‘‘কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্ত্তব্যঃ বিনির্ণয়ঃ৷
যুক্তিহীনবিচারে তু ধর্মহানিঃ প্রজায়তে’’৷৷
শাস্ত্রে লেখা আছে, তাই মানতে হবে–এই ধরণের নির্দেশ গ্রহণযোগ্য নয়৷ কারণ, যিনি শাস্ত্র তৈরী করেন তিনি কেমন ধরণের লোক তাও তো দেখতে হবে৷ যিনি যুক্তির দ্বারা পরমপুরুষের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁকে মানা যেতে পারে৷ আর যেখানে যুক্তি নেই, কেবল পরমাত্মার দোহাই দিয়ে আপন মতবাদকে প্রচার করতে চায় সেটা গ্রহণযোগ্য নয়৷ কেননা, তাতে মানুষের প্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়, কারণ সেটা নিছক ভাবজড়তা৷ যা যুক্তিবিচারবিবর্জিত ন্প্তপ্তপ্সন্ধন্ন্তুত্র, যা অবিবেকপূর্ণ তেমন কিছু মানলে তাতে ধর্মহানি হয়ে থাকে৷
এমন কিছু লোক রয়েছে যাদের বক্তব্য হ’ল যে পুরুষ মানুষেরা পরমপুরুষের বিশেষ প্রিয়, নারী জাতি প্রিয় নয় তিন জন নারী একজন পুরুষের সমান–এ সবই ভাবজড়তা৷ এসব উদ্ভট ধারণা ওই ভাবজড়তা থেকেই উৎপত্তি৷ বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই বুঝে নেবে যে এই সমস্ত উক্তিগুলো কতখানি অন্তঃসারশূন্য, যুক্তিবিবর্জিত৷ একজন পুরুষ মানুষের বুদ্ধি তিনজন মহিলার বুদ্ধির সমান–এটা একটা হাস্যকর উক্তি৷ বাস্তব জীবনে কোন কোন ক্ষেত্রে কোন পুরুষ মানুষের বুদ্ধি তিন জন মহিলার বদলে দু’জন মহিলার বুদ্ধির সমানও তো হতে পারে৷ আবার ক্ষেত্র বিশেষে কেবল একজন মহিলার বুদ্ধি বিশ জন পুরুষের বুদ্ধির সমানও তো হতে পারে৷ এমন বুদ্ধিমতী নারীও তো সমাজে রয়েছেন৷ আবার যদি দৈহিক ওজনের কথা তুলি তা হলে দেখব যে, কোন একজন মহিলার দেহের ওজন একাধিক পুরুষের ওজনের তুলনায় বেশীও হয়ে থাকে৷ তাই এ বিষয়ে কোন অনুমানভিত্তিক যুক্তি–তর্ক চলে না৷
আর এই যে মেয়েরা কাপড়ের বোরখার মধ্যে নিজেদের মুখ ঢ়েকে চলে, এটাও কি কোন যুক্তিসংগত?বোরখার মধ্যে ছিদ্র থাকে, সেই ছিদ্র দিয়েই পথ দেখে দেখে তাকে এগিয়ে চলতে হয়৷ এ সবই অমানুষিক ব্যাপার, পাশবিক ব্যাপার৷ কোন সভ্য সমাজের, কোন সভ্য দেশের সভ্য মানুষের এ ধরণের নির্দেশ গ্রহণ করা উচিত নয়৷ এসব ভাবজড়তা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এসব ভাবজড়তার নগ্ণ রূপ৷
ভারতবর্ষে এক সময় ছিল যখন কোন বিশেষ শাসকগোষ্ঠী নারীদের অপহরণ করত৷ সেই সমস্ত দুষ্টস্বভাব লোকেরা যাতে মহিলাদের মুখ দেখতে না পায় সেই জন্যে সমগ্র উত্তর ভারতে যেখানে যেখানে ওই শাসক গোষ্ঠীর অপ্রতিহত প্রভাব ছিল সেখানে নারী সমাজে বোরখার প্রচলন শুরু হয়েছিল৷ সেই সময় সমাজে কেবল একটা বিশেষ ক্ষেত্রে যে ভাবজড়তা চলত তাই নয়, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ভাবজড়তার প্রচলন ছিল৷
ভাবভূমির ক্ষেত্রে এই যে জড়তা, এটা প্রগতিকে রুদ্ধ করে দেয়৷ এই ধরণের ভাবজড়তা বহুকাল থেকে সমাজে চলে এসেছে৷ সেক্ষেত্রে আচরণ ঠিক নেই, বিচারৰুদ্ধির অভিব্যক্তি নেই, ত্যাগের ভাবনা নেই৷ তাই ভগবান ৰুদ্ধ তাঁর সমকালে এই ধরণের যুক্তিবিবর্জিত ভাবজড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন৷
আরও অনেক ধরণের ভাবজড়তা রয়েছে৷ যেমন, যজ্ঞে ঘি ঢ়ালা ইত্যাদি৷ দেশের হাজার হাজার দরিদ্র নিরন্ন মানুষ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে তিলে তিলে শুকিয়ে মরছে৷ অপর দিকে কিছু মানুষ যজ্ঞের নামে আগুনে ঘি ঢ়ালছে৷ এটা যে কতখানি অযৌক্তিক প্রতিটি ৰুদ্ধিমান মানুষ তা জানেন৷ যজ্ঞের নামে ঘি, চাল ইত্যাদি বহু মূল্যবান জিনিসের অপচয় ঘটে থাকে৷ কারো কাছে যদি অধিক ঘি, চাল মজুদ থাকে, সেগুলো দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিতরণ করাটা অধিকতর ধর্মসম্মত, মানবতাসম্মত৷ যদি কেউ খুব কৃপণ হয় তা হলে সে নিজেই খেয়ে ফেলুক কিন্তু কৃপণ লোকেরা তা করবে না৷ বরং তা দিয়ে সে যজ্ঞ করবে৷ যজ্ঞ করতে গিয়ে ঘরে যত পচা ঘি মজুদ থাকে তা–ই দিয়ে সে যজ্ঞ করে৷ এ সবই ভড়ং মাত্র৷
এই সমস্ত প্রচলিত ভাবজড়তার বিরুদ্ধে যারা সংঘর্ষ করবে তাদের অবশ্যই যথেষ্ট সাহস থাকা দরকার৷ ভগবান ৰুদ্ধের এ ধরণের সাহস অবশ্যই ছিল৷ যুক্তি দিয়ে বিচার করলে দেখবে যদি কোন একটা নদীকে পবিত্র বলে মানি, অন্যটা মানি না, সেটা কি যুক্তিপূর্ণ হবে? মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় যত আবর্জনা জমে থাকে সবই গঙ্গাজলে গিয়ে মেশে৷ তাহলে গঙ্গার জল পবিত্র থাকছে? একথাটা যদি কেউ সাহস করে বলে ফেলল তো বহু লোক তার বিরোধিতার করতে শুরু করে দেবে৷ তাই সাহস না থাকলে কেউ এ ধরণের ভাবজড়তার বিরুদ্ধে লড়তে পারে না৷ হয়তো মনে মনে তুমি জিনিসটা অযৌক্তিক ৰলে মেনে নেবে না কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলতে পারবে না৷ ভগবান ৰুদ্ধের এ ধরণের সাহস ছিল৷ তাই তিনি তাঁর সমকালীন ভাবজড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন৷
মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে অনেক ভাবজড়তা তৈরী করে নিয়েছিল৷ এই ভাবজড়তার জন্যে গোষ্ঠীবিশেষের সুবিধা হয়ে থাকে৷ সেই বিশেষ গোষ্ঠীর যারা বিরোধিতা করে তাদের ৰহু অসুবিধা–ত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়৷ তেমনি উঁচু জাত, ছোট জাত – এসব জাতিগত ভেদাভেদ এক ধরণের ভাবজড়তা৷ এর পেছনে কোন যুক্তিসম্মত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না৷ প্রতিটি মানুষ যখন পরমাত্মার সন্তান, তখন জাতপাতের কথা ওঠে কী করে? তাই যে জাতপাত মানে সে পরম পিতাকে মানে না৷ যে পরম পিতাকে মানে সে জাতপাত মানবে না৷ এটাই হ’ল যুক্তি৷ অযৌক্তিক ভাবজড়তার পক্ষে কখনো কখনো কতকগুলো শ্লোক তৈরী করেও শোণানো হয়৷
(‘‘ভাবজড়তা প্রগতির অন্তরায়’’, ‘আনন্দবচনামৃতম, পঞ্চদশ খণ্ড)