প্রাচীনকালে দীক্ষার দু’টি পদ্ধতি ছিল৷ এই দুই দীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে প্রথম ছিল বৈদিকী দীক্ষা৷ দ্বিতীয় তান্ত্রিকী দীক্ষা অর্থাৎ প্রথমে ক্ষৈদিক বিচার–আচার–পদ্ধত অনুযায়ী দীক্ষা আর তন্ত্রানুসারী দীক্ষা৷ বৈদিকী দীক্ষার মুখ্য মন্ত্র ছিল গায়ত্ত্রী মন্ত্র৷ বৈদিকী দীক্ষার মূলনীতি ছিল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সৎপথ তথা আনন্দম্–এর পথ–নির্দেশ করা৷ তান্ত্রিকী দীক্ষার মূল নীতি ছিল সেই পথে এগিয়ে চলা৷ প্রথমটায় পরমাত্মার কাছে পথ– প্রদর্শনের জন্যে প্রার্থনা করা, আর দ্বিতীয়টিতে সাধক এগিয়ে চলে সেই পথে৷ তাই তান্ত্রিকী দীক্ষালাভের পরে সাধককে গুরুর নির্দেশানুসারে অগ্রসর হতে হয়৷
বৈদিকী দীক্ষায় প্রমুখ মন্ত্র ছিল গায়ত্ত্রী মন্ত্র৷ গায়ত্ত্রীর অর্থ কী? গায়ত্ত্রীকে মন্ত্র বলে অভিহিত করা এক সাধারণ ভুল৷ বেদে আছে সাতটি স্বীকৃত ছন্দ–গায়ত্ত্রী, উষ্ণিক, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ, বৃহতী, জগতী আর পংক্তি৷ তাই গায়ত্ত্রী একটি ছন্দ, মন্ত্র নয়৷ বৈদিকী দীক্ষার এই মন্ত্রটি গায়ত্ত্রী ছন্দে রচিত৷
গায়ত্ত্রী ছন্দের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে– এই ছন্দে কবিতা রচনা করতে হলে চব্বিশ মাত্রার প্রয়োজন আর তাতে থাকবে তিন পংক্তি৷ প্রত্যেক পংক্তিতে আটটি মাত্রা তাই ৩ x ৮ = ২৪ মাত্রা৷ প্রত্যেক বেদমন্ত্রের জন্যে তিন প্রয়োজনীয় তত্ত্ব বা আবশ্যকতা আছে৷ এই তিনটি হচ্ছে ছন্দ, ঋষি আর দেবতা৷ ছন্দের তাৎপর্য সমান তাল তথা মাত্রা যাতে মন্ত্র রচিত৷ এখানে এই বিশেষ মন্ত্রের ছন্দ হচ্ছে–
‘‘গায়ত্ত্রী গায়ন্তম্ তারয়েৎ যস্তু সঃ গায়ত্ত্রঃ’’৷ যে ছন্দে গাইলে গায়ক মুক্তির পথ পেতে পারে তাই গায়ত্ত্রী৷ গৈ + শতৃ + ত্রৈ + ড + ঙীষ্ = গায়ত্ত্রী৷ তাই প্রথম আবশ্যকতা হ’ল ছন্দ৷ দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় তত্ত্ব দেবতা আর তৃতীয় হ’ল ঋষি৷
কোনো মন্ত্রে পরমাত্মার [দেবতা] জন্যে এক বিশেষ শব্দ প্রযুক্ত হয়, আর সেই অনুযায়ী মন্ত্রের নামকরণ হয়৷ এই বিশেষ মন্ত্রে সবিতা শব্দের দ্বারা পরমাত্মাকে সম্বোধিত করা হয়েছে–‘তৎ সবিত্যুর্বরেণ্যম্’৷ তাই মন্ত্রের বৈদিক নাম ‘সবিতৃ ঋক্’৷ বেদে মন্ত্রকে বলা হয় ঋক্৷ এই মন্ত্রে পরমপুরুষের জন্যে ‘সবিতা’ শব্দ ব্যবহূত হয়েছে৷
তৃতীয় প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ঋষি৷ ঋষির অর্থ তিনি যিনি মন্ত্রের রচয়িতা৷ সেই যুগে বৈদিক ঋষি মন্ত্র লিখতে পারতেন না কেননা তখন লিপির অস্তিত্ব ছিল না৷ মধ্য এশিয়া আর দক্ষিণ এশিয়ার আর্যরা লিখতে জানত না৷ তারা ভারতের স্থানীয় মানুষ দ্রাবিবদের কাছ থেকে লেখার পদ্ধতি শিখেছিল৷ সংস্কৃত প্রথমে বিভিন্ন লিপিতে লিখিত হত৷ পঞ্জাবে সারদা লিপিতে, মণিপুর–ত্রিপুরাতে ক্ষাংলা লিপিতে, উত্তর বিহারে মৈথিলী লিপিতে, ওড়িষ্যাতে ওড়িয়া লিপিতে, অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু লিপিতে৷ বর্তমান কালে প্রচলিত সংস্কৃত দেবনাগরী লিপিতে লিখিত হয়৷ কিন্তু দেবনাগরী সংস্কৃতের নিজস্ব লিপি নয়৷
ঋষিরা বৈদিক মন্ত্র রচনা করতেন আর তাঁদের শিষ্যরা কাণে শুণে তা স্মরণ রাখতেন, শ্রুতির অর্থ শ্রবণ করা ৷ এই জন্যে বেদকে শ্রুতিও বলা হয়৷ বৈদিক শব্দাবলীতে বৈদিক মন্ত্রের রচয়িতা ঋষিকে দ্রষ্টা বলা হয়৷ যিনি নিজের মানস–চক্ষে সত্যদর্শন করেছেন তিনিই দ্রষ্টা৷ ঋষির অর্থ সভ্য ও সংসৃক্তিবান মানুষ৷ গায়ত্ত্রী মন্ত্রের ঋষি বিশ্বামিত্র৷ যে ছন্দে এটি রচিত তা গায়ত্ত্রী৷ এটি ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডল বা অধ্যায় থেকে গৃহীত৷ ছন্দ গায়ত্ত্রী আর দেবতা হলেন সবিতা৷ এই জন্যে মন্ত্রকে বলে সবিতৃ ঋক্ আর রচয়িতা ঋষি বিশ্বামিত্র৷
আমি যেরকম বললুম যে, গায়ত্ত্রী মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে তিনটি পংক্তি থাকবে আর প্রত্যেক পংক্তিতে থাকবে আটটি মাত্রা৷ মন্ত্রের মূল রূপ এই রকম ছিল৷
‘‘ওঁং তৎসবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গোদেবস্য ধীমহি
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ৷’’
মূল মন্ত্রে ‘‘ওঁং ভূর্ভুবঃ স্বঃ ওঁং’’ অংশটি ছিল না৷ এখানে এই মন্ত্রের প্রথম পংক্তি ‘‘তৎ সবিতু– বরেণ্যম্’’৷ এখন মন্ত্রের অর্থ কী? ‘‘মরণাৎ তারয়েৎ যস্তু স মন্ত্রঃ পরিকীর্ত্তিতঃ৷’’ মন্ত্র হ’ল মানসিক জপ৷ যে মানসিক জপে মুক্তি পাওয়া যায় তাকেই মন্ত্র বলে৷ মানসিক জপের অর্থ আন্তরিক জপ৷
মন ত্রৈ ড ঞ্চ মন্ত্র৷ প্রথম পংক্তি ‘‘তৎ সবিত্যুর্বরেণ্যম্’’ দ্বিতীয় পংক্তি ‘‘ভর্গো দেবস্য ধীমহি’’ তৃতীয় পংক্তি ‘‘ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’’৷
দ্বিতীয় পংক্তিতে আছে–ভ, র্গো, দে, ব, স্য, ধী, ম, হি এইগুলি মাত্রা আর তৃতীয় পংক্তিতে আছে– ধি, য়ো, যো, নঃ, প্র, চো, দ, য়াৎ এই আটটি মাত্রা৷ কিন্তু প্রথম পংক্তিতে আছে তৎ, স, বি, তুর, ব, রে, ন্যম্ এই সাতটি মাত্রা৷ তাই এই পংক্তির বৈদিক নিয়মানুসারে যদি ব্যাকরণ আর ছন্দের মধ্যে বিরোধাভাস থাকে তবে ছন্দের জয় হবে, ব্যাকরণের নয়৷
তাহলে এই পংক্তির উচ্চারণ এইভাবে হওয়া উচিত–তৎ, স, বি, তুর, ব, রে, ণি, অম্ – আটটি মাত্রা৷ তাই এই মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ হবে–
‘‘ওঁং ভূ–র্ভূবঃ স্বঃ
ওঁং তৎসবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গোদেবস্য ধীমহি
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ ওম্৷’’
এখন ওঁং (ওম্) এর অর্থ কী৷ যখনই কোনো কর্ম সম্পন্ন হয় তাতে স্পন্দনের সৃষ্টি হয়, একটি (মানসিক) চিত্র তৈরী হয়ে যায়৷ ধ্বনির সৃষ্টি হয়৷ বর্ণের সৃষ্টি হয়৷ প্রত্যেক কর্মের জন্যে অনুরূপ স্পন্দন, অনুরূপ ধ্বনি উৎপন্ন হবে৷ তুমি চলছ তো খট্–খট্–খট্ অথবা থপ্–থপ্–থপ্ ধ্বনির সৃষ্টি হবে৷ এই ধ্বনি চলার স্পান্দনিক ধ্বনি৷ তুমি হাসছ–হা, হা, হা ধ্বনির সৃষ্টি হচ্ছে৷ হা–হা ধ্বনি হাস্য রূপ কার্যের স্পান্দনিক প্রতিরূপ৷ কোনো কর্মের স্পান্দনিক ধ্বনিকে সংসৃক্তে বলে বীজমন্ত্র৷ এইভাবে হাস্য–কর্মের বীজ হা–হা, চলার বীজ খট্–খট্৷
বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে ভূমা চৈতন্যের মধ্যে সৃষ্টি রচনা করার ইচ্ছা জাগরিত হ’ল, আর ভূমা মানসে তৈরী হয়ে গেল এক বিশেষ তরঙ্গ৷ পরমপুরুষ কিছু রচনা করেন সৃষ্টির ইচ্ছা নিয়েই৷ এই মানসিক কর্ম পরমপুরুষের মনে কিছু মানসিক ধ্বনি উৎপন্ন করল৷ এইভাবে ভূমামনে সৃষ্টির ইচ্ছা অ––– ধ্বনি উৎপন্ন করল৷ তাই অ–ধ্বনি সৃষ্টির বীজমন্ত্র৷
‘অ’ সৃষ্টির প্রথম ধ্বনি৷ তাই তান্ত্রিক বর্ণমালায় ‘অ’ প্রথম অক্ষর৷ ‘অ’ আর্য–ভারতীয় বর্ণমালারও প্রথম অক্ষর৷ হিব্রু (ইহুদী) আর গ্রীক লিপিতেও ‘এ’ প্রথম অক্ষর আর আরবী লিপিতে ‘অলীফ’ কেননা সৃষ্টির বীজমন্ত্র৷
সৃষ্টির পরে সৃষ্টি পালনের ইচ্ছা তৈরী হবে৷ শিশুর জন্মের পরে তার পালন–পোষণের প্রয়োজন আছে, তাই পালন হচ্ছে দ্বিতীয় স্তর৷ পালনের স্পান্দনিক ধ্বনি ‘উ’৷ তাই পালনের বীজাক্ষর ‘উ’৷ ‘অ’ সৃষ্টির বীজ আর ‘উ’ পালনের বীজ৷ অন্তিম স্তর হচ্ছে প্রণাশের স্তর৷ প্রণাশের বীজাক্ষর হ’ল ‘ম’৷ এইজন্যে বর্গীয় বর্ণমালায় ‘ম’ শেষ অক্ষর৷ বর্গ পাঁচটি–‘ক’, ‘চ’, ‘ট’, ‘ত’ আর ‘প’ বর্গ৷ ‘প’ বর্গ শেষ বর্গ আর তার শেষ অক্ষর ‘প’, ‘ফ’, ‘ব’, ‘ভ’, ‘ম’৷ তাই ‘ম’ প্রণাশের বীজমন্ত্র৷
পরমপুরুষের সমস্ত ক্রিয়ামূলক সাক্ষীত্বের সামূহিকতা ‘অ’, ‘উ’, ‘ম’৷ এদের মিলিত রূপ ‘ওম্’ (ওঁং) ধ্বনি৷ ‘ওঁং’ বিশ্বের বর্ণ–মাতৃকা (causal matrix)
ওঁং ভূ–র্ভুবঃ স্বঃ.......’’৷ মন্ত্রের আরম্ভ ‘ওং’ ধ্বনির দ্বারা৷ ‘অ’ সৃষ্টির প্রতিরূপ, ‘উ’ পালনের আর ‘ম’ –Generation, operation, destruction¼ ‘Generation’ শব্দের প্রথম অক্ষর ‘G’৷ ‘Operation’’–এর ‘O’, আর Destruction ‘D’ = GOD
৮ ডিসেম্বর ১৯৬৪, সালেম