কর্মমার্গ, কর্মযোগ একটা পথ, সাধনাও একটা পথ, ও সেই পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ জ্ঞানমার্গ (জ্ঞানযোগ)–সেও সাধনার একটা পথ৷ সেই পথ ধরেও লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ কিন্তু ভক্তি একটা পথ নয়, ভক্তি হ’ল লক্ষ্য, যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷ সেই জায়গাটা৷ সুতরাং ভক্তি কোনো ন্তুব্ভপ্তব্ধ নয় অর্থাৎ কোনো বিধি, সাধনা–বিধি নয়৷ ভক্তি হ’ল লক্ষ্য যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷
মানুষের যত প্রকারের আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের সর্বোচ্চ মানের অনুভূতিটাই হ’ল ভক্তি৷ ....জ্ঞান–কর্মের মাধ্যমে, নিরলস সেবার মাধ্যমে, মানসিক শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে, মানুষ ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ও ভক্তিতে যখন সে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আর তার কিছু বাকী থাকে না৷ সুতরাং ভক্তিকে জ্ঞান–কর্মের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসালে ভুল হয়ে যাবে৷
অনেকেই জানেন যে ভারতবর্ষে জ্ঞানমার্গের প্রাণপুরুষ তথা অধিষ্ঠাতা ছিলেন আদি শঙ্করাচার্য৷ সেই আদি শঙ্করাচার্য, যিনি জ্ঞানমার্গের প্রতীকস্বরূপ ছিলেন, তিনি বলেছেন–‘‘মোক্ষকারণসমগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী’’৷ অর্থাৎ মোক্ষ তথা স্থায়ী মুক্তির জন্যে যতগুলি রাস্তা আছে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে ভক্তি৷ এখানে মনে রাখতে হবে যে, আগেই বলা হয়েছে, ভক্তি কোনো পথ নয়৷ মোবলাভের কারণস্বরূপ হচ্ছে ভক্তি৷ এই কথা আংশিকভাবে বলা যেতে পারে বটে কিন্তু ভক্তি কোনো পথ নয়৷ ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেই মোক্ষপ্রাপ্তি সহজসাধ্য হয়ে যায়৷ ভক্তির যথার্থ ব্যাখ্যা হ’ল–
‘‘ভক্তির্ভগবতো সেবা ভক্তিঃ প্রেমস্বরূপিণী৷
ভক্তিরানন্দরূপা চ ভক্তিঃ ভক্তস্য জীবনম্৷৷’’
তাই ভক্তি পথ নয়৷ ভক্তি হচ্ছে লক্ষ্য৷ মানুষ পরমপুরুষকে পাবার জন্যে অবিশ্রাম প্রয়াস করে চলেছে৷ অর্থাৎ তার মানসিক অধিক্ষেত্রে সে পরমপুরুষ থেকে দূরে আছে৷ সেইজন্যে না তাঁকে পাবার জন্যে সে চেষ্টা করছে, না তাঁর দিকে যাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছে৷ ওপরের শ্লোকে বলা হয়েছে–‘ভক্তির্ভগবতো সেবা’৷ দূর থেকে তো সেবা করা সম্ভব নয় অর্থাৎ ভগবানের নিকটে পৌঁছে তাঁর সেবা করা সম্ভব৷ দূরে থেকে ভগবানের কাছে পৌঁছনোর যে প্রয়াস তা ভক্তি নয়৷
এখানে তোমরা একটা কথা মনে রাখবে যারা কর্মযোগী তারা বলে থাকে–‘‘কর্ম ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ কর্ম বহু কুর্যাৎ’’–কর্মকে জানবে ব্রহ্মরূপে, এই জন্যে খুব কাজ করে চল৷ এখানে বলা হয়েছে কর্মকে ব্রহ্মরূপে মানা অর্থাৎ কর্মের ওপর ব্রহ্মকে অধ্যারোপিত করা হয়েছে৷ এটা কর্মের ওপরে ঈশ্বরত্বের আরোপ মাত্র (It is just ascribing Godhood to Karma) ৷ আর সেইজন্যে কাজ অনেক করবে কিন্তু ভক্তির ক্ষেত্রে এরকম কথা বলা যায় না৷ ভক্তির ব্যাখ্যা হচ্ছে–‘‘ভগবত সেবা’’৷ যখন তুমি সেবা কর তখন ওই সেবাটাই হচ্ছে ভক্তি অর্থাৎ সেবা করার পূর্বেই তুমি ভগবানের কাছে পৌঁছে গেছ, তবে না তুমি সেবা করছ সুতরাং ভক্তির মান বা ভক্তির স্থান অনেক ওপরে৷
ভক্তি শব্দ এসেছে ‘ভজ’ ধাতু ‘ক্তিন্’ প্রত্যয় করে৷ অন্য কোনো বস্তুকে নিজের না মনে করে বা নিজেকেও অন্যের কিছু মনে না করে, প্রাণ–মন তথা সমস্ত ভাবনাকে একাগ্র করে যখন ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, তাকেই বলে ভক্তি৷ পরমপুরুষের দিকে না গিয়ে যদি কোনো জড়জাগতিক বস্তুর দিকে এগিয়ে চলছ, তো তাকে বলে আসক্তি৷ তাই ভক্তি হ’ল মনের সমস্ত বৃত্তিকে একাগ্র করে পরমপুরুষের দিকে চলা৷ ভজ্ ধাতুর ভাবার্থ হচ্ছে ভক্তি৷
তাই বলা হয়েছে ‘ভক্তির্ভগবতো সেবা’৷ ঈশ্বরের ভজনা করে, ঈশ্বরের সান্নিধ্যে এসে কী করবে? সে সময় কী কাজ করবে? ‘ভক্তির্ভগবতো সেবা’ অর্থাৎ ভগবানের সেবা অর্থাৎ পরমপুরুষেরই সেবা করবে৷
সেবা কাকে বলব? তোমরা জান দুই জনের মধ্যে সম্পর্ক হয়তো দেওয়ার–নেওয়ার– এক ব্যষ্টি একটি টাকা দিল আর অন্যজনের কাছ থেকে সেই টাকা দিয়ে জিনিস কিনল৷ সংস্কৃতে একে বলে ব্যবসায়৷ ‘It is something mutual, give and take’ অর্থাৎ কেবলমাত্র ব্যবসায়, ব্যবসায়িক বিনিময় ন্তুপ্সপ্পপ্পন্দ্বব্জন্ ন্দ্বপ্রন্তুড়্ত্রুন্ধন্দ্ব্৷ এটি ভক্তি নয়৷ ভক্তি হচ্ছে unilataral, এক তরফা অর্থাৎ তুমি চাও যে, আমি যতখানি সম্ভব ভগবানের সেবা করব আর তার পরিবর্তে কিছু নোব না৷ এখন ভগবান মানুষের কাছে কী চান? কিছুই না৷ তিনি কেন কিছু চান না? কারণ তার কোনকিছুর অভাবই তো নেই৷ মানুষের কোনো বস্তুর অভাব থাকলে, সে সেই বস্তুটিকেই চায়৷ এটাই স্বাভাবিক৷ ভগবানের যখন কোনকিছুর অভাবই নেই তবে তিনি চাইবেনটা কী? তিনি কিছুই চাইবেন না৷ সেই দিক থেকে দেখলে মানুষ ভগবানকে কিছু দিতেও পারে না৷
আমি বলছিলুম সেবা হ’ল এক তরফা৷ মানুষ ভগবানের কাছে চায় অনেক কিছু–নাম, যশ, সম্পদ৷ কাউকে একশো টাকার একটা চেক্ দিলে, পরের দিন চা খেতে খেতে খবরের কাগজে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে যে কাগজের কোন্ স্থানটিতে খবরটি ছাপা হয়েছে যে, অমুক ব্যষ্টি একশো টাকা দান করেছে৷ এখানে দান এক তরফা হ’ল না৷ তুমি দান দিলে তো তার পরিবর্তে খবরের কাগজের মাধ্যমে যশ পাবার চেষ্টা করছ৷ তাহলে এটা সেবাও হ’ল না, দানও হ’ল না৷ সোজাসুজি ব্যবসায়৷ দিলে টাকা আর কিনলে যশ৷ তাহলে ভগবানের সেবা কীভাবে করবে? ভগবানের সেবা করার উপায় হচ্ছে তাঁর সৃষ্ট এই যে জগত, সেই জগতের প্রত্যেক জীব তাঁর অত্যন্ত প্রিয়৷ তুমি তার সেবা কর৷ আর তাঁকে পাবার দ্বিতীয় উপায়টা হ’ল তার ভক্ত হও৷ ধর্মমহাচক্র, ১৮ জুন ১৯৮১