সংরচনাগত অখণ্ডতার ব্যাপারে ৰলা যেতে পারে, সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতি হচ্ছে ডিম্বাকৃতি৷ লাতিন ‘ওবাম’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ডিম৷ তাই ‘ওবাল’ শব্দের অর্থ ডিমের মত অর্থাৎ পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ডিমের মত৷ পুরোপুরি ডিম্বাকৃতি নয়, তৰে প্রায় ডিম্বাকৃতি৷ সকল জ্যোতিষ্কই এই আকৃতির৷ সংস্কৃতে তাই বিশ্বকে ৰলা হয় ব্রহ্মাণ্ড৷ ‘অণ্ড’ মানে ডিম৷ সংস্কৃত ‘অণ্ড’ শব্দ থেকে উর্দু ‘অল্ডা’ শব্দটি এসেছে৷ এখন, আমাদের এই বিশ্বটা খুৰই বড় কিন্তু অনন্ত নয় ও এর আকৃতিটা দেখতে ডিম্বাকার, অর্থাৎ এর একটা সীমারেখা আছে৷
হ্যাঁ, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা খুৰই ৰড় ও বাস্তবিক এত ৰড় যে আমরা তার পরিমাপ করতে পারি না৷ কিন্তু তত্ত্বগত ভাবে পরিমাপ করা যায়৷ এইমাত্র আমি ৰললুম যে সবচেয়ে সুবিধাজনক সংরচনা হচ্ছে এই ডিম্বাকৃতি৷ একটা অণুর উদাহরণ নেওয়া যাক্৷ একটা আণবিক সংরচনা হচ্ছে কী---তার একটা কেন্দ্রৰিন্দু রয়েছে যা সংরচনাটির মধ্যেকার সবচেয়ে ভারী বস্তু ও যার চারিপাশে বিদ্যুতণুগুলি ঘুরে চলেছে৷ ঠিক তেমনি হ’ল আমাদের এই পার্থিব সংরচনা৷ পৃথিবী হচ্ছে তার কেন্দ্রৰিন্দু ও চন্দ্র সেই কেন্দ্রৰিন্দুর চারিদিকে ঘুরে চলেছে৷ এর চেয়ে ৰড় হচ্ছে সৌর-সংরচনা৷ সূর্য হচ্ছে কেন্দ্রৰিন্দু আর ৰহু গ্রহ তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে৷ সবচেয়ে ৰড় সংরচনা হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড---পরমপুরুষ, পুরুষোত্তম যার মধ্যমণি৷ সেই পুরুষোত্তমকে ঘিরেই সমস্ত জৈব-অজৈব সত্তাসমূহ ঘুরে চলেছে৷
বিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রই জানে দু’টো কারণে গতি বজায় থাকে---কেন্দ্রানুগা ও কেন্দ্রাতীগা৷ কেন্দ্রানুগা শক্তি ব্যাসার্ধের দূরত্ব কমিয়ে আনবার চেষ্টা করে আর কেন্দ্রতীগা শক্তি সেই দূরত্বকে কেন্দ্রৰিন্দু থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে৷ সংস্কৃতে এই কেন্দ্রানুগ শক্তিকে ৰলে ‘বিদ্যা’ আর কেন্দ্রাতীগা শক্তিকে ৰলে ‘অবিদ্যা’৷ সাধারণ ভাষায় আমরা অবিদ্যার জন্যে ইংরেজীতে ‘শয়তান’ শব্দটি ব্যবহার করি৷ এখন জেনে বা না-জেনে, জ্ঞাতসারেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক বিশ্বের প্রতিটি ভৌতিক তথা মানসক সত্তা সেই পরমপুরুষের চারিপাশে ঘুরে চলেছে৷
সীমিত বস্তু তথা সীমিত সংরচনার ক্ষেত্রে হয় কি---যখন কোন ঘূণায়মাণ সত্তা কেন্দ্রৰিন্দুর থেকে অনেকটা দূরে সরে যায় তখন তা’ অন্য একটি কেন্দ্রৰিন্দর দ্বারা আকর্ষিত হয়ে থাকে৷ এরই ফলে বিভিন্ন কেন্দ্রৰিন্দুর মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়৷ কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে একটি মাত্রই কেন্দ্রৰিন্দু রয়েছে৷ কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে একটি মাত্রই কেন্দ্রৰিন্দু রয়েছে৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে কেন্দ্রৰিন্দুর সীমার বাইরে চলে যাবার কোন প্রশ্ণই আসে না৷ যেমন যখন কোন মানুষ ৰেশী পরিমাণে অবিদ্যার বশীভূত হয়ে যায় তখন কেন্দ্রৰিন্দ থেকে তার ব্যাসার্ধের দূরত্ব ৰাড়তে থাকে, কিন্তু ব্যাসার্ধ থেকেই যায়৷ মানুষ, পশুপক্ষী, উদ্ভিদ তথা অজৈব সত্তাকেও গতিশীল থাকতেই হৰে৷ আর সে কারণেই আমি ৰলছিলুম, চলমান---তাই জীবন, থেমে থাকাটাই মৃত্যু৷
যখন মানুষ জড়তার দ্বারা পরিচালিত হয়, ঠিক পরিচালিত নয় নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তার অভ্যন্তরীণ চলমানতা নষ্ট হয়ে যায়৷ সুতরাং সে তখন প্রাণহীন হয়ে পড়ে৷ তার অবস্থা তখন মৃতের চেয়েও খারাপ হয়ে যায়৷ তাই তোমরা মার্গের ছেলে-মেয়েরা জেনে রাখো, তোমরা কখনই কোন ভাবজড়তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিশ্বের চক্রৰিন্দু থেকে দূরে সরে যেওনা ---সেই মধ্যমণি থেকে তোমাদের ব্যাসার্ধের দূরত্বকে ৰাড়তে দিও না৷ সব সময় তোমরা তোমাদের ব্যাসার্ধের দূরত্ব কমানোর চেষ্টা কর৷ যাতে তোমরা চক্রনাভির অধিক থেকে অধিকতর কাছটিতে পৌঁছে যেতে পার৷ তোমরা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পার--- ভাবজড়তা জিনিসটা কী? তোমরা সকলেই শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে৷ তোমাদের মনে রাখা উচিত জড়তা এক বিশেষ ধরণের মানসিক সংরচনা৷ অবশ্য ধারণা মাত্রেই এক একটা মানসিক সংরচনা কিন্তু এদের সীমারেখার ব্যাপারে অবশ্যই তারতম্য থেকে যায়৷ আমার মনে হয় তোমরা কেউ কেউ ‘প্রাউট’-এর কথা শুণেছ৷ আমি মনে করি তোমরা সেগুলো পড়েছও৷ সেখানে প্রাউটের পঞ্চম তত্ত্বে ৰলা হয়েছে যে দেশ কাল-পাত্রের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের উপযোগিতা গ্রহণের পদ্ধতিও পরিবর্ত্তিত হয়ে যায়৷ আমি কী তা ৰলিনি? হ্যাঁ, এমনটাই ৰলেছি, আর তারই ফলে পরিবর্ত্তনের সুযোগ সেখানে রয়ে গেছে৷ মানুষের মন কখনই ৰাঁধাধরা কোন কিছুকে নিয়ে থাকতে চায় না৷ সে গতি চায়৷ আর শুধু গতিই নয়, সে গতির মধ্যে দ্রুতিও আনতে চায়৷ কিন্তু ভাবজড়তা কী! ভাবজড়তা হচ্ছে এমন এক ধরণের ভাব যার চারিদিকে একটা গণ্ডী টেনে দেওয়া হয়েছে, ৰলা হয়েছে এর বাইরে যাওয়া চলৰে না৷ অর্থাৎ ভাবজড়তা মানুষকে কৃত্রিম গণ্ডীর বাইরে যেতে দেয় না৷ সুতরাং ভাবজড়তা একান্তভাবেই মানবমনের মৌলিক গতিপ্রগাহের পরিপন্থী৷
জেনে অথবা না জেনে প্রত্যেক সত্তাকেই পরম কেন্দ্রৰিন্দুর চারিপাশে ঘুরতে হৰেই৷ এর কোন বিকল্প নেই৷ কিন্তু ভাবজড়তার ক্ষেত্রে কী হয়! যখন কেউ কেন্দ্রৰিন্দুর কাছে আসতে থাকে তখন সে ভূমা মনের দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয়ে যায় যে সে তখন সেদিকে ছুটে যায়---কেবল তার সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হবার জন্যেই৷ বস্তুতঃ যখন তা’ হয়ে থাকে তখন অণু মন ভূমা মনের সঙ্গে মিলে এক হয়ে যায় আর ভূমা মন সব সময়েই ভাবজড়তার ঊধের্ব৷ তাই প্রথম থেকেই ভাবজড়তার প্রভাব মুক্ত হতে তোমাদের সংগ্রামমুখর হতে হৰে৷ এই ভাবজড়তার জন্যেই মানব সমাজের যথার্থ প্রগতি হয়নি৷ গত পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে মানব-মনীষার যথেষ্ট বিকাশ হয়েছে, গত দু’শো বছরের মধ্যে উন্নতি আরও দ্রুতগতিতে হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থাৎ গত কয়েক দশকে উন্নতি তার চেয়েও ৰেশী হয়েছে৷
এখন কথা হচ্ছে ৰৌদ্ধিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও সভ্যতার সঙ্কট রয়েই গেছে৷ এই সঙ্কটের উৎসস্থলটা কী? সঙ্কটই বা কী? এটা ঠিকই যে মানুষ খুব চালাক-চতুর জীব৷ তবু বিপদের সৃষ্টি হয়েছে এই ভাবজড়তা থেকেই৷ মানস-স্তরে এই ভাবজড়তাই মানুষের মনো জগতে বিপদ ডেকে এনেছে৷ ভৌতিক ক্ষেত্রে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্মুক্ত হতেও পারে, নাও পারে, কিন্তু মানসিক ক্ষেত্রে বিপদ অবশ্যই রয়ে গেছে৷ জাগতিক ক্ষেত্রে খাদ্য-পানীয়-বাসস্থানের নিশ্চিততা হয়তো তোমরা পেয়েও থাক৷ তবে তাই সৰ কিছু নয়৷ মনোজাগতিক ক্ষেত্রে---ৰৌদ্ধিক স্তরে তোমরা বিপন্মুক্ত হয়ে থাকতে চাও---চাও মানসিক উন্নতি, নিরঙ্কুশ ৰৌদ্ধিক প্রগতি৷ কিন্তু কতকগুলি ভাবজড়তা যেন ৰলতে পারি৷ মার্কসবাদ এই ধরণেরই একটি ভাবজড়তা৷ তাই মার্কসবাদ তার সীমিত গণ্ডীর বাইরে তোমাকে কিছুতেই চিন্তা করতে দেৰে না৷ সুতরাং সমস্ত ৰুদ্ধিজীবীদেরই কর্ত্তব্য হচ্ছে জনগণের বর্ত্তমান-ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সচেতন করে দেওয়া ও ভাবজড়তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা থেকে সাবধান করে দেওয়া৷
তোমাদের পথ পরমাপ্রশান্তিরই পথ৷ তাই তোমাদের অবশ্যই বিশ্বের চক্রনাভির দিকে এগিয়ে চলতে হৰে৷ এখন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত শত জীব রয়েছে---কত মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, লতাপাতা প্রভৃতি আর তাদের প্রত্যেকেরই কয়েছে একটি করে মন৷ আমি তোমাদের ইতোপূর্বে ৰলেছি যে, অনুন্নত জীবের মন হ’ল একটা সহজাত বৃত্তি মাত্র৷ কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে মন হচ্ছে ক্রমঃবিকাশশীল সত্তা৷ সমস্ত সত্তাই জেনে বা না জেনে অজস্র ভাব-ভাবনা, অনুভূতি, বৃত্তি, বাসনা, কামনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ সাধক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক---এদের প্রত্যেকের মনে সেই পরম সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবার একটা আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে রয়েছে--- অণুমানসকে ভূমামানসের কেন্দ্রগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হৰে৷ ভূমামানসের কেন্দ্রগুলির দিকে এগিয়ে যাবার পথে কোন ৰাধাই মেনে চলা উচিত নয়, কোন প্রতিকূলতাকেই প্রোৎসাহিত করা উচিত নয়৷ এইভাবেই মানবতার অবারিত অগ্রগতি ঘটুক, যা কোন জাতি, বর্ণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, ঐতিহাসিক বা প্রথাগত ৰাধাকে স্বীকার করে না৷ মানবজাতির রয়েছে এক ও অভিন্ন উত্তরাধিকার৷ আর সকলে সমষ্টিগতভাবে সেই উত্তরাধিকারকে পাথেয় করে বিশ্ব-মানবতাবাদের পতাকা হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলুক৷ এ বিশ্বে সবাই সুখী হউক৷ সবাই সমস্ত রকম রোগমুক্ত হউক৷ সবাই সবকিছূর ভাল দিকটা দেখুক৷ অবস্থার চাপে পড়ে কাউকে যেন কোন কষ্ট ভোগ করতে না হয়৷
ইসতাম্বুল, ১৫ সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৯