আমরা সাধারণতঃ সৌজন্যমূলক সাক্ষ্যাৎকারে কথোপকথনে শুরু থাকি---‘নমস্কার৷ কেমন আছেন?’ এইরূপ বলে৷ যদি ফোনালাপে কথা করতে হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোধ করি, অনুরূপভাবেই শুরুটার শুরু করতে হয়৷ আর সাক্ষাৎ পর্বেই হোক কিংবা ফোনলাপে ‘উত্তরটাও’ খুব সম্ভবতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে---‘ভাল আছি’ বা ‘ভাল’ কিংবা একটু আম্তা আম্তা করে, ‘আর আছি, ঠাকুর/ ঈশ্বর যেমন রেখেছেন’---এই গোছের কথা বলেই শেষ করতে হয়৷ আমিও তাই করে চলেছি৷ কিন্তু, হঠাৎ করেই মনে হল, ‘সদা সত্য বলিবে, কদাপি মিথ্যা বলিও না’--- এই ধরনের উপদেশ বাক্য আমরা সর্বদা ছোটদের প্রতি বর্ষন করে চলতে অভ্যস্ত হয়েছি সত্ত্বেও আমরা কিন্তু এক ধরনের প্রতারকের মতই আচরণ করে চলেছি৷ এই প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা করছি প্রথমতঃ নিজেরই সঙ্গে নিজে অর্থাৎ আত্ম প্রতারণা যাকে বলে তাই করছি৷ আর দ্বিতীয়তঃ করছি আমাদেরই স্নেহাপদদের সঙ্গে তাদের শুভানুধ্যায়ী হওয়া সত্ত্বেও৷ বস্তুতঃ, অনুরূপ ভাবনা মনটাকে, এবার খুলে দেখাবার মনস্থ করে৷ আশা রাখছি, সহৃদয় পাঠকবর্গ আমাকে এ ব্যাপারে বে-হদিশ বিবেচনা না করে খানিকটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে বিচার করবেন৷
পৃথিবী গ্রহে আমরা যে ভূখণ্ডে জন্মেছি (অন্ততঃ আমার মতই সত্তরোধ বয়েসীদের কথাই বলছি৷---এই ভূ-খণ্ডের আদিতম নাম ‘রাঢ়দেশ’ যা পরবর্তীকালে,সময়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে পা মিলিয়ে নাম ধারণ করে এসেছে গৌড়দেশ, পঞ্চগৌড়, সমতট, হরিকেল, বঙ্গ-ডবাক বা উপবঙ্গ, শ্রীভূম ইত্যাদি ইত্যাদি, মহাভারতের আগে থেকেই এসব বিস্তৃত অঞ্চলের বিদর্ভ, বিরাট, পাঞ্চলে, কাঞ্চী, মিথিলা, কর্ণসুবর্ণ ইত্যাদি হাজারো নামের ভীড় কমাতে দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ‘‘মহাভারত’’ (যার মানে বিশালাকায় ভারত তথা ভারতবর্ষ) রচনার কাজে সহায়তা প্রদান করেছিলেন৷ তারপরও যুগে যুগে ভাঙা-গড়ার খেলা চলেই এসেছে৷ তুর্কী, খিলজি, পাঠান, মোগল আমল পেরিয়ে এসে ব্রিটিশ-দাপটের যুগে এসে সমগ্র ভূ-ভাগটার একটা কমোন্ নাম হয়েছিল ‘‘ইণ্ডিয়া’’৷ সম্ভবতঃ পারসিকরা অথবা ইংরেজরা ‘সিন্ধু’ শব্দ উচ্চারণ করতে না পারতেই ‘সিন্ধুনদ’ হয়ে গিয়েছিল ‘ইন্দাস বিভার’ আর সম্ভবতঃ---‘ইন্দাস’ জন্ম দিয়েছিল আমাদের বর্তমানে সংবিধানে উল্লেখিত ‘ভারত’ নামের বিকল্প নাম ‘ইন্ডিয়া’ বলে৷ অবশ্য, ১৯৪৭সালের দেশ-বিভাজনের পর এদেশটার নাম ‘ভারতবর্ষ’ না হয়ে শুধু ‘ভারত’ নামটাও বেমানান, কেননা এই ভারত তো আসলেই গোটা ‘ভারতবর্ষ’ নয়,---ভারতের খণ্ডাংশ মাত্র৷ তাই , দেশ -ভাগাভাগির ফলে ‘ভারতবর্ষ’ নামটা থেকে ‘বর্ষ’ বাদ গিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে শুধু ‘ভারত’আর এর সঙ্গে মিত্রতার চিহ্ণ স্বরূপ সহাবস্থানের সুযোগ পেয়ে গেছে ‘ইন্ডিয়া’৷
১৯৪৭ সালের পর থেকে নেহেরুজীর আমলে ছিল ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদের’ প্রজাতান্ত্রিক দেশ ভারত’ ‘মিশ্র-অর্থনীতির’ দেশ ভারত, ‘হিন্দী-চীনী ভাই-ভাইয়ের দেশ’ ভারত৷ তারপর ইন্দিরাজীর আমলের হল বুভুক্ষু ভারত থেকে ‘গরীবী হটাও’ শ্লোগানো মুখরিত ভারত, এশিয়ার মুক্তি সূর্য-ইন্দিরাজী’র ভারত তথা ইন্ডিয়া ও জরুরী অবস্থার পীঠভূমি ভারত৷ শাস্ত্রীজীর আমলে আবার ‘জয় জবান জয় কিষাণ’ শ্লোগান-মুখরিত ভারত খেতাব পেল ‘মুক্ত বাজার উদার অর্থনীতি’-র ভারত৷ তৎ পরবর্তী ভি,পি, সিংয়ের ভারতে ‘মণ্ডল কমিশন’-এর তীব্র ধবনিতে প্রতিধবনিতে চাপা পড়ে গিয়েছিল রাজীবজীর বোফর্স---কেলেঙ্কারীর ভারতও৷ অবশ্য তৎপরবর্তী এন.ডি.এ-এর আমলে ভাজপা-র অটল-আদবানীজীর শাসিত ভারতে রাজনীতির কালো মেঘে ঢাকা আকাশে একটু -আধটু রোদের ঝিলিক মানুষের মনকে কিঞ্চিৎ রাঙানোর চেষ্টা চরিত্র চলছিল বলে অনেকেই বিশ্বাস করতেন৷
যাক, ভারত মহাসাগরে উত্থিত ‘সুনামি’র ঢেউ এসে লাগল-দিল্লীর কাছাকাছি৷ ফলে গুজরাটের নায়ক হয়ে এলেন দিল্লীশ্বর৷ অনেকেরই ধারণা, রামনামের জপের নাকি এতই মহিমা৷ রামনামের রথযাত্রায় আদবাণীজীর রথের চাকা যে ক্ষেত্রে পাঁকে গেঁথে গেল, সেইক্ষেত্রে ‘মোদী---শাহের’ রথ যেন মাটি ছেড়ে উড়ন্ত রথ হয়ে আকাশপথেই চলতে চায় এমনই সৌভাগ্যের ঠেলা৷ ফলে সর্দার প্যাটেলের ‘ঐতিহাসিক স্টাচ্যু’ নির্মাণ, ভারতে শতকোটি রাজকোষের অর্থব্যয় করে মার্কিনী প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক আপ্যায়ণ, কাল্পনিক চরিত্র,কাব্যিক নাম (যেহেতু পরম পুরুষের এক নাম হয় ‘রাম’) ইত্যাদির উপর ভর করে সেই কল্পিত ব্যষ্টির জন্মভূমিতে সেই নামে মন্দির নির্র্মণের জিগির তুলে--- পণ্ডিত ভারতবাসী, বিজ্ঞ ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী বিত্তবান তথা ধনকুবের ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, আমলা ভারতবাসী, কামলা ভারতবাসী, বেকার ভারতবাসী, ধর্মভীরু ভারতবাসী, নাস্তিক ভারতবাসী, শোষক ভারতবাসী, শোষিত ভারতবাসী, কালোটাকা মালিক ভারতবাসী, দলছুট ভারতবাসী, একনিষ্ট দেশপ্রেমিক ভারতবাসী, মাফিয়া ভারতবাসী, ভবঘুরে ভারতবাসী, রাজপ্রাসাদের মালিক ভারতবাসী, ফুটপাথ, স্নান পাইপ ও গাছতলাবাসী ভারতবাসী, সাধক ভারতবাসী, ধর্ষক ভারতবাসী,কূপ-মণ্ডুক ভারতবাসী,বিশ্বৈকতাবাদে বিশ্বাসী ভারতবাসী, উদারচরিত সজ্জন ভারতবাসী ডগমেটিক ও নিন্দনীয়চরিত ভারতবাসী, দেবদুর্লভচরিত ভারতবাসী, উন্মাদ ও অর্ধোন্মাদ ভারতবাসী, শিক্ষিত-তস্কর ভারতবাসী, আর অশিক্ষিত সিঁধেলচোর ভারতবাসী---সবাইকে চোখে ঠুলি পরিয়ে, মুখে সেলোটেপ আটকে দিয়ে নেতাদের বামহাতের তর্জনী দিয়ে ‘চুপরাও বেয়াদব’ বলে হুঁশিয়ারী দিয়ে আর ডানহাতে লাঠি বা পিস্তল দেখিয়ে একের পর এক বাজীমাৎ করাটা বোধ হয় এতটাই সহজ হতনা৷ (ক্রমশঃ)
- Log in to post comments