ধর্মমতের উপর ভিত্তি ক’রে তৈরী হয়েছে পাপ–পুণ্যের খসড়া, তৈরী হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন দণ্ডসংহিতা ও শাস্ত্র৷ নিজেদের কায়েমী স্বার্থের দুরভিসন্ধিতে সেই সব শাস্ত্রকে অপৌরুষেয় বলে প্রচার করা হয়েছে৷ তাই মানুষের থেকে তথাকথিত শাস্ত্র বর্ণিত দেববাণীর দাম অনেক বেশী৷ মানুষ সেই বাণীর, সেই ব্যবস্থার অবমাননা বা বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে পেতে হবে কঠোর শাস্তি৷ বিজাতীয় মানুষকে স্পর্শ করা মহাপাপ৷ সমাজ থেকে তাকে হ’তে হবে বিতাড়িত সেই পাপের জন্যে৷ শাস্ত্রমতে হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, সে প্রায়শ্চিত্ত কখনও কখনও তার প্রাণহানিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ কেউ যদি এই কঠোর শাস্তি থেকে একটু শৈথিল্য প্রার্থনা করে, সমাজগুরুরা তা’ দিতে অপারগ৷ কী ক’রতে পারেন তাঁরা, শাস্ত্র বলেছে যে পুঁথিসর্বস্ব যাদের জীবন তারা মানুষের জীবনের মূল্য কি বোঝে? কত যুগ কত জীবন কত ধাপ পেরিয়ে একটা জীব মানুষের শরীর পায়৷ তাই বলা হয়েছে, ‘দুর্লভং মানুষং জন্ম’৷ কিন্তু এ ধরণের কত অমূল্য জীবনকে শাস্ত্রের বিধান মানতে গিয়ে অকালে বিনষ্ট হতে হয়েছে৷ কত নিরীহ মানুষের জীবন শাস্ত্রের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হয়েছে তার হিসেব কে রাখে
পাপ বা পুণ্য দেশ–কাল–পাত্রভেদে মানসিক বিকৃতির নাম বিশেষ৷ যে ধরণের বিকৃতিকে এক দেশে বা এক কালে একজন পাত্র বলেছে পাপ, অন্য দেশ বা অন্য কালে অন্য একজন বলেছে পুণ্য৷ তাই ব্যষ্টিবিশেষের, কালবিশেষের পাপ–পুণ্যের ধারণাকে চরম বলে মনে করার পেছনে কোন যুক্তি নেই, কারণ বিশেষ বিশেষ ধর্মমতাশ্রয়ী বিশ্বাস, প্রাকৃতিক বা অন্য কোন কারণে সৃষ্ট সমাজের পুঞ্জীভূত সংস্কার–এ দু’টোর যে কোন একটাকে বা এক সঙ্গে দুটোকে কেন্দ্র করে পাপ–পুণ্য বোধ তৈরী হয় ও এই বোধ দেশ–কাল–পাত্র ভেদে পাল্টায়৷ তাই দেখেছি প্রাচীন ভারতের লোকে নির্বিকার চিত্তে পতিবিয়োগে শোকাকুলা অসহায়া নারীকে টেনে হিঁচরে মৃত স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারত৷ এটাই ছিল তাদের শাস্ত্রের পুণ্যকর্ম৷ কিন্তু আজ সেই কর্মকেই বলা হবে পাপ৷ এই মেকি ধর্মবোধ মানুষকে শোষণ করেছে বার বার৷ শাস্ত্রের বিধানে অন্ধবিশ্বাসী মানুষ সেদিন এই ভাবে নৃশংস নরমেধ যজ্ঞ করে তৃপ্তি পেত৷ শাস্ত্র বলেছে কুমারী জীবন ধারণ করা পাপ, তাই ন’ বছরের অনূঢ়া বালিকাকে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধকে বিবাহ করতে বাধ্য করা হয়েছে৷ আবার সেই বৃদ্ধ পতির মৃত্যুর পর শাস্ত্রের শ্লোক শুণিয়ে তাকে শেখানো হয়েছে, মৃত পতির কাছেই তাকে ফিরে যেতে হবে, দ্বিতীয় বিবাহ হতেই পারে না৷ ভাবপ্রবণা নারী মৃত্যুর পর স্বামীর প্রেতাত্মার সঙ্গে মিলিত হবার আশায় আজীবন কৃচ্ছ্র সাধন চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে৷ কিন্তু পুরুষদের বহুবিবাহে কোন দোষ নেই৷ যে সমস্ত নারীদের অসহায়ভাবে বহুপত্নীকের স্ত্রী হতে হয়েছে, তাদের জ্বলতে হয়েছে সারা জীবন সতীনের জ্বালায়৷ তার স্বাক্ষর রয়েছে ছোট–ছোট গ্রামীণ ছড়ার মধ্যে৷ সতীনকে মারতে পারলেই শান্তি–‘‘নাড়ু নাড়ু নাড়ু / সতীন মেরে হাতে পরব খাড়ু৷’’ শুধু সতীন নয়, বর্তমান সমাজ–ব্যবস্থায় কোথাও কোথাও আজও বাড়ীর বউদের শাশুড়ীর ও ননদের খোঁটায় সারা জীবন দুর্বিষহভাবে কাটাতে হয়৷ সরা মেপে নাকি বউদের জন্যে রান্না করা হ’ত৷ সেই সরাটি যদি ভেঙ্গে যায়, তবে সেদিন বউদের কত না আনন্দ৷ কিন্তু শাশুড়ী আরও শক্ত, আরও শক্ত মানুষ, সরার পরিবর্ত্তে হাতের মুঠোর চাল রাঁধেন বউদের জন্যে৷
‘‘ছোট সরাখানি ভেঙ্গে গেছে, বড় সরাখানি আছে,
নাচ আর কাঁদ বউ, হাতে আটকাল আছে৷’’
কী ভয়ানক নিষ্ঠুরতা মানুষের সাধারণ ন্যুনতম প্রয়োজন মেটাবার ক্ষেত্রেও এইরূপ নিষ্ঠুরভাবে কার্পণ্য করা হ’ত৷ এইভাবে তখনকার নারীদের ওপর নিয়ম–কানুনের নির্যাতন, এমনকি নিজের ঘরের মধ্যেও অত্যাচার, সব কিছু মিলে তার জীবন ছিল অসহনীয়৷ সহ্য করতে না পেরে গোপনে গোপনে কাঁদতে হয়েছে সেই সমস্ত অসহায়া নারীদের৷ প্রতিকারহীন অত্যাচারে কত লক্ষ লক্ষ নারী বিনিদ্র রজনীর অন্ধকারে গুমরে কেঁদে মরেছে, কে তার হিসেব রাখে৷ শাস্ত্র–শাসনের ষ্টীমরোলারের কাছে এ ধরণের কোমল মাটির মত ভাবপ্রবণতা, আশা–আকাঙক্ষা, দুঃখ–লাঞ্ছনা সব গুঁড়িয়ে গেছে৷ সেই ক্রন্দন, সেই আর্তনাদ কেউ কাণ পেতে শোনেনি৷ পাপ–পুণ্যের অবিবেকী নিয়মকানুনে মানুষের প্রাণের ঠাকুরকে বারবার করা হয়েছে ঘৃণা, পদাঘাত৷
আমাদের বক্তব্য হ’ল, মানুষকে নীচু করে, মানবতাকে অবহেলা করে, শাস্ত্রকে কখনও শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া যায় না৷
(‘‘সামাজিক মূল্য ও মানবিক মৌলনীতি’’, ‘অভিমত’, ২য় খণ্ড)
যখন মানুষ জড়তার দ্বারা পরিচালিত হয়–ঠিক পরিচালিত নয়, নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তার অভ্যন্তরীণ চলমানতা নষ্ট হয়ে যায়৷ সুতরাং সে তখন প্রাণহীন হয়ে পড়ে৷ তার অবস্থা তখন মৃতের চেয়েও খারাপ হয়ে যায়৷ তাই তোমরা মার্গের ছেলে–মেয়েরা–জেনে রাখো, তোমরা কখনই কোন ভাবজড়তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিশ্বের চক্রবিন্দু থেকে দূরে সরে যেও না–সেই মধ্যমণি থেকে তোমাদের ব্যাসার্দ্ধের দূরত্বকে বাড়তে দিও না৷ সব সময় তোমরা তোমাদের ব্যাসার্দ্ধের দূরত্ব কমাবার চেষ্টা করো যাতে তোমরা চক্রনাভির অধিক থেকে অধিকতর কাছটিতে পৌঁছে যেতে পার৷
তোমরা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পার–ভাবজড়তা জিনিসটা কী? তোমরা সকলেই শিক্ষিত ছেলে–মেয়ে৷ তোমাদের মনে রাখা উচিত ভাবজড়তা এক বিশেষ ধরণের মানসিক সংরচনা৷ অবশ্য ধারণা মাত্রেই এক–একটা মানসিক সংরচনা কিন্তু এদের সীমারেখার ব্যাপারে অবশ্যই তারতম্য থেকে যায়৷ আমার মনে হয় তোমরা কেউ কেউ ‘প্রাউট’–এর কথা শুণেছ৷ আমি মনে করি তোমরা সেগুলো পড়েছও৷ সেখানে প্রাউটের পঞ্চম তত্ত্বে বলা হয়েছে যে দেশ–কাল–পাত্রের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের উপযোগিতা গ্রহণের পদ্ধতিও পরিবর্ত্তিত হয়ে যায়৷ আমি কি তা বলিনি? হ্যাঁ, এমনটাই বলেছি, আর তারই ফলে পরিবর্ত্তনের সুযোগ সেখানে রয়ে গেছে৷ মানুষের মন কখনই বাঁধাধরা কোন কিছুকে নিয়ে থাকতে চায় না৷ সে গতি চায়৷ আর শুধু গতিই নয়, সে গতির মধ্যে দ্রুতিও আনতে চায়৷ কিন্তু ভাবজড়তা কী ভাবজড়তা হচ্ছে এমন এক ধরণের ভাব যার চারিদিকে একটা গণ্ডী টেনে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে এর বাইরে যাওয়া চলবে না৷ অর্থাৎ ভাবজড়তা মানুষকে কৃত্রিম গণ্ডীর বাইরে যেতে দেয় না৷ সুতরাং ভাবজড়তা একান্তভাবেই মানব মনের মৌলিক গতি প্রবাহের পরিপন্থী৷
জেনে অথবা না–জেনে প্রত্যেক সত্তাকেই পরম কেন্দ্রবিন্দুর চারিপাশে ঘুরতে হবেই৷ এর কোন বিকল্প নেই৷ কিন্তু ভাবজড়তার ক্ষেত্রে কী হয় যখন কেউ কেন্দ্রবিন্দুর কাছে আসতে থাকে তখন সে ভূমা মনের দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয়ে যায় যে সে তখন সেদিকে ছুটে যায়–কেবল তার সঙ্গে মিলেমিশে একান্ত হবার জন্যেই৷ বস্তুতঃ যখন তা’ হয়ে থাকে তখন অণু মন ভূমা মনের সঙ্গে মিলে এক হয়ে যায় আর ভূমা মন সব সময়েই ভাবজড়তার ঊর্ধ্বে৷ তাই প্রথম থেকেই ভাবজড়তার প্রভাব মুক্ত হতে তোমাদের সংগ্রামমুখর হতে হবে৷ এই ভাবজড়তার জন্যেই মানব সমাজের যথার্থ প্রগতি হয়নি৷ গত পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে মানব মনীষার যথেষ্ট বিকাশ হয়েছে, গত দু’শো বছরের মধ্যে উন্নতি আরও দ্রুতগতিতে হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থাৎ গত কয়েক দশকে উন্নতি তার চেয়েও বেশী হয়েছে৷
(‘‘ভাবজড়তা থেকে সাবধান’’
‘কনিকায় প্রাউট’, ৯ম খণ্ড)