এখন ভারতবর্ষ ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক৷ এই দেশের নাম ভারতবর্ষ৷ জানতো, পৃথিবীতে যা কিছু শব্দ আছে সবই অর্থপূর্ণ৷ গ্রামের নামই হোক বা নদীর নাম, সবেরই একটা অর্থ আছে৷ এ দেশের নাম ভারতবর্ষ কেন রাখা হ’ল? প্রাচীনকালে এখানকার বাসিন্দা ছিল দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলিয়ন৷ আর্যরা যখন এল তখন তারা এর নামকরণ করলে ‘ভারতবর্ষ’৷ এমন নাম কেন করা হ’ল?
বৈদিক ভাষায় ‘ভৃ’ বা ‘ভর’ ধাতুর অর্থ খাওয়ানো৷ ভর+অনট = ভরণ৷ সম্ পূর্বক ভর+অনট =সম্ভরণ্, মানে খাওয়ানো৷ ‘ভৃ’+অল+ভর, ভর মানে যে খাওয়ায় আর ‘তন্’ ধাতু ‘ড’ প্রত্যয় করে ‘তন্’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে৷ ‘তন্’ ধাতুর অর্থ বিস্তার বা ব্যাপ্তি–‘তন্’ ধাতু+‘ড’ মানে যে তোমার ব্যাপ্তিতে সহায়তা করে বা সাহায্য করে৷ ইংরেজীতে যেমন ‘ন্দ্বব্জ’ প্রত্যয় লাগে, সংস্কৃতে তেমনি ‘ড’ প্রত্যয় লাগে–‘তন্+ড=ত৷ ‘ভরত’ মানে যে খাওয়ায়, যে বিস্তার করায়৷ তোমার ভৌতিক ব্যাপ্তি, মানসিক ব্যাপ্তি তথা আধ্যাত্মিক ব্যাপ্তিতে যে সাহায্য করে সে ‘ভরত’৷ ‘ভরত+অণ=ভারত অর্থাৎ ‘ভরত’ সম্বন্ধীয়–খাওয়া–দাওয়া আর শারীরিক, মানসিক তথা আধ্যাত্মিক বিস্তারে যে দেশ সহায়তা করে, তা ‘ভারতবর্ষ’৷ ‘বর্ষ’ মানে দেশ৷ এই দেশের নাম ভারত নয়, ভারতবর্ষ৷ দেশটির নাম ‘ভারতবর্ষ’ রাখা হয়েছিল কারণ আর্যরা যখন এখানে এসেছিল তখন দেখল দেশটা ফলনশীল, অল্পপ্রয়াসে প্রচুর ফসল জন্মায়, সাধন–ভজনের জন্যেও অনুকূল পরিবেশ আর সহজেই অন্ন–বস্ত্রেরও যোগাড় হয়ে যাচ্ছে, তাই মানস–আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যেও প্রচুর সময় পাওয়া যাচ্ছে– তাই নাম হ’ল ভারতবর্ষ৷
আর্যদের আগমনের আগেই এ দেশে তন্ত্রের প্রচার ছিল৷ সদাশিবের আবির্ভাব কালে আর্যরা ভারতে পৌঁছেছিল তবে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েন নি৷ তন্ত্র ভারতেরই অবদান, ভারতেই এর উৎপত্তি৷ শাস্ত্রে আছে,
‘‘বঙ্গে প্রকাশিতা বিদ্যা মৈথিল্যে প্রবলীকৃতা৷
ক্বচিৎ ক্বচিৎ মহারাষ্ট্রে গুর্জরে প্রলয়ংগতা৷৷’’
যে সময়ে এই শ্লোক লেখা হয়েছিল, সেই সময়ের পরিস্থিতি এতে বর্ণনা করা হয়েছে৷ বাংলায় তন্ত্রের উৎপত্তি, মিথিলাতে এর ব্যাপ্তি, গুর্জর ও মহারাষ্ট্রেও এর বিস্তার৷ তন্ত্র তাই ভারতেরই৷
‘ভারতবর্ষ ও আধ্যাত্মিকতা’ বিষয়টিকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতবর্ষের কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্যই লক্ষ্য করা যায়৷ বৈশিষ্ট্যগুলি কী? প্রথমতঃ নামের মধ্যেই এর বিশেষতা প্রমাণিত হয়৷ প্রতিটি বস্তুর, তা ভৌতিক হোক বা মানসিক, নিজ নিজ গুণ আছে, নিজস্ব বিশেষতা আছে, গুণধর্ম আছে৷ আর ওই বিশেষতা •characteristic— বা গুণধর্মই •property— তার পরিচিতি৷ যতক্ষণ পর্যন্ত ওই গুণধর্ম থাকে ততক্ষণ আমরা বলি বস্তুটি অমুক, আর যখন এই গুণধর্ম থাকে না তখন বস্তুটির স্বরূপে পার্থক্য এসে যায়৷ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে যখন আমরা দেখি বস্তুটির অমুক অমুক গুণ আছে তখন বলি এটি সোণা, না হলে বলব রঙ্ সোণার মত হলেও বস্তুটি অন্য কিছু৷
তা, বৈশিষ্ট্য থেকেই বোঝা যায় সেই স্থানের মানুষের শরীরের ওপর এর কী ধরনের প্রভাব অথবা ভৌতিক শরীর–বিস্তারে তা কীভাবে সহায়তা করবে৷ এর বৈশিষ্ট্যগুলি তার স্বভাব থেকেই বোঝা যায়৷ শারীরিক প্রতিক্রিয়া আমরা সহজেই ক্ষুঝে যাই, মানসিক প্রতিক্রিয়া একটু চেষ্টা করলে বুঝতে পারি, আর আধ্যাত্মিক প্রতিক্রিয়া সাধনা করলে তবে বোঝা যায়৷ তাই প্রতিটি জায়গার নিজস্ব একটা বিশেষত্ব আছে, আর এই বিশেষত্ব কেবল ভৌতিক নয়, মানসিক ও আধ্যাত্মিকও৷ এমন অনেক ভৌতিক বস্তু আছে যার থেকে চাইলে ভৌতিক সহায়তা পাওয়া যায়৷ কেউ যদি মানসিক সহায়তা চায় তাও পেতে পারে, আবার আধ্যাত্মিক সহায়তাও চাইলে পাওয়া যেতে পারে৷
মনে কর একটা স্থান, খুব সুন্দর পরিবেশ৷ সাধনার খুব উপযুক্ত জায়গা, বসলেই মন সঙ্গে সঙ্গে একাগ্র হয়ে যাবে৷ কিন্তু কেউ যদি সেখানে কেবল পরিদর্শন করতে যায় তাহলে বলবে–‘বাঃ খুব সুন্দর, খুবই সুন্দর জায়গা, খুব সুন্দর সুন্দর সব ফল, সমুদ্রও এখানে কত সুন্দর৷’ সেই জায়গা থেকে সে কোনো মানসিক ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি পায় নি৷ আজকাল একটা ঢং হচ্ছে, লোকে সাধনানুকূল জায়গায় পয়সা খরচ করে যাচ্ছে আর বলছে, ‘‘আমি তো ভ্রমণার্থী •tourist—, তীর্থযাত্রী নই৷’’ অর্থাৎ সেই জায়গা থেকে সে মানসিক তথা আধ্যাত্মিক সহায়তা নিতে পারছে না৷ প্রতিটি জায়গার, প্রতিটি বস্তুর–যেমন ধর একটা আম, মানুষের শরীর, মন ও আত্মার ওপর এর একটা বিশেষ ধরনের প্রভাব আছে৷ যেমন ধর জাম, এরও আলাদা প্রভাব আছে৷ প্রতিটি বস্তুরই এক বিশেষ প্রভাব আছে৷ প্রাচীনকালে, গোমাংস পচে যাওয়ার পর তার যে রূপান্তরণ হয়েছিল, তার থেকে এক ধরনের গুল্মের উৎপত্তি হয়– তার নামই পেঁয়াজ৷ তাই পচা মাংসের মধ্যে যে সব গুণ বা দোষ আছে, পেঁয়াজেও তা আছে৷ সেইজন্যে ভালো স্বভাবের মানুষেরা পেঁয়াজ খায় না৷ এইভাবে প্রতিটি বস্তুরই মানুষের শরীর, মন তথা আত্মার ওপর পৃথক পৃথক প্রভাব রয়েছে৷ বুদ্ধিমান মানুষ তাই বিচার–বিবেচনা করে আহার করবে৷ মানুষ ছাগল নয় যে, যা পাবে তাই খেয়ে নেবে উট নয় যে, যা পাবে তা–ই খেয়ে নেবে৷ আমাদের শরীর, মানসদেহ তথা আধ্যাত্মিক শরীরের ওপর কোন্ বস্তুর কী ধরনের প্রভাব সেটা বিচার করে খেতে হবে৷
এই যে ভারতবর্ষ, এটা মানসিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যে খুবই উপযুক্ত জায়গা ছিল কারণ আহার সংগ্রহ খুব সহজেই হয়ে যেত৷ সেই সময় প্রাচীনকালে বেঁচে থাকাটাই মানুষের পক্ষে খুব কঠিন ছিল–কেবল সংঘর্ষ আর সংঘর্ষ৷ আজকাল বেঁচে থাকাটা অনেক সুবিধাজনক হয়ে গেছে৷ জীবন অনেকটাই সুরক্ষিত৷ এমনকি তুলনামূলক বিচারে বিক্টোরিয়ন যুগের সঙ্গে আজকের যুগের অনেক পার্থক্য এসে গেছে৷
সাধক সাধনার জন্যে পৃথিবীর নানান কোণ থেকে এ দেশে আসত৷ আর এত সাধক, এত অধ্যাত্মপ্রেমী এখানে এসেছে ও সাধনা করেছে যে, এদের সকলের মানসিক তথা আধ্যাত্মিক শক্তিতরঙ্গে এখানে একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী হয়ে গেছে৷ আবার কিছু অন্য শ্রেণীর মানুষও এখানে আসার ফলে আহার বিহারের ভৌতিক সুবিধাটুকু আজ আর নেই৷ বাইরের খাদ্যও আমদানী করতে হচ্ছে৷ এ সব সত্ত্বেও এখানে একটা বিশেষ আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যও •spiritual tradition— তৈরী হয়ে গেছে যা কখনওই নির্মূল হয়ে যাবে না৷