আজকের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই মানস-অর্থনীতি আর গণ-অর্থনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত–আর তাই তাঁদের বর্ত্তমান অর্থনৈতিক ধ্যান–ধারণায় অর্থনীতির এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখাই কোন স্থান পায়নি৷
কোনো অর্থনীতিকে উন্নত অর্থনীতি (Developed Economy) অভিধায় অভিহিত করতে গেলে তাতে থাকবে চারটি মুখ্য ধারা–
প্ত গণ-অর্থনীতি (People’s Economy)
প্ত সাধারণ অর্থনীতি (General Economy)
প্ত মানসভৌম-অর্থনীতি (Psycho-Economy)
প্ত বাণিজ্যিক-অর্থনীতি (Commercial Economy)
অর্থনৈতিক জগৎকে কেন্দ্র করে’ সমকালে যত ভাবনা–চিন্তা–মতবা গড়ে’ উঠেছে–অর্থনীতির এই চারটি বিভাজন তার পরিধি অনেক বেশী বাড়িয়ে তুলল৷ এর মূল উদ্দেশ্য হ’ল ক্রমবর্দ্ধমান হারে মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা৷ প্রাউট ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এক সুসন্তুলিত অর্থনীতিকে কায়েম করতে চায়৷ প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রাউট পরিকল্পিত অর্থনীতিকে সমর্থন করে৷
অর্থনীতির এই চারটি মুখ্য ধারা নিয়ে সংক্ষেপে একটু আলোচনা করা যাক৷
গণ-অর্থনীতি
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, যানবাহন ব্যবস্থা, শক্তির যোগান, জলের সরবরাহ ইত্যাদি অত্যাবশ্যক জিনিসগুলি যাতে সহজেই পাওয়া যায়, ও তাদের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটানো যায়–অর্থনীতির এই শাখাটি সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য দেবে৷ যেহেতু গণ-অর্থনীতি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন তথা জনগণের সমস্যা নিয়ে কাজ করবে, তাই অর্থনীতির অন্যান্য শাখার চেয়ে এই শাখাটির গুরুত্ব অধিক৷ তাই গণ-অর্থনীতির উন্নতির পেছনে সাংবিধানিক ক্ষমতাও কাজ করবে৷ উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি যদি কখনো কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাবে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে যে শিল্প–প্রতিষ্ঠানগুলি অর্থনৈতিক বিচারে লাভ জনক বলে’ গণ্য হচ্ছে না সেগুলিকে খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন তথা সরবরাহের কাজে লাগানো যাবে৷ গণ-অর্থনীতির পরিভূর মধ্যে আসবে–সার্বিক কর্মসংস্থান, সার্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ অর্থনীতি, যারা সত্যিকারের উৎপাদনের জন্যে কায়িক ও বৌদ্ধিক শ্রম দিচ্ছে তাদের হাতে যাতে সমস্ত জমি চলে যায় তার জন্যে পর্যায়ক্রমিক সামাজিকীকরণ, সংশ্লিষ্ট শহর ও গ্রামীণ এলাকার মানুষের যাতে কর্মসংস্থান হয় তার জন্যে তাদের নৈপুণ্য শিক্ষণের প্রশিক্ষণ–প্রকল্প, কর্মবিভাজন, যানবাহন, দ্রব্যসামগ্রীর পরিবহন, লোডিং ও আন–লোডিং সমস্যা ইত্যাদি৷ যদিও এদের অনেকগুলিই অর্থনৈতিক বিচারে লাভজনক বিবেচিত নাও হতে পারে তবুও তারা অর্থনীতির এই শাখাটির বিষয় বলেই বিবেচিত হবে৷ গণ-অর্থনীতির আরও একটি দিক হবে শক্তি (Power) ও জল সরবরাহ, কারণ মানুষকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হতে গেলে ক্ষুদ্রায়তন ও সুলভ শক্তি ও জল সরবরাহের ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক৷ পরিশেষে একথাই বলব যে, গণ-অর্থনীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্র্ণ বিষয় হ’ল–অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ, গণশক্তি (People’s Power), সামবায়িক শক্তির উৎস, ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা৷
মানস-অর্থনীতি
মানস-অর্থনীতির বিষয় হ’ল যথোপযুক্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক মনকে অধিক থেকে অধিকতর আভোগ (pabula) সরবরাহ করা৷ যেখানে মানুষের জীবনধারণের সমস্যার সমাধান হয়েছে সেখানে মানস-অর্থনীতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে৷ যে দেশে অর্থনীতি অতি উন্নত ও যান্ত্রিকীকরণের চূড়ান্ত প্রয়োগ ঘটেছে, যেখানে মানুষ সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টা কাজ করবে, ও হাতে প্রচুর অবসর–সেই সব দেশে মানস-অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম৷
মানস-অর্থনীতির থাকবে মূলতঃ দুটি শাখা৷ একটি শাখার প্রচেষ্টা হবে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, আচার–আচরণ ও সংরচনা (structure)৷ মানুষের সমাজে যে শোষণ ও অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে তার দূরীকরণ করা৷ এই মানস-অর্থনীতি সর্ববিধ অর্থনৈতিক ও মানস-অর্থনৈতিক শোষণকে প্রতিহত করবে৷ মানুষকে সচেতন করবে–কীভাবে পুঁজিপতিরা এককভাবে ও যৌথভাবে তাদের বিপুল প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে সমাজকে শোষণ করে’ চলেছে, সমাজে একটি অস্বাস্থ্যকর কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে’ চলেছে–যা মানুষের মনকে বিষিয়েই দিচ্ছে না, বরং এমন কতকগুলি মারাত্মক কু–ভ্যাসকে উৎসাহিত করছে, যা মানসিক শুচিতা ও প্রসারের পরিপন্থী৷ মানস-অর্থনীতির প্রথম ও প্রধান কর্ত্তব্য হ’ল আজকের সমাজে যে ধরণের ক্ষতিকারক ও মানবতাবিরোধী অর্থনৈতিক প্রবণতা চলছে তার বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া৷
মানস-অর্থনীতির দ্বিতীয় শাখাটির কাজ হবে বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক মনের আভোগের হ্ম্ত্রত্ব্ব্ভপ্ত্ত্রগ্গ বৃদ্ধি ও উন্নতি ঘটানো৷ আজকের অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতির এই শাখাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত বললেই চলে৷ কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা বলে’ পরিগণিত হবে৷ বিশেষ করে’ যখন মানুষ তার জড়–জাগতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করে’ ফেলবে তখন এই মানস-অর্থনীতি আরও বেশী প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠবে৷ সৃষ্টির বুকে মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের উপযোগ নিতে, ও সর্ববিধ অর্থনীতির সর্জনশীল সমাধান খুঁজে বের করতে এই মানস-অর্থনীতি এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করবে৷ ভবিষ্যতের নেতারা সামূহিক মনস্তত্ব জিনিসটা কী, ও কী করে’ এটাকে পরিচালিত করা যায় সেটা যত বেশী করে’ জানবে, ততই মানস-অর্থনীতির বিশেষ গুরুত্ব উপলব্ধি করবে৷
মানস-অর্থনীতিতে মুখ্যতঃ যে বিষয়গুলি স্থান পাবে তারা হ’ল সুসন্তুলিত অর্থনীতি (Balanced Economy), উৎপাদনের বিষয়–নির্বাচন, আর্থিক ব্যয়–বরাদ্দ, কাজের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, পূর্বাদ্রনীতির প্রয়োগ,* সার্বিক কর্মসংস্থান–নীতি, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় শ্রমিকের ভূমিকা, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, উৎসাহ–প্রদাননীতি ক্রমবর্দ্ধমান উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি, অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে মনস্তাত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক প্রভাব, উৎপাদন–বৃদ্ধি ও শ্রম–হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ, জীবনের মান–উন্নয়ন, ব্যবসায়–নীতি, সুষ্ঠু সামবায়িক উদ্যোগের নীতি–নিয়ম ইত্যাদি৷ সংক্ষেপে বলতে গেলে, অর্থনৈতিক জীবনের যা কিছু প্রত্যক্ষভাবে বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও বিকাশকে প্রভাবান্বিত করে, তার সমস্তই মানস–অর্থনৈতিক আলোচনার পরিভূর মধ্যেই পড়বে৷
বাণিজ্যিক অর্থনীতি
অর্থনীতির এই শাখাটি মুখ্যতঃ দেখবে কীভাবে বৈজ্ঞানিক ও উন্নত উৎপাদন পদ্ধতির দ্বারা আর্থিক ক্ষতিকে এড়ানো যায়, ও যাতে কম বিনিয়োগে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়৷ বাণিজ্যিক অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হবে বিশ্বের যাবতীয় সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ ও সুষম বণ্টনকে বাস্তবায়িত করা৷ অন্যান্য বিষয়গুলি হবে–অর্থকরী ফসল নির্বাচন, উৎপাদন ও বণ্টন, অঞ্চলভিত্তিক ও আন্তরাঞ্চলিক নীতি, আমদানী ও রপ্তানী, সুসংহত বিপণন ব্যবস্থা, মুনাফার হার নির্ণয়, কষ্ট–এক্যাউন্টিং বা পরিব্যয়–হিসাব, লাইসেন্স–নীতি, প্রযুক্তিবিদ্যার স্থানান্তর নীতি, প্রযুক্তিগত মান নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত ও লেনদেন নীতি, মূলধন সৃষ্টি, ঋণসংক্রান্ত নীতি, সরকারী হস্তক্ষেপ, আর্থিক ও সরকারী রাজস্ব–নীতি, ব্যাংক–ব্যবস্থা, মূলধন যোগান, বিনিময়–ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা, বাণিজ্যিক–সংঘটন কৃষি–সহায়ক, কৃষিজ ও অ–কৃষি শিল্পের পরিকল্পনা প্রভৃতি৷
সাধারণ অর্থনীতি
সাধারণ অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় হবে এ যাবৎ প্রচলিত অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলি–তা সে ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বা প্রাউটিষ্ট–যাই হোক না কেন৷ আজকাল সাধারণ অর্থনীতির নাম দিয়ে যার পঠন–পাঠন হচ্ছে তাও সাধারণ অর্থনীতির আওতাভুক্ত৷ সাধারণ অর্থনীতি নিয়ে ইতোমধ্যে* কিছু আলোচনা হয়েছে একথা ঠিক, তবুও এই শাখাটির যথেষ্ট প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে৷ সাধারণ অর্থনীতির আরও আলোচ্য বিষয় হবে অর্থনৈতিক ইনফ্রাষ্ট্রাকচার, সর্বস্তরে অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় সমন্বয় সাধন, ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, জনসংখ্যা নীতি, কর্মসংস্থান নীতি, সার্বিক কর্মসংস্থান নীতি, কৃষি–শিল্প সমন্বয় নীতি, অর্থনীতির সামাজিকীকরণ, সামবায়িক সংস্থাগুলির ক্রমোন্নয়ন, ৰ্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি, মাইক্রো–ম্যাক্রো অর্থনৈতিক সমস্যা, কর ব্যবস্থা, শহর ও গ্রামের উন্নয়ন ব্যবস্থা, বিকেন্দ্রীকরণ, শিল্পের ক্ষেত্রে স্তরবিন্যাস, প্রতিরক্ষা প্রকল্প ও ব্যয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক আয়–ব্যয় ব্যবস্থা, উপযুক্ত প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রগতি ইত্যাদি৷