দেশপ্রেমিকের প্রতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কিন্তু নেতারা কি তা করতে পারবে বা করতে চাইবে? যদি তারা এমনটি করতে পারে তাহলে খুব ভাল৷  তবে বর্তমানে অধিকাংশ নেতাই মুখে যত বড় লম্বা-চওড়া বুলি বলুক না কেন, আসলে তারা পঁুজিবাদী অথবা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে পঁুজিবাদেরই দালালি করে চলেছে৷ জনসাধারণ ক্রমশই ঃ তাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে৷ যাই হোক, বর্তমান নেতারা শোষণ বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে---  এ ধরণের ভরসা আমরা ঠিক করে উঠতে পারছি না৷ তারা এই মজবুত সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে একতাবদ্ধ করবার চেষ্টা করবে না৷

তারা হয়তো শাসনযন্ত্রের দাপট খাটিয়ে জোর করে মানুষকে সংঘবদ্ধ করবার চেষ্টা করবে৷ কিন্তু তা’ কি সম্ভব!বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের স্থানীয় বৈচিত্র্যগুলি শাসনযন্ত্রের ষ্টীমরোলোর চালিয়ে গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করা যাবে না আর সেই ধরণের ঐক্য কাম্যও নয়৷ ষ্টীমরোলার যত বেশী চালানো হবে, জনসাধারণের অসন্তোষও তত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে৷ জোর করে কোন কিছু করতে গেলে ভারতের অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে বল্কান রাষ্ট্রগুলির মত৷ সারা ভারতবর্ষে ছোট-বড় অগুণতি বিবদমান রাজ্য তৈরী হবে৷ তাই মনে হয় ভারতবর্ষের কল্যাণের জন্যে বর্তমান নেতৃত্বের অবসর গ্রহণ অত্যাবশ্যক৷ হ্যাঁ,  আরো একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন মনে করছি৷ যাঁরা মনে করেন সর্র্বেদয় বা ভূদান আন্দোলন ও শোষণ-বিরোধী সংগ্রাম তাঁরা ভুল করেন বরং ওই জাতীয় আন্দোলন শোষণ-বিরোধী সংগ্রামকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়৷ ওই ধরণের আন্দোলনে শুধু পঁুজিবাদীদের সুবিধা, কারণ তাতে জনগণের সংগ্রামী মনোভাবকে কৌশলে দাবিয়ে রাখা হয়৷

রাজনীতি আমার ব্যবসা নয়, পেশাও নয়৷ আমি ইতিহাসের এক সাধারণ ছাত্র মাত্র৷  ভারতবর্ষের যে ভয়াবহ চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে মুখ ফুটে তা প্রকাশ করা আমার কর্ত্তব্য বলে মনে করছি, যাতে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকরা আমাকে দোষ না দেন৷ যাঁরা দেশনেতা এ ব্যাপারে তাঁদের দায়িত্ব সর্র্বধিক৷ তাঁরা দেশকে ডোবাতেও পারেন,বাঁচাতেও পারেন৷ মুখে যাই বলা হোক না কেন, আসলে সরকারী বা বেসরকারী, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সকল সংস্থারই নীতি নির্র্ধরণ করে থাকেন মুষ্টিমেয় দু’চার জন৷ তাঁরাই সেই সংস্থার নেতা৷

বর্তমানে যাঁরা নেতা তাঁদের ভারতবর্ষকে বাঁচাবার জন্যে, ভারতবর্ষকে একটি মজবুত নেশন বা নেশন গোষ্ঠীতে পরিণত করবার জন্যে অবিলম্বে একটা বলিষ্ঠ নীতি প্রণয়ন করতে হবে৷ এ ব্যাপারে কোন টাল বাহানা বা কোন কথার মারপ্যাঁচের ফল দেশের স্বার্থের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক হবে৷

 

নেতারা হয়তো ভাবতে পারেন যে তাঁদের পার্টিগুলোতে(পার্টিগুলির ভেতরকার খবর আমার জানা নেই, তবে সম্ভবত সব পার্টিরই একই অবস্থা)  এত বেশী পাপীর ভীড় জমেছে যে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে গেলে পার্টির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে৷ পার্টির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে হোক৷ পার্টির স্বার্থের চেয়ে দেশে স্বার্থ অনেক বড়৷ তাছাড়া যেসব নেতার সত্যিকারের জনপ্রিয়তা  আছে তাঁরা নিজেদের জনপ্রিয়তার জোরে সৎ ব্যষ্টিদের নিয়ে নূতন পার্টি গড়ে তুলবেন৷

জননেতারা যদি তা না করেন তবে আমার ভয়, হয়তো বা তাহলে যে কোন সময়ে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ও ভৌগোলিকখন্ডতা দারুণ ভাবে বিপর্যস্ত হবে৷  বিশেষ করে ভারতবর্ষের  অভ্যন্তরেই দেশ  বিভাজনের প্রবণতা অত্যন্ত সক্রিয়৷  ভুললে চলবে না অতীতে ঐক্যের অভাবই বার বার ভারতবর্ষকে পরাধীনতার নাগপাশে বেঁধেছিল৷ বর্তমানেও যদি  ঐক্য বজায় না থাকে তাহলে বুঝতে হবে বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ দেউলিয়া হয়ে গেছে৷

আমি আশাবাদী৷ দেশনেতারা ভারতের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের গহ্বরে ঠেলে দেবেন---  এধরণের কথা ভাবতেও আমার ভাল লাগছে না৷  আমি আশা করি নেতারা নিজেদের ভুল-ত্রুটি বুঝবেন ও সাহসের সঙ্গে বাস্তবের সম্মুখীন হবেন৷ বর্তমান নেতারা যদি তা না করেন ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ নোতুন করে তার নেতা তৈরী করে নেবে ও ভবিষ্যতে সেই নেতারা ভারতবর্ষে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করবেন৷

আজ ভারতের জনসাধারণের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে নেতাদের ভুলগুলি শুধরে নেওয়া ও শোষণ-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে  দেশকে একতাবদ্ধ করা৷ ভারতকে বাঁচাতেই হবে৷ এই শোষণ-বিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র ভারতবর্ষকে নয়, ভারত, পাকিস্থান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিটি অনগ্রসর দরিদ্র দেশকে ঐক্যবদ্ধ করবে৷ সবাইকে নিয়ে একটি মজবুত নেশন বা নেশন গোষ্ঠী গড়ে তুলবে৷ সে নেশনকে বা নেশনগোষ্ঠীকে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, তাতে কিছু আসে যায়  না৷ এই শোষণ-বিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে বহু নেশন-বিশিষ্ট রুশ দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে৷ এই শোষণ-বিরোধী সংগ্রামই চীনকে মজবুত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে৷ পুঁজিবাদী দেশগুলির নেশন-সমূহ এই শোষণ-বিরোধী সেন্টিমেন্টের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ নয়৷ তাদের ঐক্য অন্য কোন-না কোন সেন্টিমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই তাদের আভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা অপেক্ষাকৃত অল্প৷ তারা সকলেই কিন্তু নিজেদের আভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যগুলোকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়েই নিজেদের একতা রক্ষা করে চলেছে৷ ভারতবর্ষের জননেতাদের এই জিনিসটা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে অধ্যয়ন করা উচিত৷

যদিও শোষণ-বিরোধী সেন্টিমেন্ট নেশন বা নেশনগোষ্ঠী গড়ার সবচেয়ে বড় উপকরণ, তবু এই সেন্টিমেন্টও খুব দীর্ঘকাল ধরে কোন নেশনকে বা নেশনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না৷ শোষণ একদিন বন্ধ হবেই৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বাসের সঙ্গে বলা যেতে পারে যে শোষণ যদি ষোল আনা বন্ধ না-ও হয, শোষণের তীব্রতা যে এতখানি থাকবে না একথা বেশ জোর করে বলা চলে৷ যখন যে দেশের শাসনক্ষমতা সত্যিকারের সদ্বিপ্রের হাতে আসবে তখন সে দেশে শোষণ প্রায় বন্ধই হয়ে যাবে৷ শোষণ না থাকায় শোষণ-বিরোধী সেন্টিমেন্ট থাকবে না৷৷ তখন কী হবে? তখন একই আধ্যাত্মিক অধিকার ও একই আধ্যাত্মিক  আদর্শ মানুষকে এক করে রাখবে৷ সেই আধ্যাত্মিক  সেন্টিমেন্টের সাহায্যে কোন দেশ-বিশেষে নেশন গড়ে উঠবে না সত্য কিন্তু এই সেন্টিমেন্ট ,সমগ্র ণক্ষত্র জগৎকে, সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডকে এক নেশনে পরিণত করবে৷ তখন গড়ে উঠবে একটিমাত্র রাষ্ট্র--- একটি বিশ্বরাষ্ট্র৷

মানুষ পৃথিবীর যে দেশেরই বাসিন্দা হোক না কেন, আজ তাকে একদিকে যেমন শোষণ-বিরোধী সেন্টিমেন্ট প্রচার করে নিজ নিজ দেশে মজবুত নেশন গড়ে তুলতে  হবে,অন্যদিকে তেমনি একটা আধ্যাত্মিক  অধিকার অর্থাৎ ‘‘প্রতিটি জীবই একই পরম পিতার সন্তান’’ এই তত্ত্ব প্রচার করে সকল নেশনের সকল মানুষ যে এক বিশ্ব-পরিবারের অর্ন্তভুক্ত একথা সকলকে বুঝিয়ে দিতে হবে৷ সকলকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে নেশন থাকলে নেশনে নেশনে স্বার্থসংঘাতও থাকবে৷ লোক মুখে নিরস্ত্রীকরণের কথা বললেও তলে তলে সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাবে আর বিশ্ব মানবের কল্যাণ প্রচেষ্টায় রত হলে প্রকারান্তরে তার নেশনেরও  কল্যাণ হবে৷ কারণ তার নেশন তো আর বিশ্ব ছাড়া নয়! একটা আধ্যাত্মিক  অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক  আদর্শেরও প্রচার করতে হবে৷ আর সেই আদর্শ বা সেন্টিমেন্টই হচ্ছে--- একপরমপুরুষই হচ্ছেন সকলের জীবনের ধ্রুবতারা৷ এই আধ্যাত্মিক সেন্টিমেন্টই  চিরদিনের জন্যে সকল মানুষকে এক করে রাখবে৷ ‘‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেয়নায়৷’’

---সমাপ্ত---