দ্বন্দ্বাত্মক ভৌতিকতাবাদ ও গণতন্ত্র

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

নৈতিকতা ঃ গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্যে নৈতিকতা দ্বিতীয় মূল উপাদান৷ নীতির অভাবে লোকে বোট বিক্রী করে৷ পৃথিবীতে এমন কতকগুলি দেশ আছে যেখানে বোট কেনাবেচা হয়৷ আমরা কি একে গণতন্ত্র ৰলতে পারি? এটা কি প্রহসন নয়? তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত জনসংখ্যার শতকরা একান্ন জন লোক নৈতিক অনুশাসনকে কঠোরভাবে না মানছে ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্রের সাফল্য অসম্ভব যেখানে দুর্নীতিপরায়ণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকৰে সেখানে তাদের মধ্যে থেকেই অবশ্যম্ভাবীরূপে নেতা নির্বাচিত হৰে৷

বর্তমান যুগে নৈতিকতার ৰাধাস্বরূপ প্রচুর বিষয় রয়েছে৷ নাগরিক সভ্যতা নৈতিক অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ৷ নাগরিক সভ্যতার যুগে বহুসংখ্যক লোক অবাঞ্ছিত রূপে ক্ষুদ্র জায়গায় বাস করতে ৰাধ্য হয় যা ব্যষ্টিগত জীবনে নৈতিকতার ঘোর শত্রু৷ কোন ব্যষ্টির নৈতিক বিকাশের জন্যে কিছুকাল তার নিভৃত জীবন যাপন করা একান্ত আবশ্যক৷ যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অধিক সেখানে দুধ, শাকসব্জী কম পরিমাণে পাওয়া যায়৷ কিন্তু এগুলি জীবনধারণের পক্ষে অত্যাবশ্যক৷ তাই প্রয়োজনের তুলনায় যোগান কম হওয়াতে ভেজাল চলতে থাকে৷ দুধের প্রয়োজন মেটাৰার জন্যে লোকে দুধে জল মেশায়, হীরার প্রয়োজন মেটাবার জন্য নকল হীরা বের হয়, কেননা যোগান কম ও চাহিদা ৰেশী৷ সমাজবিরোধী ব্যষ্টিদের জন্যে শহর দুর্নীতির আড্ডাখানা হয়ে পড়ে কিন্তু সাধারণতঃ গ্রামে এগুলি দেখা যায় না৷ গ্রামে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচিত৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবিকা সম্বন্ধে অবহিত৷ শহরে কুড়ি বছর বাস করার পরও লোকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হয় না৷ জানতেও পারে না হয়তো তাদের মধ্যে অনেক পাক্কা জোচ্চোর লুকিয়ে আছে৷ এই কারণে আমাদের নাগরিক জীবনের বর্বরতা থেকে সরে থাকতে হবে৷ ‘গ্রামে ফিরে যাও’ এই ধরণের শ্লোগান তুললেই শুধু হৰে না৷ সাধারণের কাছে শহরের জীবনধারার একটা তীব্র আকর্ষণ আছে৷ জনগণ জীবিকা নির্বাহের জন্যে শহরের দিকে ছুটে আসছে৷ এই কারণে ৰুদ্ধিজীবী মানুষের জন্যে গ্রামে গ্রামে জীবিকার ব্যবস্থা করতে হৰে৷ গ্রামে সস্তায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও কুটির শিল্পের প্রসার আজকের দিনে সবচেয়ে ৰেশী দরকার৷ কুটিরশিল্প ৰলতে আমি পুরানো ও বিকৃত ধরণের শিল্প ৰোঝাচ্ছি না৷ এগুলো ভালভাবে আধুনিক যন্ত্র দ্বারা নির্মিত হতে হৰে৷ এজন্যে বিকেন্দ্রীকরণ অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যাবশ্যক৷ ভারী শিল্প ও খুব জরুরী সরকারী অফিস বাদ দিয়ে অন্যান্য সৰ কিছুই গ্রামে গ্রামে স্থানান্তরিত করতে হৰে৷ শহরের জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি ৰন্ধ করতে গেলে এটাই একমাত্র কার্যকরী উপায়৷ শহরের ঘেঁসাঘেঁসি সেখানে জীবন না থাকায় সমাজবিরোধী ব্যষ্টিরা কিছুই লুকোতে পারৰে না ও পুলিশ তাদের সহজেই ধরে ফেলতে পারৰে৷

গণতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় অনৈতিকতা একটি মস্ত ৰড় প্রশ্ণ---যাকে কোনভাবেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না৷ প্রবাদ আছে যে, ভূতে ধরা কোন মানুষের ওপর যদি সরষে ছিঁটানো যায় তবে ভূত নাকি ভেগে যায়, কিন্তু যদি সরষের ভেতরেই ভূত ঢুকে বসে থাকে তবে আর কোনমতেই ভূতের হাত থেকে রেহাই পাবার উপায় নেই৷ ঠিক সেইরকম অনৈতিকতার ভূত আজকের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে৷ প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ প্রভৃতি নৈতিকতাবর্জিত কাজকর্ম গণতন্ত্রের প্রশ্রয় পাচ্ছে৷ মনে করা যাক কোন একটি নির্বাচন কেন্দ্রে A হ’ল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত ও B, C,  D তরফের প্রতিনিধিদের পূর্ণ যোগ্যতা রয়েছে৷ এই অবস্থায় নির্বাচনে জিতবার জন্যে A সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিটি জাতিভেদ ও সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবেকে উস্কিয়ে তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করৰেই৷ এই ধরণের সমাজ বিরোধী ক্রিয়াকলাপ গণমনকে সন্দিগ্দ করে তোলে ও জনগণের নৈতিকতার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী বিভেদ্যত্মক চিন্তাবাবনা ও তাদের ভ্রান্ত মতবাদগুলি প্রচার করবার দিব্যি সুযোগ পায়৷ তাই দেখছি, নৈতিকতা, যা নাকি গণতন্ত্রের সার্থক জয়যাত্রার একটি মৌলিক বিষয়, সেটাই অরক্ষিত হয়ে আছে৷

কিছু লোক জাতিভেকে প্রশ্রয় দেৰে ও তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করৰে৷ রাজনৈতিক দলগুলিও একমাত্র সেই ব্যষ্টিদেরই প্রতিনিধি নির্বাচিত করৰে যারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত৷ জন-সাধারণ অশিক্ষিত ৰলে তাদের চালাকি ৰুঝতে পারে না৷

তৃতীয়তঃ গণতন্ত্রকে সফল করে তুলবার পক্ষে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা থাকাও খুব প্রয়োজন৷

শিক্ষিত লোকেরাও ধূর্ত ও সুচতুর রাজনীতিকদের দ্বারা চালিত হতে পারেন যদি না তাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকেন৷ গণতন্ত্র কেবল তখনই সফল হতে পারে যখন উপরিলিখিত প্রধান তিনটি চেতনা জনগণের মধ্যে থাকৰে৷ এই চেতনাগুলি ভিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের কল্যাণ-সাধন করা কখনও সম্ভব নয়৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ধরণের চিন্তা শুধু তত্ত্বের দিক থেকেই সম্ভব, বাস্তবে তার রূপায়ণ অসম্ভব৷ ও ৰুদ্ধিজীবীরা তাই এই ধরণের বাস্তব মূল্যহীন একটি চিন্তাকে কখনও প্রশ্রয় দেৰে না৷ তবে দেখছি, সমাজের প্রকৃত কল্যাণসাধন না দ্বন্দ্বাত্মক ভৌতিকতাবাদ, না গণতন্ত্র---এর কোনটির দ্বারাই সম্ভব নয়৷ একমাত্র জ্ঞানদীপ্ত প্রজাহিতৈষী একনায়কতন্ত্র অথবা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাদীপ্ত একনায়কতন্ত্রই সমাধানের পথ৷

যারা নীতিবান তারা সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই৷ সমাজ যদি ৰুদ্ধি ও ৰোধিদীপ্ত ব্যষ্টিগণের দ্বারা পরিচালিত হয় তবে সেখানে শোষণ ও অন্যায়ের কোন স্থান থাকৰে না৷ এখন একটি প্রশ্ণ হয়ত হতে পারে যে, একটি জাতি কিংবা একটি দেশ যেখানে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র মানুষেরই মানবিক অধিকার আছে সেখানে তবে বিশেষ একজন মানুষ কেন বোটদানের অধিকার লাভ করতে আর অবশিষ্টদের তা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হৰে৷ তা ছাড়া এ কথাও ঠিক যে এই জগৎটা সকলেরই পৈতৃকভূমি৷ এই পৃথিবীর সমস্ত প্রকার আধিভৌতিক, আধিদৈবিক আধ্যাত্মিক সম্পদগুলিকে ভোগ করবার ও ব্যবহার করবার অধিকার ত্থানুষ মাত্রেরই আছে৷ কিন্তু ভোগের অধিকার থাকলেও দেশ পরিচালনা ব্যবস্থাপনার অধিকার, তাই ৰলে সকলকার থাকতে পারে না৷ জনগণের কল্যাণও মঙ্গলের জন্যেই শাসনভারকে সৰার হাতে ছেড়ে দেওয়াটা উচিত হৰে না৷ কোন এক দম্পতির পাঁচটি সন্তান রয়েছে৷ প্রত্যেকেই তারা নিজেদের সংসারের সুখ ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে৷ কিন্তু তারা যদি সংখ্যাধিক্যের  অজুহাতে হঠাৎ দাবি করে বসে যে এই সংসারের দেখাশোনা ও সমস্ত ক্ষমতা তাদেরই হস্তান্তরিত করে দিতে হৰে, তবে সেটা কি সম্ভব? তারা একটি মিটিং আহ্বান করলে ও তাতে একটি প্রস্তাবও পাশ করলে---প্রস্তাবটা হ’ল বাড়ীর সমস্ত গ্লাস ও বাসনগুলিকে ভেঙ্গে ফেলা উচিত৷ এই ধরণের প্রস্তাবকে বিজ্ঞোচিত ৰলা চলে কি? আর একটা উপমা দিই৷ ছাত্রেরা সব সময়েই শিক্ষকদের তুলনায় সংখ্যায় অধিক থাকে৷ এখন তারা যদি সংখ্যাধিক্যের অজুহাতে দাবি করে যে, তারা নিজেরাই হৰে নিজেদের প্রশ্ণপত্র তৈরী-কর্তা ও পরীক্ষক, তবে সে দাবিটিও মেনে নেওয়া কি সম্ভব? তাই বলছি, গণতন্ত্র খুব একটা ভাল ও সরল পথ নয়৷ কিন্তু যতদিন না দ্বিতীয় কোন অধিকতর ভাল ও সমর্থনযোগ্য তত্ত্বকে আমরা বের করতে পারছি ততদিন অন্যান্যদের তুলনায় গণতন্ত্রকেই মন্দের ভাল ওলৰ ও এই সময়ের জন্যে আমরা গণতন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারি৷