নেশার ত্রিদোষ ঃ নেশার জিনিস আমরা তাকেই বলি যার তিনটি লক্ষণ–(১) নিয়মিত সময়ে নেশার জিনিস না পেলে মন উশ্খুশ্ করে, কোন কাজে মন বসে না৷ (২) নেশার জোর যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে ৰুদ্ধিভ্রষ্ট অবস্থায় থাকে ও স্থায়ীভাবে নেশা করতে থাকলে, ৰুদ্ধিভ্রষ্টতাও স্থায়ী হয়ে যায়৷ (৩) নেশার তৃতীয় দোষ হচ্ছে যকৃত, কন্ঠ, কিডনী অবশ্যই তাতে আক্রান্ত হয়৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোষ্ঠৰদ্ধতা রোগও দেখা দেয়৷
সব নেশাই খারাপ, তবে মদ, আফিম, গাঁজা [Cannabis indica] অত্যন্ত খারাপ৷ গাঁজায় দম টানার সময় চোখ কোটরে ঢুকে যায়৷ গলার মাঝখানটা এতই উঁচু হয়ে যায় যে মনে হয় যেন সে মাউন্ট এবারেষ্টকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে৷ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সাধারণ ৰুদ্ধিটুকুও কাজ করে না৷ উদ্ভট কল্পনা তার মনকে ষোল আনা গ্রাস করে৷
৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮, কলিকাতা
মদের কুফল ঃ খুব প্রাচীন কালে মানুষ যখন মদ্যের ব্যবহার করা শুরু করেছিল (যব থেকে প্রস্তুত এক বিশেষ ধরনের গাঁজানো মদ যাতে সোমলতার নির্যাস মেশানো থাকত) তখন সেই মদ, চোলাই করা (distilled wine) মদ ছিল না–ছিল গাঁজানো মদ (fermented wine)৷ বৈদিক যুগের দ্বিতীয়াংশে আর্যেরা মদ চোলাই করতে শেখে৷ (যোদ্ধাদের) রণোন্মত্ত করে রাখবার জন্যে যুদ্ধকালে প্রথম চোলাই করা মদের ব্যবহার শুরু হয়েছিল (স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে)৷ মদ্যের দোষের কথা জেনে ঙ্মপরবর্ত্তীকালেৰ জ্ঞানীরা সমাজে মদ্যপান নিষিদ্ধ করে দেন (কেবল যুদ্ধ চলাকালে ক্ষত্রিয়েরা ব্যতিরেকে)৷ মদ জিনিসটা এমনই মারাত্মক যে কিছুদিন পান করবার পরে যে কোন মানুষই পানাসক্ত হয়ে ওঠে৷ মানুষের সবচেয়ে ৰড় সম্পদ তার ৰৌদ্ধিকতা, তার বৈদুষ্য–মদ এই ৰুদ্ধি–বৈদুষ্যকে নষ্ট করে দেয়৷ তার থেকে দূরে থাকাই মানুষের সর্বতোভাবে উচিত৷ মদ একটি অতি উত্তেজক বস্তু৷ কেউ যদি অত্যধিক পরিমাণে মদ গেলে, তাহলে তার যকৃত জখম হয়ে যায়৷
আমাদের দেশের সবচেয়ে সস্তা মদ ধেনো মদ৷ ধেনো মদ বাংলার গ্রাম জীবনকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ আদিবাসী ও অনুন্নত সমাজের মানুষেরা এই ধেনো মদের নেশাতেই অনেক সময় সর্বস্বান্ত হয়, বাড়িতে ঝগড়াঝাঁটি করে, পারিবারিক শান্তি নষ্ট করে৷ শেষ পর্যন্ত নিজেরাও পথে বসে৷ তাই মদ্যপ্রস্তুত বা মদ্যপানের ওপরে কেবল রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেই চলবে না, কঠোর সামাজিক নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন৷ এ ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সমাজকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে৷
যে ছাত্রটির মধ্যে যতটা ভবিষ্যৎ লুক্কায়িত ছিল, মদ্যপানে তার বিশ শতাংশের মত নষ্ট হয়ে যায়৷ অতি চাঞ্চল্য ও তারপরেই অল্প চাঞ্চল্যের ফলেই জড়তা আসে, কম বয়সে পৌরুষ, তেজস্বিতা কমে যায়৷ স্নায়ুকোষকে ত্ব্ব্জ্ত্রনুগ্গ পুরো কাজে লাগানো যায় না৷
ধর্মের নামেই হোক বা অন্য কোন অছিলাতেই হোক, মদ্যের ব্যবহার সীমায়িত হওয়া উচিত৷ ঔষধার্থে চিকিৎসা ব্যতিরেকে ও চিকিৎসকের অনুমতি ব্যতিরেকে কারো মদ্যপান করা উচিত নয়৷ চিকিৎসকেরও উচিত অন্য কোন ঙ্ম সিনিয়র ৰ চিকিৎসকের লিখিত অনুমতির ভিত্তিতে কাজ করা৷ পূজোর অঙ্গ হিসেবে যাঁরা মদ্য ব্যবহার করেন তাঁদেরও অনুরোধ করব, অন্য কোন স্বীকৃত বিকল্প ব্যবস্থা যদি থেকে থাকে, তাঁরা যেন তার আশ্রয় নেন৷ (যেমন কাঁসার বাটিতে ঝুনো নারকোলের জল অনেকক্ষণ রেখে, তারপরে সেই জল ব্যবহার করা)৷ মানুষ সাধনা করে ৰুদ্ধিকে–ৰোধিকে প্রখরতর করবার জন্যে, ব্যাপ্তি ঘটাবার জন্যে৷ মদ এগুলি ধ্বংস করে৷ তাই মদ মানুষের সর্ববিধ উন্নতির পরিপন্থী৷ মদের একটি অংশ শরীরের অভ্যন্তরস্থ স্নায়ুকোষ, স্নায়ুতন্তু ও গ্রন্থি–উপগ্রন্থিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজে লাগে৷ একটি অংশ ঘর্মের সঙ্গে বহির্গত হয়৷ একটি অংশ মলের সঙ্গে বহির্গত হয় ও অবশিষ্টাংশ মূত্রের সঙ্গে বহির্গত হয়৷ স্টার্চ জাতীয় যে কোন বস্তু বিশেষ পরিবেশে ও বিশেষ পরিস্থিতিতে গেঁজে গেলে তা গাঁজানো মদে পরিণত হয়৷ যেমন তালের রস, খেজুরের রস গেঁজে হয় তাড়ি৷ ‘তাড়ি’ একটি গাঁজানো মদ৷ বাসি ভাতও বিশেষ পরিস্থিতিতে গেঁজে গেলে মদ হয় ও তা চোলাই করে হয় ধেনো মদ৷
আফিং, গাঁজা, সিদ্ধির কুফল ঃ কিছু কিছু এমন বস্তু আছে যারা স্নায়ুকোষকে ঝিমিয়ে দেয় ও দীর্ঘকাল ধরে এই ঝিমুনির জের চলতে চলতে শেষে স্নায়ুকোষ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে৷ স্নায়ু আর কাজ করে না.......বিহ্বল দৃষ্টিতে তখন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে৷ চিন্তার প্রাখর্য তো থাকেই না, চিন্তার সামর্থ্যও শেষ হয়ে যায়৷ এই ধরনের ঘটনাটি ঘটে দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত পরিমাণে সিদ্ধি, গাঁজা, চণ্ডু, চরস ও আফিং খেলে৷ মর্ফিন/মর্ফিয়া ঘটিত বস্তুতে এই জঘন্য গুণ রয়েছে৷ স্নায়ুকোষ যাতে রোগগ্রস্ত না হয় সেই জন্যে গাঁজাখোর, আফিং খোরেরা বেশী মাত্রায় দুগ্ধপান করে থাকে৷ তাতেও ঠ্যালা সামলানো দায় হয়৷ শেষ পর্যন্ত মানুষ জড় হয়ে যায়৷ মদ্যপানে মানুষ জড় হয় না–অতিরিক্ত উত্তেজনা জাগে৷
ঙ্মআগেই বলা হয়েছেৰ মদ একটি অতি–উত্তেজক বস্তু৷ আফিং, গাঁজা, চণ্ডু, চরস–এরা উত্তেজনার বদলে আনে অবসন্নতা৷ এই অবসন্নতা শেষ পর্যন্ত মানুষকে জড়ত্বে পর্যবসিত করে৷ একটা ভুল ধারণা আছে যে আফিং খেলে ৰুঝি পেটের রোগ সারে৷ কথাটা ডাহা মিথ্যা৷ আফিংখোর নেশার ঘোরে ভাবে এতে ৰুঝি তার পেটের রোগ সারছে৷ আফিংয়ে রোগ সারে সেটা কেবল একটা মানসিক কল্পনা মাত্র৷ আফিং অবসাদ আনে৷ সেই অবসাদ আসা বা অবসন্নতায় যাওয়াটা নেশাগ্রস্ততা ছাড়া কিছুই নয়৷ আফিঙের নেশার চেয়ে অবসন্ন হতে চাওয়াটাই নেশা৷ এই ভাবে আফিং প্সহ্মন্ব্ভপ্পগ্গ নষ্ট করে দেয় কর্মশক্তিকে৷ মানুষ তখন বসে বসে ঝিমুতে ভালোবাসে৷ সিদ্ধি ণ্ড্রন্দ্বপ্পহ্মগ্গ নষ্ট করে দেয় ৰুদ্ধি ও ৰোধশক্তিকে৷ তাই এরা কেউই ভালো নয়৷ এককালে এই আফিংগ্রস্ত হয়ে চীন ধ্বংস হতে বসেছিল.....এককালে আফিংয়ের নেশায় অসমও ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছিল৷ তাই আফিংয়ের নেশা থেকে সাবধান৷
আফিংয়ের বিষ সাপের ফেনার মতই হানিকারক৷ সাপের বিষ থেকে এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদের ঔষধ তৈরী হয়৷ তেমনি আফিং থেকে মর্ফিন/মর্ফিয়া ইঞ্জেক্শনও তৈরী হয়৷ ঔষধ তৈরী হয় বলেই নেশার ঝোঁকে থাকার আশায় কেউ মর্ফিয়া ইঞ্জেক্শন নেবে এটা তো সমর্থন করা যায় না৷ অহিফেন শব্দের অর্থ সাপের ফেন বা ফেনা৷ অহিফেন থেকে অহিফাম শব্দ এসেছে, আর অহিফাম থেকে এসেছে ইংরেজী প্সহ্মন্ব্ভপ্প শব্দটি৷ ওপিয়াম পপির ৰীজকোরকের গা চিরে দিলে এর থেকে রস বা আঠা বের হয়, তাই হ’ল কাঁচা আফিং৷ কাঁচা আফিংকে আফিং–শোধনাগারে প্সহ্মন্ব্ভপ্প ব্জন্দ্বন্দ্রনুত্রব্জম্ এনে শোধন করা হয় (মূলতঃ) ঔষধের জন্যে৷
(দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য ঃ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)