দুঃসাধ্য---অসাধ্য নয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

মানুষের সমাজে সব থেকে ভয়াবহ হলো ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষে মানুষে, ভায়ে-ভায়ে বিভেদ সৃষ্টি৷ ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশী রক্তক্ষরণ হয়েছে উপধর্ম আশ্রিত দুই সম্প্রদায়ের সংঘাতে৷ পরাধীন ভারতে বিভেদ সৃষ্টি কর---শাসন করো তত্ত্বের প্রয়োগ করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, শুধু সম্প্রদায়গত নয়, সম্প্রদায়ের ভিতর জাতি-উপজাতি তপশীলী নানাভাবে বিভাজন সৃষ্টি করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে হীনবল করাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য৷ ব্রিটিশ দেশ ছাড়লেও বিভাজনের তত্ত্বকে তারা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে৷

এর দায় সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের জাতীয় নেতারা অস্বীকার করতে পারে না৷ ভারতের জাতীয় দলের নেতৃবৃন্দ সেদিনই ভুল করেছিল ব্রিটিশের বিভাজন নীতিকে মেনে নিয়ে৷ সেদিন কোনভাবেই ব্রিটিশের বিভেদ সৃষ্টির নীতিকে মেনে নেওয়া উচিত ছিল না৷  জাতপাত সাম্প্রদায়ীক ভাবাবেগে সব থেকে বড় ভণ্ডামীটা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ তিনি সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে সমর্থন করেননি৷ কিন্তু তার বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে পরোক্ষে সমর্থন করেছিলেন৷ তিনি না মানলেন, না সমর্থন করলেন৷ মহাত্মা গান্ধীর সেদিনের সেই কৃতকর্মের ফলেই দেশ ভাগ হলো৷ জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ক্ষমতার মোহে সংগ্রাম বিমুখ হয়ে দেশভাগের পক্ষে গেলেন৷

সেদিন ওই নেতারা দেশভাগের পক্ষে গেলেন কারণ দেশভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর অনুগত নেতাদের রাজ্যগুলিতে পড়েনি৷ প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়লো পঞ্জাব ও বাঙলায়৷ বাঙলার শুধু ভূ-খণ্ডই ভাগ হলো না৷ দুই সম্প্রদায়ের মানসিক বিভাজনও তৈরী  হলো৷ হীন স্বার্থপরতা ও নিকৃষ্ট উপধর্মীয় ভাবাবেগে এক চিরস্থায়ী মানসিক বিভাজন ও সংঘাতের পরিবেশ তৈরী হলো৷ দেশনেতারা কোন চেষ্টাই করলো না দুই সম্প্রদায়ের মানসিক বিভাজন দূর করার৷ বরং সেই পরিবেশকেই রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার অবলম্বন করে নিল৷ ভারতবর্ষ থেকে উচ্চ আদর্শ ও সুস্থ রাজনীতি লোপ পেল৷ এক ভারত ভেঙে তিন রাষ্ট্র তৈরী হলো আর সেই সাম্প্রদায়িকতার ক্ষত আজও তিন রাষ্ট্রের  জনগণ বয়ে চলেছে, বিশেষ করে দুই বাঙলার জনগণ৷

আজ আবার দুই বাঙলার কিছু মুর্খ রাজনৈতিক নেতারা উপধর্মের বিষাক্ত ভাবাবেগ নিয়ে খেলা শুরু করেছে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে৷

মানুষের সামনে মানব সমাজে আজ অনেক সমস্যা৷ পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি শুধু জাত পাত সম্প্রদায়গত বৈষম্য তৈরী করেনি, দেশের সম্পদের সিংহভাগ দখল করে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে  দরিদ্র সীমার নীচে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ আর মানুষের দৃষ্টি  সে দিকে যাতে না যায় তাই এই জাত-পাত সম্প্রদায়গত সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে৷

মানুষে মানুষে ভাষায় কৃষ্টি সংস্কৃতিতে আহারে পোষাকে এত কাছাকাছি হয়েও এত মারামারি কাটাকাটি এ কোন মনুষ্যত্বের পরিচয় নয়, এ চরম বর্বরতার লক্ষণ৷ মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অচেতনতার সুযোগ নিয়ে আত্মস্বার্থ সর্বস্ব অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের অলীক উপধর্মের আশ্রয় নিয়ে এই মাতববরি আর কতদিন চলবে? ধর্মকে বিকৃত করে এই হানাহানির কি শেষ নেই৷ ভৌম বিভাজন একটা চেকপোষ্ট তুলে দিলেই এক হয়ে যায়৷ কিন্তু মানসিক বিভাজন! দুই সম্প্রদায়ের এই বিভাজন কি কোনদিন দূর হবে না৷ কাজটা হয়তো দুঃসাধ্য, কিন্তু অসাধ্য নয়৷ বিশ্ব কবির কথায়---‘‘দুঃসাধ্য অধ্যাবসায়ে দুর্গম লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছবই যদি আমরা মিলতে পারি৷’’