জমিদারী প্রথার বেশ কয়েকটি ত্রুটিই এই প্রথার অত্যধিক সমালোচিত হওয়ার কারণ৷ প্রথমতঃ, চাষীরা যে জমি চাষ করতো সেই জমির ওপর তার কোন অধিকার ছিল না, ছিল কেবল চাষ করার অধিকার৷ দ্বিতীয়তঃ, জমিদাররা বিশাল পরিমাণ জমি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে রেখে দিত৷ তৃতীয়তঃ, জমিদাররা যে খাজনা আদায় করতো তার অনেক কম সরকারের কাছে জমা করতো৷
জমিদারী প্রথা বিলোপের ফলে এই সমস্ত ত্রুটি জনিত ক্ষতি যে দূরীভূত হয়েছে তা নয়, বরং সরকারী খাজনা আদায় দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ প্রাউট যদিও জমিদারী প্রথা সমর্থন করে না, প্রাউটের মতানুসারে ভারতের মত পশ্চাদপদ দেশে প্রথমেই জমিদারী প্রথা বিলোপ না করে’ ব্যাঙ্কে জমিদারদের গচ্ছিত টাকার উর্দ্ধসীমা নির্দ্ধারণ করে’ অতি সঞ্চিত অংশ বাজেয়াপ্ত করে’ প্রগ্রহ শিল্পে বিনিয়োগ করা উচিত ছিল৷
এই সম্পর্কিত একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ণ হচ্ছে জমির উর্দ্ধসীমা ও ব্যাঙ্কে সঞ্চিত সম্পদের উর্দ্ধসীমা দুটোই কি চালু করতে হবে৷ বলা বাহুল্য যে, দুটোই চালু করতে হবে৷ কিন্তু জমির ঊর্দ্ধসীমা ঠিক করার আগে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সম্পদের ঊর্দ্ধসীমা নির্দ্ধারণ করতে হবে৷ এর ফলে সঙ্গে সঙ্গে সরকারের হাতে কিছু সম্পদ চলে আসবে, আর তা দিয়ে একদিকে যেমন নোতুন নোতুন শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে পুঁজিবাদের আগ্রাসন প্রতিহত করা যাবে৷ জমির উর্দ্ধসীমা নির্দ্ধারণ করলেও যেহেতু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বা উৎপাদন বাড়বে না সেহেতু জাতীয় প্রত্যক্ষ লাভ কিছু হবে না৷ উর্দ্ধসীমা নির্দ্ধারণ করার ফলে যে অতিরিক্ত জমি পাওয়া যাবে সেই জমিতে চাষ করাও সরকারের কাজ হতে পারে না৷ এই ধরনের ব্যবস্থা জনগণের ভাবাবেগকে আহত করবে, আর জনসাধারণ ভাববে জমিদারী প্রথা বিলোপ করে’ সরকারই জমিদার হয়েছে৷ খাদ্যাভাব দেখা দিলেও তৎক্ষণাৎ জমি সংক্রান্ত নীতির পরিবর্ত্তন করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না৷
পণপ্রথা
সামাজিক অবিচারের আর একটা জাজ্বল্যমান উদাহরণ পণপ্রথা৷ সভ্য সমাজে এ সত্যিই এক লজ্জার বিষয়৷ এই অবিচারের কারণ খোঁজার উদ্দেশ্যে আমরা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলেই এর পেছনের দু’টি কারণ স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হবে৷
প্রথমতঃ, যেখানে পুরুষ ও নারীর মধ্যে আয়ের সমতা থাকে না সেখানেই পণপ্রথা এসে যায়৷ কেরলের নায়ার ও ইড়াবা সম্প্রদায় মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে চলে, সেজন্যে পুরুষেরা কোন পণ দাবী করে না৷ অসমের খাসিয়ারাও মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে চলে৷ বার্মায় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে চললেও যেহেতু নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রয়েছে সেহেতু তারাই পণ পেয়ে থাকে৷
দ্বিতীয়তঃ, যেখানে নারী পুরুষের সংখ্যার অনুপাতে বৈষম্য দেখা দেয় সেখানে পণপ্রথা চালু হয়ে যায়৷ যদি পুরুষের সংখ্যাধিক্য হয় তাহলে নারীরা পণ পায়, আর উল্টোটা হলে অর্থাৎ নারীদের সংখ্যা বেশী হলে পুরুষেরা পণ পায়৷ পঞ্জাবে যেহেতু নারীদের থেকে পুরুষের সংখ্যা বেশী সেহেতু নারীরা পণ পায়৷ মুসলমানদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা৷
আভিজাত্যের মেকী অহঙ্কারও পণপ্রথার কারণ৷ অভিজাত মানুষেরা মনে করে ‘আমাদের পরিবার উচ্চশ্রেণীর৷ সেজন্য আমাদের পণ প্রাপ্য৷’ প্রাউট ব্যবস্থায় কোন ধরনের পণপ্রথা থাকবে না৷
সম্পত্তির উত্তরাধিকার
প্রশ্ণ করা যেতে পারে যে, বাবার সম্পত্তি তার সন্তানদের মধ্যে কীভাবে বণ্টিত হবে? দায়ভাগ ব্যবস্থা যদি সর্বত্র প্রচলিত হয় তাহলে কন্যারা বিধবা হয়ে গেলেও যাতে অভাবগ্রস্ত না হয়ে পড়ে সেজন্যে তার ভাইদের সঙ্গে সমান অংশ পাওয়ার ব্যবস্থা করে’ তাদের অধিকার সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ যদিও কন্যারা তাদের জীবৎকালে সেই সম্পত্তি কেবল ভোগ দখল করতে পারবে, কিন্তু তাদের সেই সম্পত্তির মালিকানার অধিকার থাকা ঠিক হবে না৷ তার যদি কোন সন্তান না থাকে তবে তার মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি তার ভাইদের মধ্যে, অথবা ভাইদের সন্তানদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে৷
এই বিশ্ব আমাদের সকলের মিলিত পৈত্রিক সম্পত্তি৷ এই পৈত্রিক সম্পত্তি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রাউটিষ্টদেরই নিতে হবে, কেননা অন্যেরা স্বার্থপরতা বা দলবাজীর শিকার হতে পারে৷ ভোগের অধিকার আর তত্ত্বাবধানের অধিকার এক নয়৷ যেহেতু সমস্ত মানুষের মধ্যেই নেতৃত্বের গুণ থাকে না, যেহেতু সাধারণ মানুষ কেবল গড্ডালিকা প্রবাহে চলে’ থাকে, সেহেতু তত্ত্বাবধানের অধিকার নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন সামান্য কিছু মানুষেরই থাকা উচিত৷ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে ৰুদ্ধি ও ৰোধিতে সমুন্নত সামান্য কিছু মানুষেরই সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের অধিকার থাকা উচিত৷
আমাদের জাগতিক সম্পদ আমাদের সকলের সামূহিক পৈত্রিক সম্পত্তি৷ প্রত্যেকটি মানুষেরই এই সম্পত্তি ভোগ করার জন্মসিদ্ধ অধিকার আছে৷ যারা এর বিরোধিতা করে তারা কায়েমী স্বার্থের ধ্বজাধারী৷ এই ভূমা উত্তরাধিকারের বিরোধিতা বরদাস্ত করা হবে না৷ যদি কেউ তা করে তবে তার সেই মানসিক বিকৃতির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এই সুচিকিৎসাকেই ‘ধর্মযুদ্ধ’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে৷
ধান্দাবাজ শোষকরা জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে জাগতিক সম্পদ ভোগ করার যে মারাত্মক লালসা তৈরী করছে তার থেকে জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রতিটি সদবিপ্রের৷ এই সমস্ত ধান্দাবাজরা গণতন্ত্রের মুখোশ পরে’ তাদের নগ্ণ, বীভৎস উদ্দেশ্যকে আড়াল করার চেষ্টা করে৷ আসলে, গণতন্ত্র হচ্ছে গালভরা বুলির জাদুময় সোণায় মোরা পেতলের মুদ্রা৷
জাতীয়তাবাদের জয়গান গাওয়া এখন এ যুগের হাওয়া৷ বস্তুতঃ জাতীয়তাবাদও এক ধরনের মানসিক রোগ৷ পরম তত্ত্বেরই আছে চরম ব্যাপকতা৷ একজন ব্যষ্টির মানসিক দৃষ্টিকোণের ওপর তার মনের ব্যাপকতা নির্ভরশীল৷ এই মানসিক দৃষ্টিকোণ যতই ছোট হতে থাকে ততই সে নীচমনা হয়ে যায়৷ যারা মনে করে জাতীয়তাবাদের থেকে জাতিবাদ খারাপ তারা ভুল করে৷ ভারতে ৰ্রাহ্মণদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি আর মালয়ানদের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লক্ষ৷ তাহলে বলতে হয় মালয়ান জাতীয়তাবাদীদের থেকে ৰ্রাহ্মণদের জাতিবাদের দৃষ্টিকোণ বড়৷ আবার পার্সিদের সংখ্যা দেড় কোটি, অন্যদিকে অষ্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা ৭৫ লক্ষ৷ তাহলে মহাদেশবাদী অষ্ট্রেলিয়ার থেকে জাতীয়তাবাদী পার্সিদের দৃষ্টিকোণ বড় বলে’ মনে হতে পারে৷ আবার চীনের জাতীয়তাবাদী অপেক্ষা ভারতের জাতীয়তাবাদীরা বেশী নীচমনা ধরে’ নিতে হয়৷ সেই জন্যেই বিশ্বৈকতাবাদকে, ও একমাত্র বিশ্বৈকতাবাদকেই সমর্থন করতে হয়৷ আসলে বিশ্বৈকতাবাদ কোন বাদ ন্ব্দপ্পগ্গ নয়৷ কারণ বিশ্বৈকতাবাদের বাইরে আর কোন কিছুই নেই, আর এই বিশ্বৈকতাবাদ কোন গোষ্ঠী বিশেষ বা দল বিশেষের ধ্বজা ধরে না৷ বিশ্বৈকতাবাদের মানস প্রক্ষেপণে কোন নীচতার স্থান নেই৷ সমস্ত ধরনের ভৌতিক ও আধিদৈবিক রোগের একমাত্র মকরধ্বজ বিশ্বৈকতাবাদ৷ সেজন্যেই প্রাউটিষ্টরা অবশ্যই বিশ্বৈকতাবাদী৷