সময়টা ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ আর ৭০-এর দশকের প্রথম ভাগ৷ খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের চারিদিকে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, কতিপয় পথভ্রষ্টের বিচারে মৃত্যুদণ্ডাঙ্গা প্রাপ্ত কত না প্রতিভার রক্তক্ষরণ হ’য়ে চলেছিল প্রতিনিয়ত! ‘হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই’, ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ শ্লোগানের সবে মোহভঙ্গ হ’য়েছে, বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী চতুর্দিকে এখন নতুন শ্লোগান --- ‘বুর্র্জেয়া শিক্ষা নিপাত যাক, ‘শিক্ষাঙ্গন ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ আর স্কুল-কলেজের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা অমৃত বাণী --- ‘আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যে যতো বেশি শেখে, সে ততো বেশি মূর্খ হয়’৷ নিন্দুকেরা ব’লে থাকে যে ঐ সময় থেকেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের একনায়কতন্ত্র শাসন ব্যবস্থার অবসান ও ছাত্রদের বল্গাহীন আচরণের শুভারম্ভ হয়৷ তখন ছাত্রসমাজ রাজা, আর শিক্ষকগণ তাদের প্রজা-ক্লাসে কোন শিক্ষক ছাত্রদের অন্যায় আচরণের সামান্যতম প্রতিবাদ করলেই বাইরে তার চরম শাস্তি নির্ধারিত ছিল৷
সেই দুঃসময়ের কাণ্ডারী এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে উৎসর্গীকৃত তখনও কিছু কিছু শিক্ষক তাঁদের আজন্ম সংস্কার বশে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা ব্যবস্থাকে সচল রাখতে এমনি এক স্কুল নিয়েই এই কাহিনী - প্রিয়নাথ বয়েজ হাই স্কুলে শুরু হ’তে চলেছে একাদশ শ্রেণীর পঞ্চম প্রিয়ডের ফিজিক্স ক্লাস৷ সবে লাঞ্চ ব্রেক শেষ হয়েছে কিন্তু তার রেশ তখনও চলছে৷ ক্লাস ‘ইলেভেন বি’-এর ছাত্ররা বেঞ্চ বাজিয়ে বাংলা-হিন্দী গানের মহড়া দিয়ে চলেছে পুরোদমে --- বর্গীর হানার ম’তো সে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আওয়াজ ক্লাসের গণ্ডি পেরিয়ে টিচার্স রুম থেকে হেডমাস্টারের রুম পর্যন্ত হানা দিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিহত গতিতে৷ এই শোরগোলের মধ্যে একটি ছাত্র - রমেশই কেবল ফিজিক্সের সাউন্ড চ্যাপটার অধ্যয়নে ব্যস্ত আর ক্লাসের বাইরে থেকে এসবই লক্ষ্য ক’রে চলেছেন একজন --- তিনি আর কেউ নয়, প্রিয়নাথ বয়েজহাই স্কুলের তরুণ গেস্ট টিচার ও রিসার্চ স্কলার মৃগাঙ্ক সেন - ফিজিক্সের সাক্ষাৎ ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’৷ গবেষণার কাজে শীঘ্রই তিনি বিদেশে পাড়ি দেবেন৷ এক সময়ে তিনি এই স্কুলেরই কৃতি ছাত্র ছিলেন৷ সেই সুবাদে স্কুলের ছাত্রদের বিজ্ঞানমনস্ক ক’রে তুলতে তার বিদেশ প্রবাস আরম্ভের পূর্বে এই হাতে গোনা কয়েকটি মাস সময়ের জন্য তিনি প্রধান শিক্ষকের বিশেষ অনুরোধে ফিজিক্স পড়াতে সম্মত হয়েছেন এই স্কুলে৷ যেমন রাশভারী তেমনি অতি সরল ও সহজ ভাবে ফিজিক্স বোঝাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার৷ ছেলেদের কাছে খবর ছিল মৃগাঙ্ক স্যার আজ ক্লাস নেবেন না কিন্তু তাকে ক্লাসে ঢুকতে দেখেই তারা যেন ভূত দেখলো৷ সবাই মাথা নত ক’রে উঠে দাঁড়ালো, ক্লাসে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স৷ কোথায় অরাজকতা, কোথায় শিক্ষক তথা শিক্ষাঙ্গনের অসন্মান ! সবাই কেমন ‘মোস্ট ওবিডিয়েন্ট স্টুডেন্টস! হেডমাস্টার জানালায় দাঁড়িয়ে এসবই লক্ষ্য ক’রে চলেছেন আর ভাবছেন এমন কৃতি শিক্ষকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যদি স্কুল-কলেজে ধ’রে রাখা যেত তবে হয়তো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন সম্ভব হ’তো ! তাঁর দৃঢ় নিশ্চয় ধারণা - ছাত্র-ছাত্রীদের ওয়ার্ল ক্লাস শিক্ষা দিতে বোধহয় এরকম শিক্ষকই প্রয়োজন এই নৈরাজ্যের সময়ে৷ মৃগাঙ্ক সেন ক্লাসে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের একেবারে চুপচাপ হ’তে দেখে হেডস্যার জানালা থেকে সরে এসে নিজের কাজে মন দিলেন৷
মৃগাঙ্ক স্যার সবাইকে বসার ইঙ্গিত ক’রেই বলা শুরু করলেন, ‘থামলি কেন তোরা? বেশ লাগছিল কিন্তু৷ আমাদের পুরাণে বলা আছে ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ সবকিছুই ব্রহ্মময়, আর সেই অর্থে গান তথা শব্দও ব্রহ্ম৷ কিন্তু নামে ব্রহ্ম হলেও অজ্ঞানী মানুষ যেমন স্রষ্টা ব্রহ্মা নয় তেমনি শ্রুতিকটু এবং অন্যের বিতৃষ্ণা উদ্বেগকারী শব্দও ব্রহ্ম হ’তে পারে না৷ তাই সুর তালের সমন্বয়ে শ্রুতিমধুর শব্দ-ব্রহ্মের সাধনা যোগই ‘‘ট্রান্সফরমেশন অব এনার্জি’’ বা ‘শক্তির রূপান্তর’ ধর্মীতা অনুসারে তা গঠন মূলক কোন পরা শক্তিতে রূপান্তরিত হ’য়ে আত্মার উন্নতি মার্গের সাধন হ’য়ে উঠতে পারে’’৷ ছেলেরা নিরুত্তর - কিছুটা লজ্জিত এবং কন্ট্রিতও বটে! সম্পূর্ণ ক্লাস বশীভূত, এবার মৃগাঙ্ক স্যার শুরু করলেন শব্দ ব্রহ্ম থেকে শব্দ বিজ্ঞানের খেলা - ‘সাউন্ড চ্যাপটার’৷ শব্দের উৎপত্তি সম্মন্ধীয় কিছু সাধারণ তত্ত্ব বিশ্লেষণের পর অত্যন্ত সহজ ভাষায় শুরু করলেন ‘ডপলার এফেক্ট’এর মূল তত্ব --- এতটাই সহজ যে বিজ্ঞানের ছাত্র না হ’য়েও তা বুঝতে অসুবিধা হয়না৷ মৃগাঙ্ক স্যার ব’লে চলেছেন, ‘‘পুকুরের স্থির জলে পাথর ফেললে একের পর এক গোলাকার জল তরঙ্গ সৃষ্টি হ’য়ে যেমন ধীরে ধীরে কিনারার দিকে অগ্রসর হয়, কোন বস্তুর কম্পনের ফলে উদ্ভুত শব্দও তেমনি কঠিন, তরল বা বায়বীয় (গ্যাসিও) মাধ্যমে তরঙ্গাকারে প্রসারিত হ’তে থাকে৷ শব্দের উৎপত্তি স্থল থেকে শ্রোতার কানে সেই শব্দ তরঙ্গাকারেই পৌঁছায়৷ এখন যদি শব্দের উৎস বা শ্রোতার কোন একটি কিংবা উভয়ই গতিশীল হয় তবে শব্দের কম্পাঙ্ক বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আপাত হ্রাস বৃদ্ধি ঘ’টে থাকে, যেমন একটি মোটর সাইকেল কোন স্থির শ্রোতার দিকে এগিয়ে এলে শ্রোতার কানে শব্দের তীব্রতা বাড়ে আর সেটি যখন দূরে সরে যায় তখন শব্দের তীব্রতাও কমে --- অর্থাৎ শব্দের উৎস এবং শ্রোতা কিংবা পর্যবেক্ষকের আপেক্ষিক গতির ফলস্বরূপ উৎসমূল থেকে উদ্ভুত শব্দের কম্পাঙ্কের হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য তরঙ্গ দৈঘর্ে্যর বাড়া-কমার ঘটনাকেই ‘ডপলার এফেক্ট’ বলা হয়৷ আবিষ্কারক ‘ক্রিস্টিয়ান আনড্রেয়াস ডপলার’এর নাম অনুসারেই এই নামকরণ৷ সঙ্গে সঙ্গে ব্লাকবোর্ডে ল্যাটিন আলফাবেটের সংকেত ব্যবহার ক’রে শব্দ উৎসের সামনে অগ্রসর হওয়া বা পিছিয়ে যাওয়ার গতিবেগ তিনি প্রতিষ্ঠিত ক’রে দিলেন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আপাত হ্রাস-বৃদ্ধির অনুপাত অনুসারে৷ এমনকি ‘ডপলার এফেক্ট’ সমীকরণের সাহায্যে তিনি এও প্রমাণ ক’রে দেখালেন যে বর্ণালী রেখায় আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যৃের সরণ বা ‘রেড শিফ’ অনুযায়ী এন্ড্রোমিটা গ্যালাক্সি তার সমস্ত গ্রহ তারা সহ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে৷ এরপর মৃগাঙ্ক স্যার একের পর এক উদাহরণ সহকারে বুঝিয়ে গেলেন শব্দের প্রকার ভেদ - ইনফ্রাসনিক, সুপারসনিক, আল্ট্রাসাউন্ড, শকওয়েভ, সনিক বুম আর সেই সঙ্গে অবিস্মরণীয় আল্ট্রাসনোগ্রাম বিশল্যকরণী রূপে দিনের পর দিন কিভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন ক’রে চলেছে৷
সময়টা শীতকাল, বাইরে পড়ন্ত বিকেলের আলো কম হ’তে দেখে হঠাৎ হুঁস ফেরে মৃগাঙ্কের৷ শব্দের সঙ্গে একাত্ম হ’য়ে সে পড়ানোয় এতটাই বিভোর হ’য়েছিল যে কখন ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে গেছে তা তার শ্রুতি গোচর হয়নি, আর মন্ত্রমুগ্দ ক্লাসের ছেলেরাও কিছু বলেনি তাকে৷ পরের প্রিয়ডে সাহিত্য ক্লাসের শিক্ষক দূর থেকে দেখে ফিরে গেছেন --- কাউকে কিছু না বলেই৷ লেকচার শেষ ক’রে চক-ডাস্টার রেখে মৃগাঙ্ক ক্লাস থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় রমেশ পিছন থেকে বলে উঠলো, ‘‘স্যার, আপনি যেহেতু আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন সেজন্য আপনাকে আমরা আলোর ‘‘রেড শিফ’’ হিসাবেই স্মরণ করতে থাকবো’’৷ ছেলেদের ঐকান্তিকতা আর আগ্রহ দেখে মৃগাঙ্ক সেন থেমে গিয়ে আবার ব’লতে শুরু করলেন, ‘‘রেড শিফের বিপরীতে আছে কিন্তু ‘ব্লু শিফ’ --- অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো শুধু একে অপরের থেকে কেবল দূরে সরেই যায় না অবস্থানান্তরে তারা আবার একে অন্যের নিকটবর্তীও হ’তে পারে কোন এক সময়, আর তা বোঝা যায় ওই গ্যালাক্সি স্থিত গ্রহ-তারার আলো, বর্ণালী রেখায় ধীরে ধীরে নীল বর্ণের দিকে স’রে যাওয়া দেখে৷ তাই আমাদের এই আপাত বিচ্ছেদ হয়তো চির বিচ্ছেদ নয়, থিওরিটিক্যালি আবার কোন এক সময় পৃথিবীর কোন এক জায়গায় ঠিক মিলিত হব আমরা, অনেকটা ‘রেড শিফে’র বিপরীতে ‘ব্লু শিফে’র ম’তো৷ ‘বিগ ব্যাং’ বা মহা বিষ্ফোরণ থেকে শক্তি সংগ্রহ ক’রে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার গতিতে অনন্ত প্রসারিত হ’য়ে চলেছে প্রতিনিয়ত কিন্তু এই প্রসারণও অসীম হ’তে পারে না, তাই প্রসারণের শক্তি নিশ্বেষিত হ’লে মহাকর্ষের প্রভাবে শুরু হবে অনন্ত সংকোচন তারপর বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের গ্যালাক্সি সমূহের সব গ্রহ-তারা-নক্ষত্র-ধূমকেতু-কৃষ্ণ গহ্বর একাত্ম হ’য়ে মিশে যাবে আবার অসীম ভরের একখণ্ড বস্তু পিণ্ডে আর উত্তপ্ত হ’তে থাকবে ভিতরে ভিতরে, তখন আবার শুরু হবে নতুন এক প্রতীক্ষার৷ প্রতীক্ষা - চাপ, উত্তাপ আর অণু-পরমাণুর সংঘর্ষে আরও একবার এক ‘বিগ ব্যাং’ সংঘটিত হ’য়ে নতুন এক বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বীজ উপ্ত হবার প্রতীক্ষা - জাতি-ধর্মের ভণ্ডামি মুক্ত, শ্রেণী বিদ্বেষহীন, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত মুক্ত এক বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সংরচনার’৷
ভাবাবেগ সংযত ক’রে এবার মৃগাঙ্ক স্যার ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে এলেন, পিছনে ছাত্ররা৷ সেখানে চাবি হাতে দাঁড়িয়ে স্কুলের দপ্তরী, ক্লাস বন্ধ করার অপেক্ষায়৷ স্কুলের বাইরে তখন দূরে সরে যাচ্ছে কাদের যেন মিছিল - ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে তাদের ‘বুর্র্জেয়া শিক্ষা নিপাত যাক’ শ্লোগানের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আর ক্ষীনতর হ’য়ে আসছে শ্লোগানের তীব্রতা - অনেকটা বর্ণালী রেখায় অপসৃয়মান আলোর ‘রেড শিফে’র ম’তো৷৷
- Log in to post comments