্ণতার অবকাশও থাকে না৷
****
দিন যত এগিয়ে চলেছে মানুষের কাছে ততই জাতিবাদ, প্রাদেশিকতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ বা জাতীয়তাবাদের (nationalism) জৌলুস ফিকে হয়ে আসছে. আজকের মানুষকে বুঝতে হবে যে অদূর ভবিষ্যতে তাকে বিশ্বৈকতাবাদ গ্রহণ করতেই হবে ৷সমাজ-কল্যাণকৃৎকে তাই সাম্প্রদায়িক বা জাতীয়তাবাদী (nationalist) সংস্থা গড়বার পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে নিজের সকল শক্তি ও বুদ্ধি বিশ্ব সংস্থা গড়ার প্রচেষ্টাতেই লাগাতে হবে৷ কূটনীতি আর ভাঁওতা-দেওয়া ভাষণ ছেড়ে দিয়ে সরলভাবেই রচনাত্মক কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে৷
অনেকে বলেছেনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থক্তলি বিশ্বসংস্থা বা বিশ্বরাষ্ট্র রচনার পক্ষে একমাত্র অন্তরায় তো নয়ই বরং একটা গৌণ অন্তরায়৷ আসল কারণটা হচ্ছে স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্ব খোয়বার ভয় বিভিন্ন দেশে সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে তাদের আজ যে প্রচণ্ড প্রতাপ বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে সে প্রতাপটি আর থাকবে না ৷
বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তথা জনসাধারণের সন্দেহ বিশ্বরাষ্ট্র রচনায় বাধা দিতে পারে৷ মানুষের মনের অকারণ ভয় দূর কর্রার জন্যে তাই এ কাজে ধীরে ধীরে এগোতে হবে ও সম্ভাব্য বাধাক্তলি দূর করবার জন্যে খোলা মন নিয়ে বিচার করতে হবে৷ বিশ্বরাষ্ট্রকে ধীরেধীরে শক্তিমান করে তুলতে হবে---হঠাৎ নয় যেমন ধরা যাক্ এর পরিচালনার জন্যে অনির্দিষ্টকালের জন্যে দুটি পরিষদ রাখা যেতে পারে নিম্নতম পরিষদটি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া হবে ঊধর্বতন পরিষদে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন রাষ্ট্রগত ভাবে৷ এতে সুবিধা হবে এই যে জনসংখ্যা কম থাকায় যে সকল দেশ নিম্নতন পরিষদে একটি সদস্যও পাঠাতে পারবে না, তারা ঊধর্বতন পরিষদে সদস্য পাঠিয়ে বিশ্বজন সমক্ষে নিজেনদের বক্তব্য পেশ করতে পারবে৷ নিম্নতন পরিষদে গৃহীত না হলে ঊর্ধতন পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারবেন না তবে নিম্নতন পরিষদের সিদ্ধান্তকে নাকচ করবার অধিকার তার থাকবে৷
গোড়ার দিকে এই বিশ্বরাষ্ট্র কেবল মাত্র আইন-প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবেই কাজ করে যেতে পারে৷ কোন আইনের কোন বিশেষ অঞ্চলে সাময়িকভাবে প্রয়োগ বা অপ্রয়োগ সম্বন্ধেও সিদ্ধান্তে পৌঁছবার অধিকার এই বিশ্বরাষ্ট্রেরই থাকবে৷ বিশ্বরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রক্তলির হাতে থাকবে কেবলমাত্র শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা৷ আইন প্রণয়নের ক্ষমতা হাতে না থাকায় খেয়াল খুশী মত, ভাষাগত, রেলিজনগত বা রাজনীতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম চালানো তাদের পক্ষে একটু অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াবে৷

উৎস

আজকের সমস্যা বই থেকে