এক দেশ এক নির্বাচন--- যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংহতির পরিপন্থী

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

দেশের বর্তমান সরকারের সবকিছুকে এক করে দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে৷ এক ভাষা, এক দেশ, এক ধর্মমত এই প্রবণতার শেষ সংযোজন এক দেশ এক নির্বাচন৷ এটা বাস্তবায়িত করতে সরকার অনেক বেশী দৃঢ়৷ যদিও সংসদে একক গরিষ্ঠতা না থাকায় সরকারকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে৷ কারণ সরকার চালাতে শরীক দলের মন রক্ষা করেও চলতে হবে৷ এক দেশ এক নির্বাচন--- জোট সরকারের বৃহত্তম শরীকের এই মনভারের সঙ্গে সব শরীক এক নাও হতে পারে৷

বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে ভারতও একটি বৈচিত্র্যময় দেশ৷ শুধু ভূপ্রকৃতি ও ভৌগোলিক পরিবেশই নয়, ভাষা-কৃষ্টি সংস্কৃতি, চালচলন আচার-আচরণ, আহার-বিহার,পোষাক-পরিচ্ছদ সামাজিক রীতি-নীতি এমনকি নৃতাত্ত্বিক গঠনেও রয়েছে বৈচিত্র্য৷ এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই রয়েছে ভারতআত্মার একতার সুর৷ নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন-মহান৷ ভাষা-কৃষ্টি-সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশ ভূ-প্রকৃতিগত, ভৌগোলিক অবস্থানগত নৃতাত্ত্বিক গঠনগত পার্থক্যই গড়ে দিয়েছে নানা জনগোষ্ঠী ও তার নিজস্ব ভৌগোলিক অঞ্চল৷ এই নানা জনগোষ্ঠী ও ভৌগোলিক অঞ্চল নিয়ে ভারত এক বৈচিত্র্যময় একতার দেশ৷ তাই ভারতবর্ষকে বলা হয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য৷’

রাষ্ট্রগতভাবেও ভারত এক নয়, তাই বলা হয় ভারত যুক্তরাষ্ট্র৷ ব্রিটিশপূর্ব ভারত নানা রাজা নবাব বাদশার শাসনে ছিল৷ বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শাসক ব্রিটিশ সারা ভারতবর্ষকে এক শাসনের ছত্র-ছায়ায় আনলেও পরবর্ত্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী ভাবাবেগকে দুর্বল করতে ধর্মীয় মতবাদগত পার্থক্যকে ব্যবহার করে কৌশলে জনগোষ্ঠীগত বিভেদ সৃষ্টি করে৷ ভারতের ক্ষমতালোভী নির্র্বেধ রাষ্ট্র নেতারা ব্রিটিশের ফাঁদে পা দিয়ে ধর্মীয় মতবাদগত কারণে দেশভাগকে মেনে নিয়েই স্বাধীনতা গ্রহণ করে৷ দেশভাগের সেই অভিশাপ আজও ভারতবাসীকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে৷

তবুও ভারতবর্ষ আজও একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নানা ভাষা-ভাষী ধর্মমত ও বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের নানা জনগোষ্ঠীর একটি দেশ৷ বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলের সবকিছুকে এক করে দেবার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে৷ এক ভাষার দেশ, এক ধর্মমতের দেশের আওয়াজ তুলে হালে পানি না পেয়ে এখন এক দেশ, এক নির্বাচনের আবাজ তুলেছে৷ তবে প্রবনতা সেই এক ভাষা এক ধর্মমতের দিকেই৷

অর্বাচীন নেতারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি৷ কোন একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব রাষ্ট্রীয় সংহতির সহায়ক নয়, বিশেষ করে সেইসব দেশ যেখানে নানা ভাষা-ভাষী, নানা ধর্মমতের, নানা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী মানুষের বাস৷ রুশিকরণ করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেছে, ধনতন্ত্র ও সাম্যবাদ দুই জার্র্মনকে পৃথক রাখতে পারেনি বার্লিন প্রাচীর ও বিদ্যুৎ প্রবাহিত কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে৷ জোরপূর্বক উর্দু চাপাতে গিয়ে পূর্বপাকিস্তানকে হারিয়েছে পাকিস্তানের পশ্চিমী শাসকরা৷ এক ধর্মমতের অনুগামী হয়েও আরব দেশগুলো এক রাষ্ট্র গড়তে পারেনি৷ ভারতের বর্তমান শাসকরা ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই নেয় নি৷

এখন সংবিধান সংশোধন করে এক দেশ এক নির্বাচনের আইন প্রণয়ন করতে চাইছে৷ যা খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা৷ ভারত যুক্তরাষ্ট্রে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রে ও রাজ্যে পৃথক দলের বা একই দলের শাসনও যদি থাকে---কোন কারণে সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারিয়ে যদি কোন রাজ্যে সরকার পড়ে যায়, পরবর্তী নির্বাচন যদি কয়েক বছর পরে হয় তখন সেই রাজ্যের জনগণ তাদের নির্বাচিত শাসকের শাসনে থাকবে না৷ আবার কেন্দ্রীয় সরকার যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে পড়ে যায়, তখন যদি নির্বাচনের প্রয়োজন হয়, তখন সব রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে সময়ের অনেক আগেই ফেলে দিয়ে নির্বাচনে যেতে হবে৷ এর ফলে রাজ্যবাসী অসন্তুষ্ট হতে পারে, রাজ্যে অরাজকতা বাড়তে পারে, জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা দেখা দেবে৷

ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে কিন্তু এক দেশ এক নির্বাচন সমাধান নয়, আসলে রাজতন্ত্র বিদায় নিলেও শাসকের মনে রাজা হওয়ার বাসনা রয়ে গেলে, বা নিজেকে সম্রাট ভাবার প্রচ্ছন্ন বাসনা থেকেই গণতন্ত্রের পরিপন্থী শাসনব্যবস্থার প্রবণতা পেয়ে বসে৷ ভারতের বর্তমান শাসকদের এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংহতি বিপন্ন করবে৷