গণ্ডোয়ানাভূমি ও রাঢ়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

এই যে এলাকাটায় আমরা রয়েছি এটা সুপ্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের পূর্ব প্রত্যন্ত৷ একেবারে পূর্ব বলতে পারছি না কারণ একেবারে পূর্বে রয়েছে গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের যে অংশ তাকে আজকের মানুষ রাঢ় বলে জেনে থাকে৷ এই গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের পূর্বদিকের পাহাড়গুলো পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সমান্তরালভাবে চলে গেছে৷ উত্তর দিকে কেবল রাজমহল পাহাড়টি সোজা পূর্বে না গিয়ে উত্তর–পূর্ব কোণে গিয়ে সাহেবগঞ্জের কাছে এসে গঙ্গায় পথ হারিয়েছে৷ গঙ্গাই বললুম যদিও এককালে ওখানে গঙ্গা ছিল না–ছিল সমুদ্র৷ তখন হিমালয়ই তৈরী হয়নি–গঙ্গা আসবে কোত্থেকে! মানুষের নিঃশ্বাস যখন পৃথিবীর হাওয়াকে গরম করেনি এ সেই যুগের কথা৷ একেবারে দক্ষিণের দিকে মেঘাসিনির চূড়ার কাছাকাছি জায়গায় পাহাড় কিছুটা দক্ষিণ–পূর্ব কোণে চলেছে৷ বাকি সব পাহাড়ের গতি পশ্চিম থেকে পূর্বে৷ আর তাদের শেষ উত্তুঙ্গ শিখর ছিল শিখরসমেত আজ যা পরেশনাথ পাহাড় নামেই বেশী পরিচিত৷ এই পরেশনাথ পাহাড়টির পূর্বদিকে ছিল সুপ্রাচীন রাঢ় আর পশ্চিম দিকে ছিল ঝাড়খণ্ড৷ সে অবশ্য পৃথিবীতে মানুষ আসবার পরেকার কথা৷ দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে উপত্যকার নিম্নতম অংশ বেয়ে গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের বরফগলা জল গিয়ে পড়ত বাঁশ, দ্বারকা, ময়ূরাক্ষী, হিংলো, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী, শিলাবতী, কালিয়াঘাই, সুবর্ণরেখা নদীগুলিতে–এরা ছিল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড নদী৷ মানুষ যখন পৃথিবীতে এল, মানুষের চরণস্পর্শে রাঢ়ের সুপ্রাচীন মাটি যখন পবিত্র হল তখন সেই মানুষেরাই এই নদীগুলির তীরে বসতি স্থাপন করেছিল৷ শুধু মানুষেরাই বলি কেন, মানুষের আবির্ভাবের লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক জীবেরাও এই নদীগুলির তীরেই থাকত কারণ জলের দরকার তো সবাইকারই৷....গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্য অংশে তখন দারুণ শীতে তুষার–ঝড় বইত৷ মানুষের উদ্ভূতির পরিবেশ তখন ছিল না৷ রাঢ়ে ছিল উষ্ণতার প্রাণিন স্পর্শ৷ তাই মানুষ এল প্রথমে সেখানেই৷ এই নদীতীরেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা ও সংস্কৃতি–যার নাম দিতে পারি আদি রাঢ়ীয় সংস্কৃতি৷

পৃথিবীতে কেউই থেমে থাকে না–জড়ও না, চেতনও না৷ এই নদীগুলি কেবল যে অস্তিত্বের প্রাণধারা বহন করে চলেছিল তাই নয়৷ সভ্যতা–সংস্কৃতির দুর্নিবার অধিগমনকেও তারা সৰেগে টেনে নিয়ে চলেছিল সাগরসঙ্গমের দিকে৷ নদীর উজানে যে সভ্যতার পত্তন হয় ভাটিতে তা–ই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়৷ একটি নদী যে সভ্যতা বহন করে আর একটি নদী হুবহু তা বহন করে না৷ তাই দুই নদী মিলিত হবার পরে তাদের মিলিত স্রোতোধারা বহন করে নিয়ে যায় আরেকটি তৃতীয় সভ্যতাকে৷ একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত৷..... আমাদের বীরভূমে কোপাই নদী ও বক্রেশ্বর নদী দু’টোই ছোট ছোট নদী৷ দু’য়েরই সভ্যতা–সংস্কৃতির ধারাপ্রবাহ প্রায় এক৷ উভয় তীরের মানুষের কথা ভাষাও প্রায় এক৷ কিন্তু......তারা হুবহু এক নয়৷ তারপরে তারা দু’য়ে যখন ইন্দাস গ্রামের (জৈন যুগের সুপ্রসিদ্ধ ইন্দ্রহাস) কাছে মেলানপুরে মিলিত হয়ে নাম নিচ্ছে কুয়ে নদী, তখন তার স্বাভাবিক সভ্যতা–সংস্কৃতিরও একটু হেরফের হয়ে যাচ্ছে৷ এই কুয়ের উভয় তীরে মানুষ বক্রেশ্বর ও কোপাই দুই নদীরই আশীর্বাদধন্য৷ দুমকা–শিউরী, সাঁইথিয়া ও কাঁদি–চারটি শহরই ময়ূরাক্ষী উপত্যকায়৷ তাদের চালচলন, আচার–ব্যবহার, কথ্য ভাষা একই ধরনের কিন্তু দুমকার খুবই কাছে মান্দার পাহাড়–তা কিন্তু চান্দন নদী উপত্যকায় অবস্থিত৷ তাই তার আচার–আচরণ, কথ্য ভাষা দুমকার থেকে পৃথক৷ কাঁদি ঙ্মকান্দিৰ থেকে দুমকা অনেকখানি কিন্তু তারা সব ব্যাপারেই এক রকম৷ অথচ কাঁদির অনেক কাছে জঙ্গীপুর৷ তার সবকিছুই একটু অন্য রকমের৷ কথ্য ভাষাও শেরশাহাবাদীয়া ৰাংলা৷ সব নদীর ব্যাপারেই ওই একই ইতিহাস৷ রাঢ়ের নদীগুলি যে কেবল বালি–পলি এনে সমুদ্রে ঢ়েলে সমতল ৰাঙলার মাটিই গড়ে দিয়েছে তাই নয়, সভ্যতা–সংস্কৃতি এনেও ৰাঙলার মাটিকে সবুজ করেছে৷

পাতাল থেকে হিমালয়ের অভ্যুত্থানের পর গঙ্গা ৰ্রহ্মপুত্র এরা নিজেদের জলধারার সঙ্গে সভ্যতা–সংস্কৃতির ধারাও বয়ে নিয়ে এল৷ গঙ্গা বয়ে আনল আর্য–ভারতীয় সংস্কৃতি৷ কিন্তু সাহেবগঞ্জের কাছে গঙ্গা দক্ষিণ মুখ হবার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক জীবনে গৌড়ীয় প্রভাব বাড়ল৷ ঠিক তেমনি ৰ্রহ্মপুত্র সদিয়ার কাছে অসম উপত্যকায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে মিলিত হ’ল কিম্পুরুষবর্ষীয় (তিব্বতী) ও সুবর্ণদ্বীপীয় (ৰ্রহ্মদেশ) সভ্যতা৷ এই দুইয়ের সঙ্গে আর্য–ভারতীয় সংস্কৃতির ত্রয়াত্মক মিলনে তৈরী হ’ল কামরূপীয় সভ্যতা যা কিছুটা ভাটিতে গিয়ে বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হ’ল৷

আজকে আমাদের যে ৰাঙ্গালী সভ্যতা ও সংস্কৃতি তার শ্যামলতা, তার সুশোভনতা তৈরী করে দিয়েছে এই রাঢ়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী–উপনদী–বাহিত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও তার সঙ্গে গঙ্গা–সভ্যতা ও ৰ্রহ্মপুত্র সভ্যতার মহামিলনে ৰাঙ্গালী সভ্যতা পেয়েছে তার অলোকসামান্য মাধুর্য৷.... (পরবর্তী অংশ ৮ই জুন সংখ্যায়)