কিছুদিন আগে জনৈক সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ্যাটম বোমের বিধবংসী কার্যকারিতা সম্বন্ধে ও মানুষ জাতির ওপর তার ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আপনার মত কী?’’ সাধারণতঃ সাংবাদিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকে না৷ কিন্তু আমি এই প্রশ্ণের উত্তর দিয়েছিলুম৷ এই প্রশ্ণের উত্তরে লেছিলুম ‘‘এ্যাটম বোমের শক্তির চেয়ে মানুষের শক্তি অনেক বেশী৷ সুতরাং এ্যাটম বোমে মানুষকে শেষ করে দেবে--- এরকম ভাবা মানে মানুষের মনীষাকে, মানুষের মানসিক শক্তিকে অপমান করা৷ কারণ, মানুষ এ্যাটম বোমেকে তৈরী করেছে৷ মানুষ এ্যাটম বোমের স্রষ্টা৷ সুতরাং মানুষকে কি এ্যাটম বোমে ধবংস করতে পারে? এখন কথা হচ্ছে , মানুষ অনেক মারণাস্ত্র এর আগেও আবিষ্কার করেছে--- যে মারণাস্ত্র মানুষকে মেরে ফেলে৷ এ্যাটম বোমও সে বিচারে মানুষ মারতে পারে--- এক সঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোক মারতে পারে৷ মানুষের তৈরী এমন বড়বড় মেসিন রয়েছে, যে মেসিন চালাতে গিয়ে কত লোক মারা যায়৷ এ্যাটম বোমের থেকে মানুষের সেই ভয় তো আছেই! উত্তরটা ঠিক তাও নয়, উত্তরটা হচ্ছে, এ্যাটম বোমের স্রষ্টা মানুষ--- এ্যাটম বোমের যে জড় শক্তি আছে--- যে স্থূল শক্তি আছে, মানুষের স্থূল শক্তি তার চেয়ে অনেক কম৷ একথা ঠিক ৷ যেমন হাতীর যা স্থূল শক্তি মানুষের তার চেয়ে অনেক কম কিন্তু হাতীর ওপরে বসে থাকা ছোট্ট একটি মাহুত --- হাতীর শক্তি তার শক্তির চেয়ে পঞ্চাশ গুণ বেশী--- তবুও ছোট্ট একটি মাহুত তাকে চালাচ্ছে তো! কারণ হাতীর শক্তি যত বেশীই হোক না কেন, মানুষের স্থূল শক্তি যত কমই হোক না কেন, মানসিক শক্তিতে হাতীর চেয়ে মানুষ অনেক বেশী এগিয়ে আছে৷ ঠিক তেমনি, এ্যাটম বোমেকে যদি ধরা যায় একটা বিরাট রাক্ষস--- একটা বিরাট পিশাচ, যার জড় শক্তি আছে কিন্তু মানসিক শক্তি নেই, তবুও মানুষ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ শুধু তাই নয়, তার শক্তিকে প্রতিহত করার জন্যে যে কোন অস্ত্র মানুষ অনায়সেই আবিস্কার করতে পারে--- যার কাজ হবে এ্যাটম বোমের বিধবংসী প্রতিক্রিয়াকে অরোধ করা, আটকে দেওয়া৷ এখন কথা হচ্ছে, স্রষ্টা যেখানে অণু মন (Unit mind) সেখানে সৃষ্টি যত বেশী জড় শক্তির অধিকারী হোক না কেন, তার মানসিক শক্তি মানুষের অণুমনের শক্তির চেয়ে সব সময়ই কম থাকবে৷
এখন মানুষ যে সকল জিনিস তৈরী করে থাকে, তাতে জড় শক্তিই থাকে, মানসিক শক্তি থাকে না৷ এ্যাটম বোমের মন বলে কোন জিনিস নেই৷ কিন্তু ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো এমন জিনিসও তৈরী করবে--- তার আভাস তো পূর্বেই দিয়েছি--- যার মনও থাকবে কিন্তু সেক্ষেত্রে তার মন স্রষ্টার মনের চেয়ে দুর্বল হবে৷ তার জড় শক্তি বেশী হতে পারে --- অবশ্যই হতে পারে৷ সুতরাং এ্যাটম বোমে থেকে ‘‘কী হবে গো’’ বলে কেঁদে আকুল হবার মত কোন সংগত কারণ নেই৷
মানুষের ভয় পাওয়ার জিনিস একটাই আছে৷ সেটা হচ্ছে এই যে মানুষের শরীরে যারা পিশাচ, বিরাট মানসিক শক্তির অধিকারী হয়েও পিশাচ, যারা র্কেল মানুষের ক্ষতি করেই যাচ্ছে--- তাদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে৷ তাদের থেকে বাঁচবার জন্যে সমবেতভাবে চেষ্টা করতে হবে৷ এটাই ভয়--- কিন্তু --- এই ভয় থেকে বাঁচবার উপায় কী?
‘‘যতো াচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ৷
আনন্দং হ্মণো বিদ্বান্ ন বিভেতি কুতশ্চন৷’’
এই যে মানসিক শক্তি এটা সেই অসৎ মানুষ কার কাছ থেকে পেয়েছে? --- না , পরমপুরুষের কাছ থেকে পেয়েছে৷ আর যে সৎ মানুষ অসৎ মানুষ থেকে ভয় পাচ্ছে, তার মানসিক শক্তিও পরমপুরুষের কাছ থেকে এসেছে৷ সুতরাং সে এককভাবে লড়ছে --- এরকম না ভেবে যদি ভাবে যে ‘‘আমি পরমপুরুষের সন্তান, পরমপুরুষের নির্দিষ্ট কাজ করার জন্যেই পৃথিবীতে এসেছি, আমি কখনও একলা নেই, সব সময়ই আমি একটা ছোট্ট শিশু, সব সময়ই আমি পরমপুরুষের কোলে বসে’ আছি’’--- তাহলে সে কাকে ভয় পাবে, কেন ভয় পাবে? ভয় পাওয়ার কোন কারণই নেই৷ ‘‘ন বিভেতি কুতশ্চন’’--- সে বিশ্বের কোন শক্তিকে ভয় পাবে না৷ সেক্ষেত্রে এ্যাটম বোমে তো অতি তুচ্ছ, তার চেয়েও অনেক শক্তিশালী অস্ত্র মানুষ ভবিষ্যতে আবিষ্কার করবে কিন্তু সৎ মানুষের সে সকল অস্ত্র থেকে ভয় পাওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই৷
(সন্ধ্যাবেলা, ২রা নবেম্বর, ১৯৭৮, কলকাতা)