...ব্রহ্মাস্মি বিজ্ঞান যদি কেবল শাব্দিক স্তরে সীমিত থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না৷ এ জন্যে ‘সোহং’ মন্ত্রের পরিচ্ছেদহীন ভাবনা নিতে হবে৷ এই যে অ–পরিচ্ছিন্ন ভাবনা, এ ভাবনা বাচনিক জপে সম্ভব নয়৷ মানস তথা অধ্যাত্মসাধনার এই যে সূক্ষ্মবিজ্ঞান, এটা তন্ত্রেরই আবিষ্কার ঙ্মতন্ত্র ও যোগের মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই৷ তন্ত্রেরই সূক্ষ্মতর সাধনার নাম যোগমার্গৰ৷ সাধনামার্গে জপক্রিয়া ও ধ্যানক্রিয়া মহাকৌলেরই ব্যবস্থা৷ কেবল জপেও কোন কাজ হবে না, যদি মন্ত্রের গতিধারার সঙ্গে মনের গতিধারা সমান তালে না চলে৷ মনে মনে জপও করছি, আবার তার সঙ্গে অন্যের ক্ষতির চিন্তাও করছি–এ ধরনের জপ নিষ্ফল৷ জপক্রিয়ায় সাফল্য লাভ করতে গেলে সমস্ত মানসবৃত্তিকে মন্ত্রের দিকে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে হবে, বায়ুকে স্থির করে মন্ত্রে নিবদ্ধ করতে হবে৷
মন কোনো একটি বিষয়ের দিকে ছুটে চলেছে–ধ্যেয় পুরুষ রয়েছেন আর একদিকে৷ প্রাণশক্তি লিপ্ত রয়েছে অন্য কোন ব্যাপারে, বায়ু সর্বদিকে ছুটোছুটি করে চলেছে–এই সর্বদৈহিক বিশৃঙ্খলতার মধ্যে পরমাত্মার চিন্তন সম্ভব নয়, শতকোটি কল্পেও সম্ভব নয়৷
ইন্দ্রিয়সমূহের নিয়ন্তা মন আর মনের নিয়ন্তা বায়ু৷ তাই সাধনায় এদের কাউকে উপেক্ষা করলে চলবে না৷ সকলকে সংহত করে সেই এক পরমপুরুষের দিকে নিয়ে যেতে হবে৷
সদ্অগুরুর দীক্ষা ব্যবস্থা
তন্ত্রসাধনায় দীক্ষা ব্যবস্থাও অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত৷ দীক্ষার আনুষঙ্গিক অঙ্গ হিসেবে রয়েছে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব৷ একটি হচ্ছে দীপনী, অপরটি মন্ত্রচৈতন্য৷ দীপনীর অর্থ আলোকবর্ত্তিকা আর মন্ত্রের সঠিক অর্থজ্ঞান ও সেই জ্ঞানের সঙ্গে মননের সঙ্গতি নির্ধারণ মন্ত্রচৈতন্যের ব্যাপার৷ তাই দীক্ষা শব্দের ব্যাখ্যায় ‘বিশ্বসারতন্ত্রে’ বলা হয়েছে–
‘‘দীপজ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কুর্যাৎ পাপক্ষয়ং ততঃ৷
তস্মাদ্দীক্ষেতি সা প্রোক্তা সর্বতন্ত্রস্য সম্মতা৷৷’’
অর্থাৎ যার দ্বারা দীপজ্ঞান বা মন্ত্রকে সঠিকভাবে ভাবনেত্রে দেখবার সামর্থ্য জাগে ও যার ফলে সদ্য সদ্য কর্মক্ষয় শুরু হয়ে যায়, তাকেই বলে দীক্ষা৷ তাই দীক্ষার পরে হঠাৎ অত্যন্ত সুখবৃদ্ধি বা দুঃখবৃদ্ধি সাধকের পক্ষে অত্যন্ত সুলক্ষণ৷ কিন্তু মন্ত্রের এই যে প্রতিক্রিয়া, এ কেবল মন্ত্র শুণলেই বা জপ করলেই হওয়ার নয়, যথাযথভাবে মন্ত্রে দীক্ষা নিতে হবে, তবেই জপে উপযুক্ত ফল পাওয়া যাবে৷
সাধনামার্গে জপক্রিয়া ও ধ্যানক্রিয়া মহাকৌলেরই ব্যবস্থা৷ কেবল জপেও কোন কাজ হবে না, যদি মন্ত্রের গতিধারার সঙ্গে মনের গতিধারা সমান তালে না চলে৷ মনে মনে জপও করছি, আবার তার সঙ্গে অন্যের ক্ষতির চিন্তাও করছি–এ ধরনের জপ নিষ্ফল৷
মন্ত্র জপের প্রথমে রয়েছে এই দীপনীর ব্যবহার ও মন্ত্রজপের সাথে থাকতে হবে মন্ত্রচৈতন্যের বোধি৷ তোমরা মন্ত্র জপের পূর্বে দীপনীর ব্যবহার নিশ্চয়ই জানো ঙ্মবৈবহারিক ক্ষেত্রে ‘দীপনীর’ ব্যবহার হচ্ছে প্রাথমিকভাবে ত্রিশুদ্ধি তৎসহ আরও অনেক কিছু৷ৰ ...জলে প্রতিবিম্বিত বৃক্ষশাখায় সুমিষ্ট ফল দেখে যেমন ফলের আস্বাদ পাওয়া যায় না, তেমনি স্বীয় (সাধক) জীবনে যেখানে অনুভূতি নেই সেখানে পুস্তকীয় ব্রহ্মের মূল্য কতটুকু? এসম্পর্কে তন্ত্র বলছে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ এই পরম বিজ্ঞানের দ্বারাই অজ্ঞানের বিনাশ হয়ে যাবে৷ এ ছাড়া অজ্ঞান দূর করার দ্বিতীয় কোনো পন্থা নেই৷ এই তান্ত্রিক দীক্ষার মুখ্যতঃ তিনটে দিক আছে৷ অথবা বলতে পার, তান্ত্রিকী দীক্ষার তিনটে উপপর্যায় আছে–দীপনী, মন্ত্রাঘাত ও মন্ত্রচৈতন্য৷
‘দীপনী’র শব্দের সংজ্ঞায় আগেই বলা হয়েছে ‘দীপজ্ঞানং’, ও [তারপর] ‘পাপক্ষয়ং’৷
‘দীপজ্ঞানং’৷ শব্দটির প্রথম অক্ষর ‘দী’৷ ‘‘কুর্যাৎ পাপক্ষয়ং ততঃ’’৷ ‘ক্ষয়ং’ শব্দের আদ্যক্ষর ‘ক্ষ’৷ ‘দী’ আর ‘ক্ষ’ মিলে ‘দীক্ষ’, স্ত্রীলিঙ্গে হবে ‘দীক্ষা’৷ এখন ‘দীপনী’ শব্দের মানে কী? মানুষের নিজের মধ্যে সবকিছুই লুকিয়ে থাকে৷ তিনি তোমার সঙ্গে রয়েছেন কিন্তু তুমি তাঁকে জান না৷ তুমি তাঁকে দেখতে পারছ না, উপলব্ধি করতে পারছ না৷ তার কারণটা কী? –না, তুমি চারদিকে মায়ার দ্বারা, মায়িক অন্ধতমিস্রার দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে৷ এই যে তান্ত্রিকী দীক্ষা, এটা হচ্ছে যেন একটা টর্চ৷ টর্চ জ্বেলে তুমি অন্ধকারে পথ চিনে নিতে পার৷ তাই দীক্ষার প্রথম পর্বে রয়েছে ‘দীপনী’–দীপক জ্বালা৷ কিন্তু ঙ্[বৈদিক] ইনিসিয়েশনের ক্ষেত্রে এ সবের বালাই নেই৷ [তান্ত্রিকী] দীক্ষার মাধ্যমে সাধক পেয়ে যায় চলার পথের হদিস–সাধনামার্গ–আনন্দমার্গ৷ এই কল্যাণের পথে চলতে গেলে চাই আলোকবর্ত্তিকা৷ দীক্ষার মাধ্যমে মানুষ দীপালোকের সন্ধান পায়৷ এই আলোর নামই দীপনী৷