‘আমি কারো প্রতিচ্ছবি নই, প্রতিধবনি নই, কারো Prototype নই--I am myself’৷ কথাগুলি বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র৷ ১৯৩৯ সালে গান্ধী মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি হবার পর গান্ধীজী ও তাঁর লবির নেতাদের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি৷ আসলে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কংগ্রেসে যেটা চালু ছিল তা হ’ল পুঁজিবাদী একনায়কতন্ত্র৷ গান্ধীজী ছিলেন সেই পুঁজিপতিদেরই প্রতিনিধি৷ তাই কংগ্রেসে গান্ধীর কথাই শেষ৷ গান্ধীবাদী নেতা শেঠ গোবিন্দদাস সে কথা স্বীকারও করেন৷ তিনি বলেন---‘ফ্যাসিস্টদের মধ্যে মুসোলিনী, নাৎসীদের মধ্যে হিটলার ও কমিউনিষ্টদের মধ্যে স্ট্যালিনের যে স্থান কংগ্রেস সেবীদের মধ্যে গান্ধীজীরও সেই স্থান৷’ অর্থাৎ গান্ধী যাকে মনোনীত করবেন সেই হবেন কংগ্রেসের সভাপতি৷ সেখানে সুভাষচন্দ্র গান্ধীর অমতে গান্ধী মনোনীত প্রার্থী সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে সভাপতি হলেন, গান্ধী ভক্তদের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি৷ সেদিন তাই গান্ধী ভক্তরা কদর্যভাবে সুভাষচন্দ্রকে আক্রমণ করেছিলেন৷ আর সুভাষকে আক্রমণ করতে গিয়ে গান্ধজীকে তাঁরা হিটলারের সঙ্গে তুলনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি৷ এই প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র ওপরের কথাগুলি বলেছিলেন৷ অর্থাৎ তিনি কারো প্রতিনিধিও নন, কারো প্রতিচ্ছবিও নন, কারো মতও নন৷ সুভাষ সুভাষই৷ কিন্তু সেদিন অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের আসল রূপটা ফুটে উঠেছিল যখন কংগ্রেসের ভেতর থেকে আবাজ ওঠে---‘হিন্দুস্তান কি হিটলার গান্ধীজী কি জয়’৷
দেশীয় পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কথা বলে যে লোকটা, মানুষকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেবার চিন্তা করে যে লোকটা সেই সুভাষকে কী পুঁজিপতি, কী হিটলারবাদী কংগ্রেস কারো পক্ষেই নিরাপদ নয়৷ অতয়েব সুভাষকে যে কোনও ভাবে হোক কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরাতে হবেই৷ তার জন্যে যে কোন কদর্য পথ সেদিন কংগ্রেসের গান্ধীবাদীরাই নিতে প্রস্তুত ছিল৷ তাই অহিংসার পূজারী হিটলারের সঙ্গে তুলনা করলেও কংগ্রেসের ভেতর কোনও প্রতিবাদ ওঠে নি৷
প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন একজন, অহিংসার মুখোশধারী কংগ্রেসের এই কদর্য রাজনীতি দেখে তাঁর পক্ষে নীরব থাকা সম্ভব হয়নি৷ তিনি বাঙলার কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ ব্যথিত হৃদয়ে তিনি বলেন---‘অবশেষে আজ, এমনকি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেও হিটলারি নীতির জয়ধবনী শোনা গেল৷ স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্যে যে বেদী উৎসৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিষ্টের সাপ ফোঁস করে উঠেছে৷’
আজ দিল্লীর শাসকদের রক্তচক্ষু দেখার পর, অশালীন কথাবার্তা শোণার পর মনে হয় এই ফ্যাসিষ্ট কালচার কোন একটি বিশেষ দলের নয়, ভারতবর্ষের একটি বিশেষ অঞ্চলের৷ প্রায় তিনশ’ বছর ধরে’ সেই মারাঠা দস্যু বর্গী রাজা ভাস্কর পণ্ডিতের যুগ থেকে বাঙালী বার বার এই ফ্যাসিস্ট সাপের ছোবল খাচ্ছে৷
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এখানেই থেমে থাকলেন না, তিনি লিখলেন---‘কংগ্রেসেরও অন্তঃসঞ্চিত ক্ষমতার তাপ হয়ত অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠেছে বলে সন্দেহ করি৷ যারা এর কেন্দ্রস্থলে এই শক্তিকে বিশিষ্টভাবে অধিকার করে আছেন, সংকটের সময় তাদের ধৈর্য্যচূ্যতি হয়েছে৷ বিচারবুদ্ধি সোজা পথে চলেনি৷ পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সৌজন্য, যে বৈধতা রক্ষা করলে কংগ্রেসের বল ও সম্মান রক্ষা হ’ত, তার ব্যভিচার ঘটতে দেখা গেছে৷ এই ব্যবহার বিকৃতির মূলে আছে শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাব৷’
এই শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাব আজ আর শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই৷ ধর্ম, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংসৃকতি সমাজের সর্বস্তরেই এই বিকৃতি ও ব্যাভিচার দেখা দিয়েছে৷ তার মূলেও আছে ক্ষমতাবানের শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাব৷ যার শুরু হয়েছে সেই দিন সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র দিয়ে৷ তাই আজ যাঁরা নেতা-মন্ত্রীদের মুখে কদর্য ভাষা শুণে ও তাঁদের ঔদ্ধত্ত্বপূর্ণ অসংযমী আচরণ থেকে কপাল চাপড়াচ্ছেন আর ভাবছেন একী দেখি! তাঁরা কি দেশের এই ইতিহাস জানেন না? আসলে সবই জানেন৷ কিন্তু দেশীয় পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি রাজনৈতিক দল ও এইসব আঁতেল রা কেউ সুভাষকে সহ্য করতে পারেনি৷ তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই কলঙ্কিত ইতিহাস আজকের প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত থেকে গেছে৷
সুভাষচন্দ্র ও তাঁর দেশের প্রতি অবদানকে মুছে দেওয়ার জন্যেই সে ইতিহাসকে মুছে দেওয়া হয়েছে৷ তাই ভারতীয় রাজনীতিতে শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাবে যে বিকৃতি ও ব্যাভিচার রবীন্দ্রনাথ সেদিন দেখেছিলেন এরা যেন আজ নোতুন দেখছে এমনই ভান করছে৷ যদিও ভাষা ও ভাবভঙ্গি আজ আরো নিম্নমানের হয়েছে তবু ভারতীয় রাজনীতির এই কদর্য রূপ মোটেই নোতুন নয়৷
- Log in to post comments