রামচন্দ্র নাকি দুর্গাপূজা করেছিলেন--- তোমরা এ ধরণের একটা গল্পও শুণেছ বোধ হয়--- এটার প্রাসঙ্গিকতা কী, সেটা বলি৷ সে সম্বন্ধে বলতে গেলে আগে রামায়ণের কথা বলতে হয়৷ রামায়ণের গল্প ভারত,মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মানুষদের মুখে মুখে চলছে ..দু/চার হাজার বছর নয়, আজ অনেক হাজার বছর ধরে৷ তবে এই রামায়ণকে লিখিত রূপ প্রথম দিয়েছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি৷ এই লিখিত রূপ যখন তিনি দিয়েছিলেন সেটা শিবের যুগের অনেক পরে, বুদ্ধের যুগেরও পরে৷ তার দু’টো প্রমাণ আমাদের হাত রয়েছে৷ তার একটা প্রমাণ হচ্ছে,কোন্ বইটা কত পুরোনো সেটা তার ভাষা দেখে বোঝা যায়৷ ভাষাটা পুরোণো , তা হলে বইটাও পুরোণো৷ ভাষাটা নোতুন, তো বইটাও নোতুন৷ যা রামায়ণ বা বাল্মীকিকৃত রামায়ণ তার ভাষা মোটেই পুরোণো নয় সরল সংস্কৃত, যে সরল সংস্কৃতে মহাযানী বৌদ্ধদের শাস্ত্রগুলো রচিত সেই রকমের ভাষা৷ দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, বাল্মীকির রামায়ণে বুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়েছে, নিন্দাবাদ করা হয়েছে বুদ্ধের নাস্তিক্যের জন্যে৷ নাস্তিক্যবাদের জন্যে তাঁকে নিন্দা করা হয়েছে, তাঁকে চোর বলা হয়েছে, পাষণ্ড বলা হয়েছে, নাস্তিক বলা হয়েছে৷ এতে প্রমাণিত হয় যে রামায়ণ বুদ্ধের পরে রচিত হয়েছে, তবেই না বুদ্ধের সম্বন্ধে কথা বলা গেছে৷ বুদ্ধের আগে রচিত হলে বুদ্ধের সম্বন্ধে বলা যেত না৷ অযোধ্যাকাণ্ডে এইসব কথাগুলো বলা হয়েছে৷
যাইহোক, এ সম্বন্ধে আরও বলি৷ মহাভারত কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে আসেনি৷ মহাভারতের ঘটনাটা অনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার--- কৃষ্ণের জন্মের সময়কার৷ আর লিখিত হয়েছিল প্রায় সেই সময়ই বা তার অল্প কাল পরে৷ মহাভারতেও রামায়ণের সামান্য উল্লেখ আছে৷ এই উল্লেখটা বাল্মীকি রামায়ণের নয়, তৎকালীন প্রচলিত রামায়ণের গল্প সম্বন্ধে যা মানুষের মুখে মুখে চলত৷ যাইহোক্, বাল্মীকির রামায়ণের যে কাল সেই সময়ে মার্কণ্ডেয় পুরাণের কাল আসেনি৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী দুর্গার কথা বলা হচ্ছে৷ পৌরাণিক যুগে শাক্তাচার যখন শুরু হচ্ছে, মার্কণ্ডেয় পুরাণ প্রায় সেই সময়ের রচনা৷ সেই সময়ে দুর্গাদেবীকে কোথাও অষ্টভূজা, কোথাও দশভূজা বলা হয়েছে৷ তবে শেষ সমর্থন দেওয়া হয়েছে দশভূজাকে৷ এগুলো সব পুরাণকারের কল্পনা৷ যাই হোক বাল্মীকির রামায়ণ যে সময়কার রচনা মার্কণ্ডেয় পুরাণ সে সময় জন্মায় নি, দেবী দুর্গার আখ্যায়িকাও তখন আসেনি৷ তাই বাল্মীকির রামায়ণে রাম দেবী দুর্গার পূজা করেছেন একশ’ আটটা নীলকমল দিয়ে, একটা কমল দেবী চুরি করলেন--- এই সকল গল্প ছিল না৷ বাল্মীকির রামায়ণে এসবের কোন উল্লেখ নেই৷
তারপর এলো মার্কণ্ডেয় পুরাণের যুগ, যার ভিত্তিতে ‘শ্রীশ্রীচন্ডী’ রচিত হয়েছে৷ তোমরা জেনে রাখবে, পৌরাণিক শাক্তাচার যখন এল, তখন শক্তির আদিতম অবস্থাকে, যাকে সংস্কৃতে বলা হয় আদ্যাশক্তি (পুংলিঙ্গে ‘আদি’, স্ত্রীলিঙ্গে ‘আদ্যা’) এই আদ্যাশক্তির চণ্ডরূপকে চণ্ড শক্তি বা চণ্ডী বলা হয়েছিল৷ এ ধরণের বলা শুরু হয়েছে তেরশ’ বছর আগে থেকে, তার চেয়ে পুরোণো নয়৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণ--- যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘চণ্ডী’ যাতে দেবী দুর্গার কথা রয়েছে, সুরথ রাজার গল্প রয়েছে,তাতেও রামের ব্যাপার নেই৷ রাম যে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন সে গল্প নেই৷ এখন তোমরা অনেকেই হয়তো জান, রাম কোন বাস্তব চরিত্র নন, রাম কল্পিত চরিত্র ও সেই চরিত্রকে যথাযথ রূপ দেবার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি৷
বাল্মীকির চেয়েও বেশী চেষ্টা করেছিলেন মোগল যুগে (অর্থাৎ বেশীদিন আগেকার কথা নয়) কবি তুলসীদাস তাঁর অবধী ভাষায় লেখা ‘‘রামচরিতমানস’’ পুস্তকে৷ ‘‘রামচরিতমানস’’ সম্পূর্ণ রামায়ণ নয়৷ মহর্ষি তুলসীদাস মনে মনে রামের কথা যেমন যেমন ভেবেছিলেন সেই রকম লিখিছিলেন অর্থাৎ তুলসীদাসের মানসে---মানস পটভূমিতে যে রামের চরিত্র তিনি তৈরী করলেন তার নাম ‘‘রামচরিতমানস’’৷ তুলসীদাস সত্যনিষ্ঠ ছিলেন৷ তাই তিনি বইয়ের নাম তুলসীদাসী রামায়ণ রাখেন নি, ‘‘রামচরিতমানস’’ রেখেছিলেন৷ এই যে ‘‘রামচরিতমানস’’, এতেও কিন্তু রাম কর্ত্তৃক দুর্গাপূজার কোন উল্লেখ নেই৷
তাহলে এটা কোথায় পাচ্ছি যে রাম দুর্গাপূজা করেছিলেন? পাঠান যুগের গোড়ার দিকে বরেন্দ্রভূমিতে--- মানে, উত্তর বাঙলার রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে এক রাজা ছিলেন৷ তাঁর নাম কংসনারায়ণ রায়৷ যাই হোক, সেই কংস নারায়ণের ছিল প্রচুর টাকা--- বিস্তীর্ণ জমিদারী৷ তিনি তাঁর সময়ে পণ্ডিতদের ডেকে বললেন, ‘‘আমি রাজসূয় কিংবা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই৷ মানুষে জানুক, আমার ধন-ঐশ্বর্য্য কীরকম আছে, আর দু’হাতে ফেলে ছড়িয়ে দানও করব’’৷ শুণে পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, এই কলিযুগে অশ্বমেধ, রাজসূয় যজ্ঞ হয় না৷ তাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে দুর্গাপূজার কথা, দুর্গোৎসবের কথা আছে, তাতেও তো খুব খরচ করা যায়, জাঁকজমমক দেখানো যায়. নিজের ঐর্শ্বয্য দেখানো যায়৷ আপনি মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে এই দুর্গোৎসব করুন৷’’ তখন রাজা কংসনারায়ণ রায় তৎকালীন সাত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে (এখনকার দিনে অনেক কোটি টাকা) প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন৷ তাহলেই তোমরা বুঝছ যে জিনিসটা মোটেই পুরোণো নয়, পাঠানযুগের গোড়ার দিকের জিনিস৷ তাঁর দেখাদেখি একটাকিয়া (একটাকিয়া জায়গাটা সম্ভবতঃ রংপুর জেলায় ) রাজা জগদ্বল্লভ, মতান্তরে জগৎনারায়ণ সাড়ে আট লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে আরও জাঁকজমক করে দুর্গাপূজা করলেন৷ তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য জমিদাররাও ভাবলেন, ‘‘আমরাই বা কিছু কম নাকি! আমরাও টাকার খেলা দেখাতে পারি’’৷ তাঁরাও জাঁকজমক করে দুর্গা পূজা শুরু করলেন৷ একেবারে প্রতি জমিদার বাড়ীতেই পূজা শুরু হয়ে গেল৷ এইভাবে পূজাটা বাড়ছে কিন্তু সবই ঘরের পূজা৷ তা সেই সময়ে হুগলী জেলার বলাগড় থানায় গুপ্তিপাড়ার (জায়গাটার আসল নাম গুপ্তবৃন্দাবন) বার জন বন্ধু ভাবলেন যে আমরা একক ভাবে না হয় পারব না, কিন্তু বার জনে মিলে তো পূজার আয়োজন করতে পারি ৷ উর্দু ভাষায় বন্ধুকে বলে ‘ইয়ার’৷ তাই বারো জন ‘ইয়ারে’ মিলে যে দুর্গাপূজা করলেন সেটা হ’ল বারো ইয়ারী পূজা---বারোয়ারী পূজা৷ আর বারোয়ারী পূজায় যেহেতু অন্ত্যজ লোকেদের অঞ্জলি দেবার অধিকার থাকে না, তাই যাতে সবাইকার অধিকার থাকে সেইজন্যে অতি আধুনিককালে বারোয়ারী পূজা বিবর্তিত হয়ে হ’ল সর্বজনীন পূজা৷ এতে সবাইকার সমান অধিকার থাকে৷
সে যাইহোক , দুর্গাপূজা জিনিসটা পাঠান যুগের গোড়ার দিকের জিনিস৷ বাংলা রামায়ণ কবি কৃত্তিবাস ঠাকুর লিখলেন৷ তখন বাঙলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ্৷ হুসেন শাহ্ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন৷ বাংলা সাহিত্যে যাতে ভাল ভাল বই লিখিত হয়, সংস্কৃত ভাষার ভাল ভাল বইগুলো যাতে বাংলায় অনুদিত হয় সেই জন্যে তাঁর প্রয়াসের অন্ত ছিল না৷ তাঁর অনুরোধেই কবি কৃত্তিবাস বাংলা ভাষায় রামায়ণ লিখলেন৷ বাঙলায় সে সময় জমিদার বাড়ীতে দুর্গাপূজা শুরু হয়ে গেছে ৷ এই দুর্গাপূজাটাকে অধিকতর মহিমা দেবার জন্যে তিনি তিনি বাঙলা ভাষায় লেখা রামায়ণে রাম কর্ত্তৃক দুর্গাপূজার উল্লেখ করেছিলেন৷ জিনিসটা কোন ঐতিহাসিক তথ্য নয়, জিনিসটা খুব পুরোনোও নয়, পাঠান যুগের ব্যাপার ৷ তা রাম যে দুর্গাপূজা করেছেন বলা হয় তার সুত্র হ’ল বাংলায় রচিত কৃত্তিবাসের রামায়ণ৷
*দ্রষ্টব্য ঃ- ‘শিব এসেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৭ হাজার বৎসর পূর্বে৷ আর কৃষ্ণ এসেছিলেন আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বে৷ (নমঃ শিবায় শান্তায়)