পরমাত্মাকে ভুলে গিয়ে যে কেবল সংগীতচর্চার মধ্যেই রয়ে গেছে, তাকে আমরা বলি গন্ধর্ব৷ এই জন্যে সংগীত–শাস্ত্রকে বলা হয় গন্ধর্ববিদ্যা৷ গন্ধর্ব অবস্থায় থেকে দু’চার লাখ বছর বাদে কিছু সংস্কার ক্ষয় হয়ে গেলে, সে আবার মনুষ্য–জীবন পাবে৷ এটা খুবই কষ্টকর অবস্থা৷
এই রকমেরই হয় যক্ষ৷ তারা পরমাত্মার কাছে চায় অলৌকিক শক্তি৷ প্রাচীনকালে তিন হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খুব যক্ষের পূজো করত যাতে মৃত্যুর পর যক্ষ হতে পারে৷ আজকাল লোকে সেই পূজাস্থলকে ব্রহ্মস্থান বলে৷ ব্রহ্মস্থান মানে যক্ষের স্থান৷
মানুষ–ব্যষ্টি বা সমষ্টি–বড় হয় ত্যাগের দ্বারা৷ মনে রাখবে, বৈয়ষ্টিক জীবনে ত্যাগ থাকলেই সামূহিক জীবনে ভোগ সম্ভব৷ সব মানুষই যদি নিজের জন্যে এক বিমানপোতের অধিকারী হবার চেষ্টা করে তাতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু যদি সেই মানুষটির মধ্যে ত্যাগের ভাবনা না থাকে তবে এতে সমাজের কোনো লাভ নেই৷ একটি মানুষের কাছে হাজার হাজার বা কোটি কোটি টাকা থাকলেও তাতে দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের কিছু লাভ নেই৷ সে বৈয়ষ্টিক জীবনে ত্যাগ করুক, সকলে মিলেমিশে খেয়ে দেয়ে সুখে থাকুক–এইভাবে সকলেই এক পরমাত্মার সন্তান রূপে থাকলে, তবেই সেটা ভালো৷ সাধকের মনোভাব হবে এই রকম–‘যে ভোগ সকলে করতে সক্ষম নয়, সেই ভোগ আমি করব না’৷ তাই বৈয়ষ্টিক জীবনে ত্যাগ করতেই হবে৷
ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া রঙ৷ এইজন্যে আমরা গেরুয়া রঙের পতাকাকে জয়ের প্রতীক বলে মনে করি৷ সব রঙের পতাকায় জয়লাভ হয় না, গেরুয়া রঙের পতাকায় তা হয় অর্থাৎ জয় হয় ত্যাগের৷
আমাদের পতাকার মাঝখানে আছে স্বস্তিক চিহ্ণ৷ স্বস্তিকের রঙ কী? এর রঙ শাদা৷ শাদা রঙ পবিত্রতার দ্যোতক অর্থাৎ ত্যাগের দ্বারা আমরা সমাজে পবিত্রতার প্রতিষ্ঠা করব৷ তাই যেখানে ত্যাগ আর পবিত্রতা আছে সেখানে অবশ্যই জয় হবে৷ চাইলে বা না চাইলেও জয় হবে৷
স্বস্তিকের তাৎপর্য কী? প্রাচীনকালে কেবল ভারতেই নয়, সমগ্র বিশ্বে মানুষ যখন লিখতে জানত না, সেই সময় তার মনে ভাবনা এল যে, পরমপুরুষ আর পরমাপ্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে, কীভাবে লিখব? আসলে লেখা তো তখন সম্ভব ছিল না৷ কেননা তাদের লেখার অক্ষর–জ্ঞানই ছিল না৷ আর দ্বিতীয় কথা লেখা জানলেও ব্যক্ত করবে কী করে? তোমরা জান তো যে ভাবের থেকে ভাষার শক্তি কম৷ ধর, কেউ তোমার একটি হাত কেটে দিল৷ সেই সময় তুমি ‘উঃ উঃ’ করবে৷ আবার যদি একটি আঙ্গুল কেটে দিল, তাহলেও তুমি উঃ উঃ করবে৷ ভাষায় দু’ক্ষেত্রেই ‘উঃ উঃ’ করবে৷ যে দেখতে পাচ্ছে না সে দূর থেকে ৰুঝতে পারবে না যে হাত না আঙ্গুল কেটে দেওয়া হয়েছে৷ ভাষার শক্তি এত সীমিত৷ শব্দের দ্বারা মাত্রাজ্ঞান ঠিকভাবে হয় না৷ মানুষ চেষ্টা অবশ্য করে৷ এখন পরমপুরুষকে মানুষ ব্যক্ত করবে কী করে? যিনি অনন্ত, মানুষ ভাষা দিয়ে তাকে ব্যক্ত করবে কী করে?
‘‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে৷
সুরতরুবরশাখা লেখনী পত্রমূর্ব্বীঃ৷৷
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং৷
তথাপি তবগুণানাম ঈশ পারং না যাতি৷৷’’
সদাশিব সম্বন্ধে কবি বলছেন যে, আমি তোমার সম্পর্কে লিখব বা কী করে বা তোমার গুণগান করব কী করে? ‘অসিতগিরি সমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে’৷ কালির যে গুলি অর্থাৎ tablet (বড়ি), তোমরা দেখেছ যে (আজকাল এর ব্যবহার কমে গেছে) তার একটা ছোট টুকরো জলে গুলে কালি তৈরী হত৷ কবি বলছেন, ‘‘হে ভগবান, হে সদাশিব কালি তৈরী করার জন্যে আমি যদি হিমালয় পর্বতের সমান বড় কালির ট্যাবলেট ব্যবহার করি (কন্যাকুমারী থেকে কশ্মীর পর্যন্ত), তাহলে তার জন্যে একটি উপযুক্ত দোয়াতও তো চাই৷ আর সিন্ধু মহাসাগরকেই যদি দোয়াত বানিয়ে নিই, আর স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষের শাখাকে কলমরূপে ব্যবহার করি কিন্তু তাতেও তো কাজ চলবে না, লেখার জন্যে কাগজ তো চাই৷ কাগজ কত বড় হওয়া উচিত? যদি এই ধরাপৃষ্ঠকেই কাগজ বানিয়ে নিই তাহলে এই রকম ধরনের কালি, কলম আর কাগজ নিয়ে যদি স্বয়ং সরস্বতীও লিখতে শুরু করে দেন–তাহলে কত কাল পর্যন্ত লিখতে হবে?
‘সর্বকালং’–সমগ্রকাল ব্যাপি যদি লেখা হতে থাকে–‘তথাপি তব গুণানাম ঈশ পারং ন যাতি’– তথাপি হে সদাশিব তোমার গুণগান, তোমার গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবে না৷
পরমপুরুষকে ব্যক্ত করার জন্যে প্রাচীনকালে মানুষ কী করল? পরমপুরুষকে ব্যক্ত করার জন্যে তারা আঁকল একটা সোজা সরলরেখা৷ আর এই যে ব্যক্ত জগতকে আমরা পাই তা পরমপুরুষের পরমাপ্রকৃতি দ্বারা গুণান্বিত৷ যেখানে তিনি গুণান্বিত নন সেখানে তাঁকে বলব কারণ ব্রহ্ম৷ আর যেখানে গুণান্বিত হয়ে গেছেন সেখানে তিনি কার্য ব্রহ্ম (Causal Brahma and Effect Brahma)৷ কারণ ব্রহ্ম আর কার্য ব্রহ্ম৷ আর এই যে ব্রহ্মাণ্ড, এই যে চরাচর, এটাই কার্যব্রহ্ম৷ অর্থাৎ পরমপুরুষ এক্ষেত্রে পরমাপ্রকৃতির দ্বারা গুণান্বিত হয়ে গেছেন৷ তিনি বিভিন্ন বস্তুরূপে নিজেকে বিকশিত করেছেন, প্রকাশিত করেছেন৷ তাই পরমপুরুষকে ৰোঝাবার জন্যে সোজা (দাঁড় করানো) ‘৷’ রেখা আর পরমাপ্রকৃতিকে ৰোঝাবার জন্যে তারা আঁকল এক শুয়ে থাকা রেখা ‘–’ (Horizantal line)৷ এইভাবে হয়ে গেল একটা ক্রসের মত (যুক্ত ) চিহ্ণ৷ অর্থাৎ পরমপুরুষ পরমা প্রকৃতির ৰন্ধনে আৰদ্ধ হয়ে গেছেন৷ তাই এই যে যুক্ত চিহ্ণ তা হয়ে গেল সমগ্র বিশ্বের প্রতীক, কার্যব্রহ্মের প্রতীক৷
এখন পরমপুরুষের সেবা করব কী করে? এর জন্যে কার্যব্রহ্ম অর্থাৎ ব্যক্ত জগতের সেবা করতে হবে৷ অব্যক্ত সত্তার সেবা তুমি করতে পার না৷ বলা হয়েছে এই যে, পরমপুরুষের দ্যোতক হ’ল একটি শীর্ষদেশীয় রেখা–এর অর্থ পরমপুরুষ এক, সর্বত্র একটিই সত্তা৷ তিনি সর্বকালীক, সর্বদৈশিক সত্তা৷ এইজন্যে প্রাচীনকালের মানুষ অনেক দিন পূর্বে এই ব্যক্ত জগতের জন্যে ব্যবহার করে এসেছে যুক্ত চিহ্ণ অর্থাৎ পরমপুরুষ পরমাপ্রকৃতির বন্ধনে এসে গেছেন৷ পরমপুরুষ পরমাপ্রকৃতির দ্বারা গুণান্বিত হয়ে গেছেন৷ এই হ’ল কার্যব্রহ্ম৷
এখন সাধক কী করবে? সাধক চাইবে ব্যক্ত জগতের ওপর তার অধিকার বা শাসন থাকুক যাতে কার্যব্রহ্মের সেবা ঠিকভাবে করতে পারে৷ ধর, রোগী দৌড়চ্ছে, সে অবস্থায় ডাক্তার রোগীর সেবা করতে পারবে কি? রোগী যখন ডাক্তারের কব্জায় থাকবে তবেই না তার কাজ হবে৷ যদি তার সেবা করতে হয় তাহলে তাকে নিজের কব্জায় নিয়ে আসতে হবে৷ তাকে ধরে থাকতে হবে ঠিকভাবে৷ এই কথাটার তাৎপর্য হচ্ছে–এই যুক্তচিহ্ণের মধ্যে আছে চারটি শীর্ষবিন্দু৷ তার ওপর তোমার দখল থাকতে হবে৷ চারটি বিন্দুকে তোমাকে ঠিকভাবে ধরে থাকতে হবে৷ একটি বিন্দু (সবচেয়ে ওপরের বিন্দুটি) তুমি ধরে নিলে৷ এবার তার বাঁদিকে ঘুরে দ্বিতীয় বিন্দুটি ধরে নিলে, এইভাবে দু’টো বিন্দুকে মিলিয়ে নিলে৷ এরপরে তৃতীয়–চতুর্থ বিন্দুকেও ধরবে, চারটি বিন্দুকেই তুমি ধরে নিয়েছো৷ এর অর্থ হচ্ছে ব্যক্ত জগৎ তোমার দখলে এসে গেছে৷ আর এই যে ব্যক্ত জগতের বিকাশ তা হয় কীভাবে? বিপরীত দিক দিয়ে অর্থাৎ তা হচ্ছে বামাবর্ত্তে, আর কার্যরূপটা থাকছে দক্ষিণাবর্ত্তে৷ তাহলে একে চালনা করার সময় তাকে চালাতে হবে বামাবর্তে –ইংরাজীতে এক বলি anti-clockwise আর দক্ষিণাবর্ত্তকে বলি clockwise৷ এই যে ঘড়ির কাঁটা বিপরীত দিকে ঘোরানো, এরজন্যে হয় কি না এক দিক থেকেও নিয়ন্ত্রণ আছে আর অন্য দিক থেকেও নিয়ন্ত্রণ থাকে৷ এইভাবেই নিয়ন্ত্রণটা ঠিক হয়৷ এই হ’ল স্বস্তিক৷ এর দ্বারা বিশ্বকে দখল করব, অধিকার করব৷ তাহলে স্বস্তিক বামাবর্ত্তে ঘোরাতে হয়, ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে৷ তাই এখানে জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী৷ আর স্বস্তিক যদি উল্টো স্বস্তিক হয় অর্থাৎ যদি তা দক্ষিণাবর্ত্তে ঘোরানো থাকে, তাহলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী৷ হিটলারের ছিল উল্টো স্বস্তিক৷
আজকের যে সাধক সে সাধনা অবশ্যই করবে৷ আর এটি স্বতঃসিদ্ধ যে জয় তো তোমাদের অবশ্যই হবে৷ কেবল জয়প্রাপ্তির জন্যে করতে হবে পরিশ্রম৷ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবের জয়লাভ হবেই, এটা সকলেই জানত৷ কৃষ্ণ তো জানতেনই, তবুও তাঁকে প্রয়াস করতে হয়েছে৷ তোমাদেরও কষ্ট করতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে–জয় তো তোমাদের সঙ্গেই আছে৷