দুর্যোগের ঘনঘটা

লেখক
সুভাষপ্রকাশ পাল

১৯৮৫ সালের আগষ্ট মাস, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতিবসু দলীয় কোন কাজে বিহারে গিয়েছেন৷ ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মারফৎ জানা গেল---আনন্দমার্গীরা নাকি জ্যোতিবাবুকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে৷ সৌভাগ্যক্রমে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সে যাত্রা তিনি রক্ষা পেয়েছেন, ব্যাপারটা আমাদের মত সাধরণ মার্গীদের কাছে দুর্র্বেধ্য ঠেকেছিল৷ কার এমন বুকের পাটা থাকতে পারে যে পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীদের ব্যুহভেদ করে জ্যোতিবাবুর মত ব্যষ্টিকে হত্যা করতে যাবে৷ তাছাড়া তাদের উদ্দেশ্যটাই বা কী? সবকিছু যেন একটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ আনন্দমার্গের শিক্ষাপদ্ধতি ভাল লাগে তাই বাকুল্দার মত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একটি নার্শারী স্কুল করার প্রয়াস নিয়েছি, সংবাদপত্রে উপরোক্ত সংবাদ বেরাবার পরদিন বাড়িতে বসে আছি, আমার পাশাপাশি গ্রামের কয়েকজন বাসকর্মী বেশ কিছু লোকজন নিয়ে মিছিল করে আমাদের বাড়িতে এলেন৷ তাঁরা খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকলেন আনন্দমার্গীরা তাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যার চক্রান্ত করেছে৷ সেজন্য অবিলম্বে বাকুল্দায় গড়ে ওঠা আনন্দমার্গ স্কুলটি বন্ধ করতে হবে৷ আমি যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলাম---যদি সত্যই কেউ ঐ অপকর্মে জড়িত থাকে তবে দেশের আইন অনুসারে তার শাস্তি হবে৷ স্কুল তো কারও কোন ক্ষতি করেনি৷ সেজন্য এখানে স্কুলের প্রসঙ্গ আসছে কেন? কিন্তু কে শোণে কার কথা৷ তাঁদের কেউ বললেন--- ‘আনন্দমার্গ স্কুল’ এই সাইনবোর্ড খুলে নিতে হবে৷ আবার কেউ বললেন--- আপনারা ছাত্রদের জন্য যে লাল জামা কালো পান্টের ব্যবস্থা করেছেন তা পরিবর্তন করতে হবে৷ সেই মুহূর্তে বেশী কিছু কথা বলাটা সমুচিত হবে বলে মনে হল না৷ শুধু বললাম--- স্কুলের ছেলে মেয়েরা কী রং-এর পোষাক পরবে, সেটাও কি আপনারা ঠিক করে দেবেন? কয়েকদিন বেশ উত্তপ্ত পরিবেশ থাকল, একদিন সকালে শুনলাম--- সেদিন আনন্দমার্গ স্কুল ভাঙচুর হবে এবং স্কুল উঠিয়ে দেওয়া হবে৷ প্রার্থনার পর সবে মাত্র স্কুলের পঠন-পাঠন শুরু হয়েছে, এমন সময় দুদিক থেকে দুটো মিছিল আনন্দমার্গ স্কুলের কাছে এসে মিলিত হল৷ আনন্দমার্গ তথা আনন্দমার্গ স্কুলের বিরুদ্ধে স্লোগান চলতে থাকল৷ কাকতালীয়ভাবে একজন সন্ন্যাসীদাদা উপস্থিত হয়েছেন স্কুল পরিদর্শনের জন্য, তাকে দেখামাত্রেই নেতাদের উস্কানিতে ক্ষিপ্ত জনতা কিল,চড়, খুশি ইত্যাদি নানাভাবে তাঁকে হেনস্তা করতে থাকল৷ তিনি প্রাণভয়ে পাশাপাশি একটা ঘরে লুকোবার চেষ্টা করলেন৷ তার পিছনে সবাই ধাওয়া করল৷ ঠিক সেই সময় ঈশ্বরপ্রেরিত দেবদূতরূপে সেখানে উপস্থিত হলেন বাকুল্দা গ্রামেরই একজন সাধারণ চাষাভূষা মানুষ শ্রী কালিপদে পোড়্যা মশাই৷ তিনি সন্ন্যাসীদাদাকে একপ্রকার ছিনতাই করে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন, সেবা শুশ্রূষা করলেন এবং প্রাণ বাঁচালেন৷ অন্যদিকে মিছিলের কয়েকজন শ্রেণীকক্ষে ঢুকে শিক্ষকদের টেবিলের নীচে মাথা ঢুকিয়ে টাঙ্গি তুলেছে হত্যা করার জন্য, প্রতিবেশী শ্রীবটকৃষ্ণ সামন্ত ছুটে এসে তাদেরকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে শিক্ষকদের রক্ষা করলেন৷ ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে কান্নাকাটি করছে, কেউ কেউ এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে৷ আসলে উদ্দেশ্য ছিল---এভাবে ভয় দেখিয়ে একটা সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করা যাতে অভিভাবকরা ভয় পেয়ে আর ছাত্র না পাঠায় এবং তার পরিণতিতে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়৷ সন্ন্যাসী দাদার আঘাত গুরুতর ছিল৷ স্থানীয় শ্যামসুন্দরপুর পাটনা হাসপাতালে সন্ন্যাসী দাদা ও আহত শিক্ষকদের প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে থানায় ডাইরী করা হল৷ ডাইরী তোলার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে নরমে/গরমে আনন্দমার্গীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকল, অভিভাবকেরা থানার বড়বাবুর কাছে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার যাতে ক্ষতি না হয় সেকথা জানিয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য সবার স্বাক্ষরসহ একটি আবেদনপত্র জমা ছিলেন৷ শ্যামসুন্দরপুর পাটনা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক (রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত) শ্রী নির্মল চন্দ্র মাইতি শিক্ষার উপর হামলার প্রতিবাদ গর্জে উঠলেন৷ তিনি বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদসভা করলেন ও শিক্ষাবিদ কিরণ চৌধুরীকে আনিয়ে একদিন প্রকাশ্য সভা করলেন, প্রশাসন একটু নড়ে চড়ে বসল৷ থানায় উভয়পক্ষকে নিয়ে মিটিং হল৷ ঠিক হল --- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর হামলা করা চলবে না৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার আপন গতিতে চলতে থাকবে৷ মাসখানেক স্কুল বন্ধ থাকার পর পঠন-পাঠনের কাজ পুনরায় শুরু হল, শ্রীপ্রাণকৃষ্ণ সামন্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে থাকতে চাইলেন না৷ পরবর্ত্তী প্রধান শিক্ষক হলেন শ্রীনিল কুমার মণ্ডল,অদ্যাবধি তিনিই প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ বর্তমানে ছাত্র সংখ্যা ২৬৫ শিক্ষক আছেন ১২ জন৷ অশিক্ষক কর্মী ২ জন৷ সাতটি মারুতি ও দুটি টোটো গাড়ি ছাত্র-ছাত্রাদের পরিবহনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে, বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়ে বহু ছাত্রছাত্রা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ বহুজনের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা ত্রিতল বিশিষ্ট বাকুল্দা আনন্দমার্গস্কুলটি বর্তমানে সবার আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু৷