চারটি সামূহিক মনস্তত্ত্ব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

শূদ্র–মনস্তত্ত্ব

ব্যষ্টি মানসের তর৷ যেখানে জড়ের তরে৷র সে৷ তাল রেখে চলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাকে আত্মসাৎ করবার চেষ্টা করছে না, সে ক্ষেত্রে তার এই তাল রেখে চলবার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যষ্টি–মানসকেও জড়–ভাবাত্মক করে’ দেয়৷ জড়–ভাবের ভাবুক এই ব্যষ্টি–মানস–স্বভাবতঃই যাতে তমোগুণী অন্ধকার বেশী, তাকেই বলি শূদ্র৷ এদের দ্বারা কোনো কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, কারণ স্থূলতম তর৷ জড়তর৷ই এদি’কে নিয়ন্ত্রণ করে৷

ক্ষাত্র–মনস্তত্ত্ব

ব্যষ্টি–মানস যেখানে ভোগের দুর্দ্দান্ত কামনা নিয়ে ছুটে চলেছে, কিন্তু জড়ের সে গোলাম হতে চায় নি–জড়কে সে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে, জড়তর৷কে সে মানস তরে৷র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, সেই সতত যুধ্যমান ব্যষ্টি–মানসকেই বলা হয় ক্ষত্রিয়৷ তাই সংগ্রামই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম৷ দুর্দমনীয় প্রাণশক্তিতে উদ্বুদ্ধ ক্ষত্রিয় তাই অন্ধকারের, কৃষ্ণত্বের প্রতীক নয়, সে তেজস্বিতার প্রতিনিধি–রক্তবর্ণই তার বর্ণ৷

কালের তিনটি শাখা–ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান৷ এর মধ্যে ক্ষত্রিয়ের কাছে আছে অতীত ও বর্ত্তমান৷ ভবিষ্যৎ নিয়ে সে মথা ঘামায় না৷ আদর্শের প্রেরণায় ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই সে অগ্ণির লেলিহান শিখায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, উত্তু৷ পর্বত শিখর থেকে লাফিয়ে পড়ে, রকেটে করে’ গ্রহ–উপগ্রহের পিছনে ছুটে যায়৷ সে কেবল চায় জয় করতে, জয়ী হতে, বেঁচে থাকতে নয়৷ ক্ষত্রিয়ের কাছে অতীতও আছে৷ ঐতিহ্যকে সে ভুলতে চায় না৷ অতীতের প্রেরণাই তাকে ভবিষ্যৎ গতির দ্রুতি নির্দ্ধারণে সাহায্য করে৷ জনগোষ্ঠীর বা পূর্বপুরুষের বীরত্ব গাথা তাকে প্রেরণা যোগায়৷ পিতৃশত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে সে প্রবৃত্ত হয়৷ তাই অতীতের ছোট–বড় প্রতিটি জিনিস খতিয়ে না দেখে’ তার কর্মধারা নির্দ্ধারণ করা সম্ভব হয় না৷

ধর্মের প্রকৃত অর্থ যাই হোক না কেন, চিত্তের উদারতা থাকায়, সেই উদারতা ভিত্তিক একটা ধর্মাচরণ ক্ষত্রিয়ের থাকে৷ সে যেমন তার কল্পিত দেবতার কাছ থেকে চায় পু–*–কলত্র–বিত্ত–নাম–, সে তার রুদ্রের কাছে চায় প্রচণ্ডতা, চণ্ডশক্তির কাছে চায় নির্মমতা, ঠিক তেমনি বিশ্ব প্রকৃতির কাছে আকুতি জানিয়ে বলে, ‘‘রূপং দেহি জয়ং দেহি যশোদেহি দিশো জহি৷’’ সে তার কল্পিত দেবতার কাছ থেকে যা চায় তা কেবল নিজের জন্যে চায় না, নিজে পেয়ে নিজের আশ্রিতদের মধ্যে তা বণ্ঢন করে’ দিতে চায়৷ কিন্তু বণ্ঢনের অধিকারটা নিজের হাতে রাখতে চায়৷ বস্তুতঃ ক্ষত্রিয়ের যে ধার্মিকতা তা জড়াতীত কোন কিছু নয়, অর্থাৎ তার ধার্মিকতা জড়কে প্রাপ্তির বা জড়কে জয় করবার প্রয়াসেই সীমিত৷ আর আধ্যাত্মিকতা বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ আত্মিক প্রগতি–সেটা তার বুদ্ধিতে সহজে ধরা পড়ে না৷ আত্মিক সাধনের সংঘর্ষের জন্যে যে উচ্চমানের প্রয়োজন অতিরিক্ত মনশ্চাঞ্চল্যের জন্যে অধিকাংশ ক্ষত্রিয়ের মধ্যেই তার কিছুটা অভাব থাকে৷

বিপ্র–মনস্তত্ত্ব

আদর্শগত সংঘর্ষে ক্ষত্রিয়রা নিজেদের মর্যাদাকেই বড় করে’ দেখেন৷ আর এই মর্যাদাকে বড় করে’ দেখতে গিয়ে তাদের মনে যে ভাবগত সংঘর্ষ উৎপন্ন হয় সেই সংঘর্ষই একদিন সমাজে বিপ্রের আগমন বার্ত্তা ঘোষণা করে৷ সমাজ–চক্রে বিপ্রের উৎপত্তির প্রধান কারণ ক্ষত্রিয় সমাজের ভাব–সংঘাত৷

 

ক্ষত্রিয়ের মত বিপ্রও সতত যুধ্যমান, তবে তার যুদ্ধ বৌদ্ধিক রণা৷ণে সীমিত থেকে যায়৷ বিপ্র তাই বুদ্ধিজীবি৷ এই বৌদ্ধিক বিকাশ কেবল যে জড়–সম্পদ আহরণেই ব্যস্ত থাকে তা নয়, সূক্ষ্ম মানসসম্পদ আহরণের যোগ্যতাও তাই তারই সব চাইতে বেশী থাকে৷ বৌদ্ধিক উপকার তথা বোধিচিকীর্ষা তাকে অগ্র্যাবুদ্ধির জাগরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে৷ অগ্র্যাবুদ্ধির উদ্বোধন, তথা সেই বৌদ্ধিক গতিধারা সূক্ষ্মত্বের চরম ভাবটুকুকে প্রায় ছুঁয়ে চলে, আর তাই তার গতি সরলরেখাকারঙ্গ সে গতিতে দ্রুতি আছে, সর্বানুসূ্যত ভাব আছে, সর্ববর্ণের সমাবেশ আছে, তাই বিপ্র শুভ্রত্বের প্রতীক–সে শ্বেতবর্ণ৷

মানুষ জাতিকে শ্রম দিয়ে গড়ে শূদ্র, পৌরুষ দিয়ে গড়ে ক্ষত্রিয় আর তাদের প্রলোভন দেখিয়ে’ তাদের কাছ থেকে শ্রম আদায় করে’ নেয়, পৌরুষ কিনে নেয় বিপ্র৷ সে বুদ্ধির সাহায্যে শত্রু জয়ের থিয়োরী তৈরী করে’ দেয়, ক্ষত্রিয় আর শূদ্ররা সেই থিয়োরীকে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে কার্যান্বিত করে’ দেয়, আর ক্ষত্রিয়–শূদ্রের মৃতদেহের ওপর দিয়ে বিপ্র এগিয়ে যায়, দুনিয়াকে জানায়–ওগো আমি এইভাবে গড়েছি, এইভাবে জয় লাভ করেছি৷ বিপ্রের এই ধরণের পরস্মৈপদী সংগ্রামের দৃষ্টান্ত ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে৷ ক্ষত্রিয় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দ্বরা জড়কে নিজের দাসে পরিণত করতে চায়, আর বিপ্র বৌদ্ধিক সংগ্রামের দ্বারা জড়–জয়ী ক্ষত্রিয়কে নিজের দাস করে’ রাখতে চায়৷ ক্ষত্রিয় কেবল জড়–ভোগেই সুখ চায়৷ কিন্তু বিপ্রের কিছুটা মানস–ভোগও রয়েছে, তা সে যত নগণ্য, যত তুচ্ছই হোক না কেন৷

বৈশ্য–মনস্তত্ত্ব

বৈশ্য তার ভোগ্যবস্তু জড়কে নিজের কাছে টেনে আনে অন্যের জড়শক্তির মাধ্যমে, অথবা সোজাসুজি ভাব–সংঘাতের মাধ্যমে, অথবা সুবিধামত কোথাও জড়–সংঘাত ও কোথাও ভাব–সংঘাতের দ্বারা, বা যুগপৎ উভয়বিধ সংঘাতের দ্বারা৷ সে যে অধিক পরিমাণ ভোগ্যবস্তু করায়ত্ত করতে চায়, তার এই উদ্দেশ্যে কোন প্রচ্ছন্নতা নেই৷  বৈশ্যও যুধ্যমান, তবে তার যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের মত তো নয়ই, বিপ্রের মতও নয়৷ তার সংগ্রামটা বৌদ্ধিক, কিন্তু সে বুদ্ধি কেবল অর্থোপার্জনের কাজেই নিয়োজিত৷ বৈশ্য–বুদ্ধি অর্থলিপ্সার চশমা পরে’ পৃথিবীকে দেখে৷ দুনিয়ার কোন কিছুকেই পূর্ণভাবে বা ঠিকভাবে বোঝবার সামর্থ্য তার নেই৷ তার চশমায় প্রতিটি বস্তুর অর্থকরী রূপটুকু ব্যতিরেকে আর কোন কিছুই দেখা যায় না৷ স্রেফ বৌদ্ধিক সংঘর্ষ যদি বিপ্রে–বৈশ্যে হয় তাতে বিপ্রের জয় হবে, কিন্তু সংগ্রাম যদি কেবল অর্থকরী বৃত্তিতে সীমিত থাকে সে সংগ্রামে বৈশ্যের জয় হবে–বিপ্রের মগজ তার সিন্দুকে বাঁধা পড়বে৷ অর্থকরী বুদ্ধির গতি অত্যন্ত কুটিলা৷ সে গতিতে প্রয়াসের প্রাখর্য আছে, কিন্তু বিষয়ের জড়ত্ব নিবন্ধন তা সরল হতে পারে না, তাই তা বক্র–অত্যন্ত বক্র৷ প্রয়াসের প্রাখর্যে সে রজোগুণী, আর বিষয়ের জড়ত্বে সে তমোগুণী, তাই সে রজস্তমঃ–পীতবর্ণের প্রতীক৷

শূদ্রের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, ক্ষত্রিয়ের পৌরুষ, আর বিপ্রের বুদ্ধিকে নিজের আর্থিক পুঁজির সাহায্যে যথেচ্ছভাবে কাজে লাগিয়ে বৈশ্য তার মূলধনের অঙ্ক ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে তোলে৷ শূদ্র গ্রাসাচ্ছাদনের বিনিময়ে কায়িক শ্রম বেচে দেয়৷ শ্রম সে বেচে বলেই সমাজ বেঁচে থাকে ও এগিয়ে যায়৷ ক্ষত্রিয়ের পৌরুষ সমাজের কাঠামোটাকে গড়ে, ও তাকে দাঁড় করিয়ে রাখে শূদ্রের কাছ থেকে শ্রম আদায় করে’ নিয়ে৷ ক্ষত্রিয়ের পৌরুষকে বিপ্র কাজে লাগায় নিজের বুদ্ধিবলের সাহায্যে, আর বৈশ্য বিপ্রের বুদ্ধিকে নিজের পুঁজি বাড়াবার কাজে লাগায় পুঁজি ও পুঁজিবাদী বুদ্ধির সাহায্যে৷