মানসপট আর মনের ময়লা
নির্গুণ ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই৷ তিনি নিরাকার৷ এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্মরূপে (যা নির্গুণ ব্রহ্মের কার্যান্বিত রূপ), প্রকৃতির সহায়তায় ব্রহ্মভাবের জন্ম দেন, সেই সগুণ ব্রহ্ম প্রতিটি ধূলিকণায় ব্যাপ্ত আছেন৷ আমার মানসপটের ওপর ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়া পড়ছে, আর এই প্রতিচ্ছায়া কিরকম ভালভাবে পড়বে তা নির্ভর করে আমারই সংস্কারের ওপর৷ মানসপট যত ময়লাযুক্ত হবে, তার ওপর ততখানিই খারাপ প্রতিফলন পড়বে৷ সাধনার দ্বারা আমরা মনের এই ময়লাকে পরিষ্কার করি৷
আমাদের শরীরে আছে লাখ লাখ অগুনতি কোষ (cells)৷ প্রতিটি মুহূর্তে এই শরীরে অণুকোষগুলি বিভাজিত হয়ে চলেছে, আর জন্ম হচ্ছে নোতুন কোষের৷ এদের মরে যাওয়া আর উৎপন্ন হওয়া প্রকৃতির নিয়ম৷ আমার মনে ক্রোধ এসে গেছে৷ সে সময় প্রকৃতি নিজে থেকেই সেইরকম অণুকোষেরই জন্ম দেবে যা আমার এই ক্রোধেচ্ছাকে পূর্ণ করবে৷ যখন আমার এই মন ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়া থেকে উৎসারিত জ্যোতিকে দেখতে পাবে তখনই আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাবে, আর আমার আত্মা এই বিশ্ব চরাচরে সব জীবকে নিজের মধ্যেই দেখতে পাবে৷
প্রকৃতির ৰন্ধন
‘‘আমি–ই তিনি’’৷ আমি–ৰোধ সেই ব্রহ্ম তথা পরমাত্মার প্রতিচ্ছায়ার সঙ্গে আমাকে সম্বন্বিত করে, আর ‘‘আমি–ই তিনি’’ সম্বন্বিত করে পরমাত্মাকে৷ আমার শরীরে আছে লাখ লাখ অণুকণা৷ এই কণাগুলির মধ্যেও তো প্রতিচ্ছায়া আছে, আছে পরমাত্মার জ্যোতি৷ কিন্তু সেই জ্যোতি সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান হতে পারে না৷ কেননা তাতে আছে প্রকৃতির ৰন্ধন, তাই তাতে চেতনা নেই৷ মানুষের মধ্যে আছে চৈতন্যৰোধ৷ এইজন্যেই সে বলতে পারে ‘‘আমিই–ই তিনি’’৷
এই ব্যাপারে আমার মূল বক্তব্যটা হচ্ছে যে মানুষ সবকিছু করতে পারে৷ সে সবচেয়ে মহান কর্ম যা পরমাত্মার প্রাপ্তি, তা করতে পারে৷ আর তা করতে পারে নিজের মধ্যে যে শক্তি আছে, তার দ্বারা৷ এতে কেউ জ্ঞানী হোক–না–হোক কিন্তু সে তার জন্যে পরমাত্মাকে পাবে না, তা কখনই হতে পারে না৷ ধর, কেউ অসুস্থ আছে, যে জন্যে সে বেশী পরিশ্রম করতে পারবে না৷ কিন্তু কর্ম না থাকার জন্যে সে পরমাত্মাকে পাবে না–এ কোনো কথা নয়৷ তোমরা ব্যষ্টিগত জীবনে এরকম থাকবে৷ ধর, তোমার এক ছেলে, সে বেচারা লেখাপড়া শেখেনি৷ তার স্বাস্থ্যও সেরকম কিছু ভালো নয়৷ এরজন্যে কি তুমি সেই ছেলেকে ভালবাসবে না? ঠিক তেমনি যার জ্ঞান নেই অথবা স্বাস্থ্যও ঠিক নয় সেও পরমাত্মাকে পেয়ে যাবে৷ পরমাত্মার প্রতি প্রেম–ভালবাসা থাকলেই সেটা জ্ঞানপ্রাপ্তি হয়ে গেল৷ তোমরা একথা সবসময় মনে রাখবে যেখানে ভক্তি আছে সেখানে সবকিছু আছে, আর যেখানে ভক্তি নেই সেখানে কিছুই নেই৷ ধর, তোমার কোনো ছেলে অনেক লেখাপড়া করেছে, অনেক পরিশ্রমীও বটে কিন্তু তোমার প্রতি ভালবাসা নেই৷ সে অবস্থায় তুমি কি করবে? তাকে অপচ্ছন্দ করবে কিনা? তাহলে কী হবে? সে লেখাপড়া শিখে যেন এক তরবারির মত তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে৷ এইটুকুই তো তোমরা বলবে? এই কথা স্মরণে রাখবে যে পরমাত্মার প্রতি যার মধ্যে ভক্তি আছে, তার মধ্যে সবকিছু আছে, সে সবকিছু পেয়ে যাবে৷
একটা কথা মনে রাখবে, আবার দু’টো আনুষঙ্গিক কথাও মনে রাখবে৷ কখনও কোনো প্রকারের অন্যায়, কোনো প্রকারের পাপ, কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করবে না৷ যে কেউ হোক–না–কেন, পতি–পুত্র বা অন্য কারোরই অন্যায়কে সমর্থন করবে না৷ এটা হ’ল একটা কথা৷ দ্বিতীয় কথাটা হ’ল খাবার–শোবার বা স্নান করবারও সময় যদি না পাওয়া যায় কিন্তু দু’বেলার সাধনা ঠিক হতে হবে৷ তোমরা এটা ৰুঝে গেলে? সাধনা করা অতি আবশ্যক৷ কখনো চব্বিশ ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত আছো, তার মধ্যে অল্প কিছু সময় পেয়ে গেলে, একটু অবসর পেয়ে গেলে, সেই সময় কী করবে? প্রথমে সাধনা, তারপর আরো একটু সময় পেয়ে গেলে, কী করবে? স্নান–সাধনা তো করেই নেবে আর যতটুকু অতিরিক্ত সময় পেয়েছো তার মধ্যেই একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে৷ বিশ্রাম নিলে মানুষ অধিকতর পরিশ্রম করতে পারবে, না হলে অধিক কাজ করতে করতে ক্লান্তি এসে যাবে৷ তাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলে বেশী পরিশ্রম করতে পারবে৷ তা এরও অতিরিক্ত সময় পেয়ে গেলে তো বিশ্রাম, স্নান–সাধনা এ সবতো করবেই, কিছু খেয়েও নেবে৷ অর্থাৎ খাবার থাকল অনেক পিছনে৷ এইভাবে তোমরা চলবে, তাহলে তোমাদের জয়জয়কার হয়ে যাবে৷ তোমাদের কল্যাণ হোক৷
২৫ জুন ১৯৬৬, চেন্নাই
(মহিলাদের মধ্যে দেওয়া প্রবচনের সারসংক্ষেপ)