প্রায় ৫০০০ বছর আগে অষ্ট্রিক, মঙ্গোলিয়ন আর নিগ্রো রক্তের সংমিশ্রণ–জাত বাঙালী জনসমুদায় সৃষ্টি হয়েছিল৷ সেই সময় বাঙলার ভাষা ছিল সংস্কৃত, তাই বাংলাভাষারও পথনির্দেশক ভাষা হচ্ছে সংস্কৃত৷ প্রায় ১২০০ বছর আগে বাংলাভাষার এক রূপান্তরণ হয়েছিল৷ সেই সময় বাঙলা বলতে বোঝাত বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ, নেপালের ঝাপা জেলা, বিহারের পূর্বাংশ, সম্পূর্ণ বাঙলাদেশ আর বর্মা, মেঘালয়ের সমতল অংশ, প্রাগজ্যোতিষপুরের কিছু অংশ আর অসমের বরপেটা, কামরূপ ও নগাঁও৷ বৃহত্তর বাঙলার এই ছিল এলাকা৷ আজ বাঙালী বলতে বোঝায় দুই প্রকারের অভিব্যক্তি– ভারতীয় বাঙালী আর বাঙলাদেশী বাঙালী ৷ এই দু’য়ের মধ্যে একটা সংহতিকরণ বা মিশ্রণ অবশ্যই হওয়া উচিত৷
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভারতীয় নেতাদের মূর্খতার কারণেই বাঙলাদেশের সৃষ্টি৷ অসম ও মেঘালয়কে তারা এইভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে৷ বৃহত্তর বাঙলা আজ নানা অংশে বিভাজিত হয়ে গেছে, আর এই পরিস্থিতি চলতে দেওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে বাঙলার অধিবাসীদের মধ্যে অনৈক্য৷ তাই এই সমস্যার সমাধানের জন্যে বাঙালী জনসাধারণের মধ্যে একতা অত্যন্ত জরুরি৷ লর্ড কার্জনের সময় ভারতীয় নেতাদের বোকামির জন্যেই বাঙলা ভাগ হয়েছিল৷ ১৯১২ সালে আবার বাঙলা এক হয়েছিল কিন্তু অসম ও ওড়িষ্যার কিছু অংশ বাঙলার বাইরে থেকে গেল৷ সেই সময় বাঙলার নেতারা এর কোনো বিরোধিতা করেনি৷ বাঙলার সব অংশকেই এক বৃহত্তর বাঙলার সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে পুনর্বার এক করতে হবে৷ বাঙলার মানুষদের একতাই এই রাজনৈতিক বিভাজনকে বদলে দিতে পারে৷
বৃহত্তর বাঙলার পশ্চিম ও দক্ষিণ–পশ্চিমের মানুষেরা অধিক কালো আর উত্তর ও উত্তর–পূর্বে অধিক হলদেটে৷ এই বাঙলার মানুষদের শিরা–ধমনীতে বইছে একই রক্তধারা৷
আগেই বলা হয়েছে কী ছিল বাঙলা বা বৃহত্তর বাঙলা বা বাঙালীস্তানের সামগ্রিক অঞ্চল৷ এখন এই টুকরো টুকরো আর খণ্ডিত বাঙলা কীভাবে এক হবে? এই সমগ্র অঞ্চলে একই রকমের সামাজিক–অর্থনৈতিকব্৷ বাঙলাদেশে কোনো সুসংহত উন্নয়ন পরিকল্পনা না থাকার জন্যে মানুষেরা অভাব–ভিযোগ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে৷ উদাহরণস্বরূপ অধিকাংশ স্থানে বছরে একটিমাত্র ফসল হয়, আর বাকি সময় জমি খালি পড়ে থাকে৷ বাঙলাদেশের জনসাধারণের জীবনধারণের মান বাড়াবার জন্যে এক সুসংহত পরিকল্পনা খুব জরুরি৷ ভারতের আর্থিক মান যেমন বাড়বে, সেই সঙ্গে বাঙলাদেশেও অধিকতর দ্রুততার সঙ্গে সেরকমটি হওয়া উচিত৷ ভারত, বাঙলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরায় আর্থিক স্বয়ম্ভরতা আনতেই হবে৷
এখন প্রশ্ণ হ’ল, বাঙলাদেশ আর ত্রিপুরার মানুষদের কি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে নিয়ে আসতেই হবে? না, ব্যাপারটা সেরকম নয়৷ আসল কথাটা হ’ল ত্রিপুরা আর বাঙলাদেশের মানুষের আর্থিক উন্নতির জন্যে কাজ করা যাতে এদের দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক–অর্থনৈতিক প্রগতি সুনিশ্চিত হয়৷ বাঙলাদেশে প্রয়োজন হচ্ছে এক গঠনমূলক সামাজিক–অর্থনৈতিক আন্দোলন৷ এর মধ্যে থাকতে হবে কারিগরী শিক্ষা, কৃষির উন্নতি আর সেই ধরনের আন্দোলন যা মানুষকে ভাবজড়তা dogma), কুসংস্কার ইত্যাদি থেকে দূরে নিয়ে যাবে৷ সব ধর্মীয় মতবাদগুলিই এইসবকে প্রোৎসাহন দেয়৷ শিক্ষা কখনো ভাবজড়তা প্রচারের বাহন হতে পারে না, শিক্ষা সবরকমের ভাবজড়তা থেকে মুক্ত থাকবে৷ ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাঙলাদেশের জনসাধারণ সহ্যের সীমায় পৌঁছে গেছে আর বিক্ষোভের আগুনে ফুঁসছে৷ যেহেতু ত্রিপুরা আর বাঙলাদেশে বেশী বৈষম্য, তাই এদের উন্নতির কথা অধিক ভাবতে হবে৷ ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বরপেটা ইত্যাদি বাঙালী অধ্যুষিত জেলাগুলি ছাড়া অসমের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিছুটা সন্তোষজনক৷
বাঙলাদেশের উন্নতির জন্যে কী করা উচিত আর কী না করা উচিত? বাঙলাদেশের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে কাঁচাপাট আর চামড়া৷ পাটের বিকল্পের উপযুক্ত বিকাশ ঘটাতেই হবে, বিশেষ করে ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ ব্লক যা বড় পাট উৎপাদন কেন্দ্র, সেখানে৷ এছাড়াও মিশ্রচাষ ও পর্যায়ক্রমে (crop rotation) চাষের ব্যবস্থা করে জমির সর্বাধিক উপযোগ করতে হবে৷ বাঙলাদেশের যে প্রতিকূলতাগুলি আছে তার মধ্যে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপুষ্টি আর আর্থিক উন্নতির অভাব৷
ত্রিপুরায় দুই প্রকারের ধান হয়– আউশ আর বোরো চাষ৷ অসমের দুটি প্রধান নদী উপত্যকা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র আর বরাক উপত্যকা৷ বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ ব্লকে বাঁশের মান খুব ভাল, একে কাগজ শিল্পে ব্যবহার করা উচিত৷ মিষ্টি আলু আর সুগার বিটের চাষও এ এলাকায় হতে পারে৷ এখানে বছরে চারটি ফসল হওয়া উচিত৷ আনারস থেকে পরিধানের জন্যে কৃত্রিম তন্তু, ওষুধ, জ্যাম–জেলি প্রস্তুত করা উচিত৷ কলাগাছ ও কলাগাছের পাতা ইত্যাদিকে কাজে লাগানো উচিত আর কলাগাছ পুড়িয়ে সোডিয়াম আর সোডিয়াম নাইট্রেট সংগ্রহ করে নিয়ে সাবান শিল্পে ব্যবহূত হওয়া উচিত৷ অসম আর ত্রিপুরায় কাঁটাল খুব ভাল হয়, এর সঙ্গে মধু আর প্রাকৃতিক প্যারাফিনের মোম তৈরী হতে পারে৷
ত্রিপুরায় লালমাটি আছে৷ এই মাটিতে সিলেটের ছোট কমলা, কাজুবাদাম আর পেঁপে উৎপন্ন হতে পারে৷ ছোট ছোট শিল্পও গড়ে তোলা উচিত৷ ত্রিপুরার অমরপুর ব্লকে প্রাকৃতিক রাবারের সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম রাবারের উৎপাদনকেও উৎসাহ দেওয়া উচিত৷ একই কথা পানিসাগর ব্লকের জাম্পুই পার্বত্য অঞ্চলের জন্যেও প্রযোজ্য৷ চীনাবাদাম, অন্যান্য প্রকারের বাদাম আর সাদা তিল উৎপন্ন হতে পারে৷ এই অঞ্চলের তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারের প্রচুর সম্ভাবনা আছে, আর এর সঙ্গে সৌরশক্তিও উৎপাদিত করতে হবে৷ সৌরশক্তি হ’ল একটি অন্যতম স্থায়ী শক্তির উৎস যা নিঃশেষ হবে না৷ সৌরশক্তিকে ব্যাটারির মধ্যে ভরে সৌর–ব্যাটারি তৈরী করা উচিত৷ ত্রিপুরাকে শক্তিস্রোতের জন্যে কেন বাইরের ওপর নির্ভর করতে হবে?