প্রাউটের প্রথম সিদ্ধান্ত ঃ–
কোন ব্যষ্টিই সামবায়িক সংস্থার (collective body) সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷
আমাদের চাহিদা তিন ধরনের–
* ভৌতিক (physical)
* মানসিক (psychic)
* আধ্যাত্মিক (spiritual)
অণুমন তার অনন্ত ক্ষুধা ভৌতিক উপাদান লাভের মাধ্যমেই তৃপ্ত করতে চায়, কিন্তু এই ভৌতিক সম্পদ যদিও বিপুল, তবুও অনন্ত নয়– সীমিত৷ ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিন স্তরের মধ্যে মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগৎ অনন্ত৷ এই দুই স্তরে অণুমনের অনন্ত এষণার পরিতৃপ্তি হতে পারে৷ এতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেবে না৷
সামাজিক–র্থনৈতিক সংরচনায় মানুষ মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে৷ মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ অনন্ত৷ তাই এই সম্পদ কোন মানুষ যতই আহরণ করুক না কেন, তাতে কারুর ঘাটতি পড়বে না৷ কিন্তু জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ এক্ষেত্রে একজন অতিরিক্ত সঞ্চয় করলে সমাজের অধিকাংশ মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণে ঘাটতি দেখা দেবে৷ এতে বৃহত্তর–জনগণের আধ্যাত্মিক, মানসিক ও ভৌতিক অগ্রগতি রুদ্ধ হতে বাধ্য৷ সুতরাং ভৌতিক স্তরে ব্যষ্টি স্বাধীনতার সমস্যাকে সমাধান করতে গেলে, একে অবশ্যই একটা ঊর্ধ্বসীমার বাইরে যেতে দেওয়া হবে না৷ আবার একে কঠোর ভাবে খর্ব করাও উচিত নয়–কেননা তা করলে মানুষের আধ্যাত্মিক, মানসিক ও ভৌতিক স্তরের বিকাশ সম্ভব হবে না৷
অর্থোপার্জন নিশ্চয়ই করতে পার, কিন্তু সে উপার্জন যেন ততটুকুই হয়–তোমার পরিবার প্রতিপালনের জন্যে, বা তাদের দুর্দিনের সংস্থানের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন, তার চাইতে একপয়সাও বেশী নয়৷ সর্বদাই মনে রাখতে হবে অর্থের মূল্য ব্যবহারে৷ তোমার ঘরে তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চিত হলে ব্যবহার না থাকায় তা মূল্যহীন হয়ে যায়৷ যতটা অর্থকে তুমি মূল্যহীন করে’ ফেলছ একজন বুভুক্ষু–বিবস্ত্র মানুষের প্রতি তুমি সেই পরিমাণ অবিচারও করে’ ফেলছ৷ তোমার মূল্যহীন টাকাগুলো অন্যকে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে সেগুলোকে মূল্যবান করে’ নিতে হবে৷
মানুষের মনে যে অনন্ত ক্ষুধা আছে সেই ক্ষুধা মানসিক বা আধ্যাত্মিক সম্পদে নিবৃত্ত হবার ঠিক পন্থা না পেলে, জড়জগতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করে’ অন্যকে বঞ্চিত করবার কাজে লেগে যায়৷৯ অন্যকে শোষণ করে’ ধনী হবার ইচ্ছা এক ধরণের মানসিক ব্যাধি৷
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষ যেখানে অপরিগ্রহ (জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জাগতিক ভোগ্য দ্রব্য গ্রহণে অনীহা) নীতিকে লঙঘন করছে, শোষণের সূত্রপাত সেখানেই৷
সীমিত জাগতিক সম্পদ থেকে যখন অন্তহীন মানসিক–আভোগ সন্তুষ্টি পেতে চায় তখনই শোষণ শুরু হয়৷ ফলে মুষ্টিমেয় মানুষ হয়ে ওঠে পুঁজিবাদী, বাকীরা শোষিত দরিদ্রে পরিণত হয়৷
পরিবারের যে সদস্য অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে একাত্মভাব রাখে না, যৌথ অধিকারের মহৎ আদর্শ তথা যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যটুকুকে স্বীকার করতে চায় না, তাকে সামাজিক জীব বলে’ স্বীকার করা চলে না৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিক আদর্শ অনুযায়ী ব্যষ্টিগত মালিকানা–ব্যবস্থাকে চরম ও পরম বলে’ স্বীকার করা চলে না, আর তাই পুঁজিবাদকেও সমর্থন করা যায় না৷
ভোগ্যপণ্যের অন্তর্নিহিত সুপ্ত শক্তিই পুঁজি৷ বুদ্ধিমান লোকেরা ভোগ্যপণ্যরূপে অন্যদের থেকে বেশী পুঁজি সংগ্রহ করে, কিন্তু যেহেতু ভোগ্যপণ্য বেশী দিন ধরে’ জমিয়ে রাখা যায় না, সেইজন্যে তারা পুঁজি হিসেবে জমাতে থাকে অর্থ৷ এদেরই বলে পুঁজিবাদী৷ এই পুঁজিবাদীরা ‘ভূমা–উত্তরাধিকার’ তত্ত্বের বিরোধী৷ পুঁজিবাদের বিরোধিতা করা তাই অন্যতম লক্ষ্য৷
বর্ত্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদীরা নিজের ঘরে প্রাচুর্য্যের মাত্রাধিক্য ঘটাতে গিয়ে অন্যকে ক্ষুধার জ্বালায় শুকিয়ে মারে, নিজের পোষাকের জৌলুস দেখাতে গিয়ে অন্যকে ছিন্ন কন্থা ব্যবহার করতে বাধ্য করে, নিজের প্রাণ শক্তিকে বাড়াতে গিয়ে অন্যের প্রাণরস শোষণ করে৷ জীবের সামূহিক স্বার্থের কথা ভাবতে গেলে তাই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ প্রয়োজন৷
এই পৃথিবীর ভোগ্যবস্তুর পরিমাণ সীমিত, অথচ প্রয়োজন সকলকারই৷ একজনের প্রাচুর্যের ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের গ্রাসাচ্ছাদনে টান পড়ে৷ এই অন্যের প্রয়োাজনের কথা বুঝতে না পারাটাই ব্যাধি৷ এই ব্যাধিতে যারা ভুগছে তারও বৃহৎ মানব–পরিবারেরই সদস্য–তারাও ভাই৷ মানবিক আবেদনে অথবা অবস্থার চাপ সৃষ্টি করে’ তাদের ব্যাধি সারাবার ব্যবস্থাই করতে হবে, তাদের ধ্বংস করবার চিন্তাও মহাপাপ৷