‘আমি পরমপুরুষের দাসানুদাস, তাঁর কাজ তিনিই করছেন, আমি তাঁর যন্ত্রমাত্র’–এই যে মানসিকতা একেই বলে ‘প্রপত্তি’৷ ‘প্রপত্তি’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হ’ল ঃ প্র–পত্ ক্তিন্ ঞ্চ প্রপত্তি৷ প্রপত্তিভাবের সাধক দুঃখকে দুঃখ, সুখকে সুখ বলে আদৌ মনে করেন না বস্তুতঃ সুখ–দুঃখকে তিনি সমভাবে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেন৷
এই প্রপত্তি–মানসিকতার্ বিপরীত মেরুতে রয়েছে ‘বিপ্রপত্তি’৷ বিপ্রপত্তিতে মানুষ ভুল করে ভাবে যে সে–ই সব কিছু করছে–অন্যে নয়, সে–ই সব কিছু করছে৷ এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতার দরুণ ক্রমশঃ সে স্থূল ভাবাপন্ন হয়৷ প্রপত্তির বেলায় মনের ভাবটা হ’ল এই যে পরমপুরুষের ইচ্ছাতেই সব কিছু হয়ে চলেছে৷ তিনি অনুকম্পা করে আমাকে তাঁর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন৷ চাইলে তিনি আমাকে তাঁর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার নাও করতে পারেন৷ তিনি আমাকে দিয়ে কাজ করান বা না করান, তিনি যেমনটি চাইবেন তেমনটিই হবে–প্রপত্তি ভাবের সাধকের মনে মুখ্যতঃ এই ধরনের ভাবনাই থাকে৷ প্রপত্তির পুরো আনন্দ পেতে গেলে মানুষকে পরমপুরুষের চরণে সম্পূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণ করতেই হবে৷
বৈষ্ণব মতবাদ ও সুফী মতবাদ সম্পূর্ণতই এই প্রপত্তিভাবের ওপর আধারিত৷ এই প্রপত্তিভাবের সুন্দর অভিব্যক্তি ঘটেছে নীচের গানটিতে–
‘সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি,
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি৷
পঙ্কে ৰদ্ধ কর করী, পঙ্গুরে লঙঘাও গিরি,
কারে দাও মা ব্রহ্মপদ, কারে কর অধোগামী৷
আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর, তুমি ঘরণী,
আমি রথ, তুমি রথী মা, যেমন চালাও তেমনি চলি৷’
আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রপত্তি ছাড়া আর কিছুই নেই৷ সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রপত্তিবাদে বিশ্বাসী সাধক কখনও কোন অসৎ বা অশুভ কর্মে রত হতে পারে না৷
জড়বাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে বিপ্রপত্তির ওপর৷ তাই জড়বাদে কেবল দুঃখ আর দুঃখ৷ তাই যে মানুষ জড়বাদে বিশ্বাসী তাকে বিশ্বাস করা দায়৷ প্রপত্তিবাদীর স্পষ্ট বক্তব্য হ’ল–
‘মন–গরীবের কী দোষ আছে,
তুমি জাদুগরের মেয়ে শ্যামা,
যেমন নাচাও তেমনি নাচে৷’
যারা পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পেরেছে কেবল তারাই প্রপত্তিবাদ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারে৷ চিন্তায় আচরণে–কর্মে–মানুষ হতে হবে পরিচ্ছন্ন–স্বভাবের যা সে বলবে বা করবে, তা সে পষ্টাপষ্টিই বলবে বা করবে৷ জীবনের কোন ক্ষেত্রে তার কোন ভেতর–বার থাকবে না৷ জীবনের ধারা যদিও সংকোচ–বিকাশী কিন্তু মানুষকে জীবনে হতে হবে সহজ সরল৷ সত্তাবিশেষের গতি যদিও সংকোচ–বিকাশী কিন্তু সেই গতিশীল সত্তাকে সহজ–সরল হতে হবে৷
‘নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ৷
যো নস্তদ্বেদ তদ্বেদ নো ন বেদেতি বেদ চ৷’
আমি বলছি না, আমি সেই পরম সত্তাকে জানি৷ আবার এও বলছি না যে আমি পরম সত্তাকে জানি না, কারণ সেই পরম সত্তা হলেন জানা–জানার বাইরেকার তত্ত্ব৷ প্রপত্তিবাদের গোড়ার কথা হচ্ছে–‘আমি আছি, তুমিও আছ আর তুমি আমারই’, আর প্রপত্তিবাদের শেষ কথা হচ্ছে, ‘তুমি আছ প্রভু, কেবল তুমিই আছ’৷
‘আমি আছি’ না থাকলে প্রপত্তিবাদের শুরুই হয় না৷ তাই গোড়ার দিকে প্রপত্তিবাদকে থাকতে হলে ‘অহং অস্মি’ অর্থাৎ ‘আমি আছি’–কে মেনে নিতেই হবে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকছে ‘ত্বম্ অসি’, ‘ত্বং হি’ অর্থাৎ ‘তুমি আছ’, হ্যাঁ কেবল ‘তুমিই আছ’৷ (পটনা, ১১ই অগাষ্ট, ১৯৭৮)