‘বন্ধু হে নিয়ে চলো’--- এ আহ্বান কোন মধ্য রাতের অন্ধকারে অসার আন্দোলনের আকুতি নয়, তমসাবৃত নিশীথের কালো যবনিকা ভেদ করে আলোর ঝরণাধারার পানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঐকান্তিক এষণা, আশাহত ব্যথিত মনের আন্তরিক আকুতি৷
মানব সমাজের পরতে পরতে আজ দারিদ্র, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের সকরুণ চিত্র৷ অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ অপর দিকে নগ্ণ চলচ্চিত্র, অশ্লীল সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক অধোগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে শোষকের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র৷ নিরীহ সাধারণ মানুষ আজ সর্বগ্রাসী নররূপী দানবের করুণার পাত্র হয়ে কায়ক্লেশে জীবন যাপন করছে৷
শাসক শোষক ধনকুবেরের দাস, অসহায় মানুষ শাসকের করুনার পাত্র৷ সমাজ শব্দটার ভাবগত অর্থই মানুষ ভুলে গেছে৷ তথাকথিত উচ্চবৃত্তের মানুষ নিজেকে স্বনির্ভর ভাবতে গিয়ে আত্মসর্বস্ব দাম্ভিক, স্বার্থপর সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে৷ স্বার্থের সংঘাত সাম্প্রদায়ীক বিদ্বেষ ভেদ-ভাবমূলক সমাজ বিরোধী মানসিকতা মানব সমাজে ডেকে এনেছে ভয়াবহ বিপর্যয়৷
বৌদ্ধিক জগতেও মানুষ আজ চরম দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, তার উদ্ভাবনী শক্তি বিপথগামী৷ তার সৃষ্ট শিল্প-সাহিত্য সঙ্গীত মানুষকে বিকাশের পথে চলতে অনুপ্রেরণা দিতে ব্যর্থ৷ বরং নৈতিক অধোগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ মানুষের চিন্তার রাজ্যে বৌদ্ধিক বিপর্যয়, শোষকের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতিপরায়ণদের কালোহাতের নিয়ন্ত্রণ এক দুঃসহনীয় পরিস্থিতি তৈরী করেছে৷
মানব সমাজের এই চরম দুর্দিনে, মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকলস্তরে সার্বিক বিকাশের পথ দেখালেন মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার আধ্যাত্মিক জগতে যিনি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নামে পরিচিত৷ সৃষ্টি করলেন সাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত৷ তাঁর রচিত ও সুপরিচিত ৫০১৮টি সঙ্গীত-প্রভাত সঙ্গীত নামে পরিচিত৷ আলোড়ণ তুললেন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে৷
শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত বলেই এ সঙ্গীতে প্রভাত সঙ্গীত নয়, আবার প্রভাত কালীন সঙ্গীতও নয়৷ মানুষের একটা সাংস্কৃতিক জীবন আছে৷ যে জীবন শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত অর্থাৎ নন্দন বিজ্ঞানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত৷ মানুষ মনপ্রধান জীব, মানব জীবনের কিছু সহজাতবৃত্তি মনকে প্রভাবিত করে৷ কিছু বৃত্তি উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, কিছু বৃত্তি অধোগতির দিকে নিয়ে যায়৷ মনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাংস্কৃতিক জগতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷ কিন্তু আজ শিল্প সাহিত্য জগতের লোকেরা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না, শিল্প সাহিত্য, সঙ্গীত জগতে আজ ব্যাপক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে৷ যার পরিণতিতে মানুষের এই অধোগতি, সাংস্কৃতিক জগৎ আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন যা মানুষের মনোরাজ্যকেও গ্রাস করেছে৷ তাই মানব সমাজ আজ অসুস্থ৷ প্রভাত সঙ্গীত এই মসীকৃষ্ণ অন্ধকার সরিয়ে জগতে আলোর ঝর্ণাধারা বহিয়ে দিয়েছে৷ প্রভাত সঙ্গীত তমসাবৃত নিশীথে আলোর প্রতিভূ৷ তাই প্রভাত সঙ্গীতের প্রথম গানের মধ্যেই বয়ে নিয়ে চলেছে সেই আলোর আকুতি--- ‘বন্ধু হে নিয়ে চলো, আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে’৷
১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর পশ্চিমরাঢ়ের দেওঘর থেকে প্রভাত সঙ্গীতের যাত্রা শুরু হলো সাংস্কৃতিক জগতে নবজাগরণের বৈপ্লবিক চেতনার বার্র্ত নিয়ে জ্যোতির্লোকের পথে৷
- Log in to post comments