গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দের আসল চরিত্র

লেখক
অমৃতবোধানন্দ অবধূত

বর্তমান মানুষের জীবনযাত্রা প্রযুক্তি নির্ভর৷ তা জীবনে গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে৷ একে প্রগতির দ্যোতক  হিসেবেই  গণ্য করা হয়৷  তবে কিছু কিছু ব্যষ্টি  বা গোষ্ঠী তাৎক্ষণিক লাভের স্বার্থে বিশেষ কোনো প্রযুক্তির  পরিবর্তন ঘটিয়ে সেকেলে পুরোনো ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠার  মতো প্রতিক্রিয়াশীল দাবীও করে থাকেন৷ নির্বাচন কমিশনে ইবিএম EVM) ব্যবহারে কিছু রাজনৈতিক দলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে  এ আলোচনা৷ বিশেষ কোন প্রমাণ ছাড়াই  অনেকে ইবিএম - এর  কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ  প্রকাশ  করে সময়সাপেক্ষ ব্যালটে বোট Vote) গ্রহণের দাবী তুলেছিলেন৷  বোটপর্বকে  স্বচ্ছ  ও যথার্থ করতে নির্বাচন  কমিশন ইবিএম-এর সাথে বিবিপ্যাট V.V. Pat) যুক্ত করেছেন, তাতে বোটাররা নিশ্চিত  হতে পারবেন  যে তারা  তাদের মনোনীত পছন্দের প্রার্থীকে  বোট দিতে পারলেন কি না?  এই পদ্ধতিতে সুপ্রিমকোর্টও সহমত পোষণ করেছেন৷ তা সত্ত্বেও যদি কোন ত্রুটি প্রমাণিত হয় তবে,তাকে সারাই  করতে কমিশনকে  দলগুলোর  পূর্ণ সহযোগিতা করে প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই  হবে প্রগতিবাদীর  লক্ষণ৷ তাতে প্রশাসন ও জনগণের মূল্যবান সময়  ও অর্থের সাশ্রয় হবে৷ তাছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু ঝুঁকি থাকতেই পারে৷  প্রগতির স্বার্থে সবার  সেটাকে মেনে নেওয়া  উচিত, না হলে মানুষ সাগর বা পাহাড়ের ওপর দিয়ে বিমানে  বিদেশ যাত্রার  ঝুঁকি নিত না বা স্মার্টফোন ব্যবহারে শারীরিক, মানসিক অনেক ক্ষতি  হওয়া সত্ত্বেও মানুষ জেনেশুনে সেটা কে জীবন-সঙ্গী করে নিত না৷

বর্তমানে ট্যাক্সি ভ্রমণে অধিক ঝুঁকি রয়েছে বলে আমরা তো আর অতীতের ঘোড়ায় টানা টাঙ্গার প্রবর্তনের দাবি করতে  পারি না!

এবার আসা যাক ভারতীয় গণতন্ত্র প্রসঙ্গে৷ ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মান্য করা হয় বা  ভারতীয়রা তা দাবি করে থাকেন৷ তবে এটা ঠিক যে আজকের  বিশ্বে যত প্রকার  শাসন ব্যবস্থা  রয়েছে  তারমধ্যে গণতন্ত্রকে  মন্দেব ভাল বলা চলে৷ গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের  দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের  শাসন৷  তাছাড়াও বলা হয় ‘‘ডেমোক্রেসি ইজ. ফর দি পিপল্, অব দি পিপল্, এণ্ড বাই দি পিপল্৷

ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে  যে  এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই দারিদ্র্য,কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও রাজনৈতিক অসচেতনতার শিকার৷  এদেশে  ৭৩ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে এক শতাংশ পুঁজিপতিদের হাতে৷ চার বছর আগের এক সমীক্ষায়  প্রকাশিত হয়েছিল যে ভারতে ৬ লক্ষ  সাড়ে ৬৮ হাজারের ওপর পরিবারের আয়ের উৎস ভিক্ষাবৃত্তি৷ ১ কোটি ৪৪ লক্ষ ক্রীতদাস রয়েছে এদেশে৷ অপুষ্টিতে রোগগ্রস্ত হয়ে  প্রতিদিন ৭ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে থাকেন৷ ৪৭ শতাংশ শিশু ৫ বছরের মধ্যে অপুষ্টিতে মারা যায়৷ ভারতে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা শুধু একবোতল মদ আর একটা কম্বল পেলেই আল্লাদে আটখানা হয়ে বোট দিয়ে দেয়৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে,  সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী  যেখানে অসচেতন---বোকা, সেখানে ভারতীয় গণতন্ত্রের মানে দাঁড়াল, বোকাদের জন্য, বোকাদের দ্বারা, বোকাদের নির্বাচিত সরকার৷ এখানে গণতন্ত্র কি বোকাতন্ত্রে পর্যবেসিত হলো না?

এই পরিস্থিতিতে জনগণ এই গণতন্ত্র থেকে কতটা সুশাসন প্রত্যাশা করতে পারেন?

এবার সংবিধানে বর্ণিত ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে  আসা যাক৷ এখানে ধর্ম বলতে হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্টান প্রভৃতিকে বোঝানো হয়েছে৷ প্রকৃত অর্থে এগুলি ধর্ম  নয়, ধর্মকে কেন্দ্র করে মতবাদ৷ নিরপেক্ষ বলা মানেই হচ্ছে ধর্মমতগত সাম্প্রদায়িক পার্থক্যকে অস্বীকার করে নেওয়া৷ 

প্রকৃত অর্থে ধর্ম বলতে বোঝায় কোন কিছুর সত্তাগত বৈশিষ্ট্যকে ৷ যেমন জলের ধর্ম তরলতা, তৃষ্ণা নিবারণ করা,নীচের দিকে গড়ানো৷ আগুনের ধর্ম  পুড়িয়ে দেওয়া৷ গোরুর ধর্ম ঘাস খাওয়া ইত্যাদি৷ বিশেষ ভাবে  পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, সব আগুনের ধর্মই পোড়ানো৷ সব জলের ধর্মই ভেজানো৷ প্রত্যেক গোরু নামক প্রজাতির  একটাই স্বভাবধর্ম হয়, স্থান বিশেষে পৃথক হয় না৷ ঠিক তেমনি প্রত্যেক মানব প্রজাতিরও একটাই  স্বভাব ধর্ম আর সেটা হল আনন্দ পেতে চাওয়া৷ আর তা সে অসীম পরিমাণে পেতে যায়৷ অর্থাৎ মানুষের চাহিদা অসীম৷

প্রতিটি মানুষই হল আনন্দ পথের যাত্রী, পথকে সংসৃকতে বলা হয় মার্গ, অর্র্থৎ আনন্দমার্গই মানুষের একমাত্র পথ৷ তাকে মানবধর্ম বলেও অভিহিত করা যায়৷ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে  ধর্ম মতবাদ নিরপেক্ষ বললেই শব্দের যথাযথ  প্রয়োগ হত বলে মনে হয়৷ আজ প্রকৃত ধর্ম ও মতবাদের পার্থক্য নিয়ে  সুশীল সমাজের চর্র্চ হওয়া প্রয়োজন৷

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাক নির্র্বচনী ইস্তাহার প্রসঙ্গে এবারে আলোচনা করা যাক৷  রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ  বোটের পূর্বে বোটারগণকে  প্রলুব্ধ করতে  প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন৷ কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর  তার এক চতুর্থাংশ পালনের উদ্যোগ  নিতে দেখা  যায় না৷ এভাবে প্রতিশ্রুতি খেলাপ করে  কপটাচারী  রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ  জনগণকে দীর্ঘদিন থেকে  প্রতারিত করে চলেছেন৷ তাদের এই আচরণ- শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত ও এক্ষেত্রে তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যথাযথ  বিচারের  সংস্থান রাখা উচিত৷ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পালন না করা  কোন কোন দেশে  অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে৷ দুবাইতে কেউ কাউকে টাকা ধার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি  না রাখলে তার জেলও হতে পারে৷