গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলন যা পশ্চিমৰঙ্গের উত্তরাংশের কয়েকটি জেলা দাবী করছে, তা আজ এক চরম অবস্থায় পৌঁছেছে৷ গোর্খা, যারা রাজ্যের বাইরে থেকে এসেছে, তারা ভারতের নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে এখন একটি পৃথক রাজ্য দাবী করছে৷ তারা নিয়মিতভাবে আন্দোলন করছে, হরতাল ডাকছে, জাতীয় সম্পদকে লুণ্ঠন করছে ও জ্বালিয়ে দিচ্ছে, মানুষকে হত্যা করছে, আর এইভাবে তারা সেখানকার আইন–শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে অচল অবস্থায় নিয়ে এসেছে৷ আসলে ‘চোখের বদলে চোখ’ এই পৈশাচিক আহ্বানে আজ দেশের ওই স্থান রাজনৈতিক শ্লোগানে মুখরিত৷ তাই পশ্চিমৰঙ্গের দার্জিলিং জেলায় আইনের শাসনের প্রায় কোনো অস্তিত্বই নেই৷
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ৷ এই সরকারের একমাত্র কাজ এই আন্দোলনকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া যাতে নির্বাচনে তারা সুবিধা পায়৷ কম্যুনিষ্টদের লক্ষ্য যাই হোক, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ তাদের এই স্বার্থপূর্তির প্রয়াসকে ক্ষুঝে গেছে৷ পশ্চিমবঙ্গের আইনমান্যকারী নাগরিকেরা এই ধর্ষণ, খুন, পুলিশের গুলিচালনা আর এত ক্ষৃহৎরূপের সন্ত্রাস, সাম্প্রতিককালেও যা সংগঠিত হয়ে চলেছে, সে সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ণ৷
বস্তুতঃ গোর্খাল্যাণ্ডের দাবী একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর কোনো পৃথক রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটা ভারতের অবিভক্ত কম্যুনিষ্ট পার্টি আর তার দালালদের দ্বারা প্রাথমিকভাবে সৃষ্ট একটা কৃত্রিম ব্যাপার৷ ১৯৭৭ সালে মার্ক্সবাদীরা গোর্খাদের মধ্যে একটা আবেগ তৈরী করে’, তাদের দিয়ে গোর্খাদের স্বশাসন ও গোর্খালী ভাষার স্বীকৃতির নামে এই দাবী চাগিয়ে তুলেছিল৷ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমৰঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা৷ সেই নির্ক্ষোধ আর সংকীর্ণমনা রাজনৈতিক নেতারা এটা তখন ক্ষুঝতে পারে নি যে, তাদেরই সৃষ্ট এই দাবী ও আন্দোলন একদিন তাদের ওপরেই বুমেরাং হয়ে আঘাত করবে৷ বিস্ময়করভাবে সেই কম্যুনিষ্টরাই এখন নিজেদের রোপিত বিষবৃক্ষকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের কৃতকর্মের দায়কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ তাদের স্বভাবগত ধূর্ততার সাহায্যে তারা এখনও পশ্চিমঙ্গের মানুষকে ভুল ক্ষোঝানোর চেষ্টা করছে যে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার৷ আর তারাই নাকি এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের উৎসাহদাতা৷
আজ সময় এসেছে কম্যুনিষ্ট পার্টির ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে কী কী জঘন্য ভূমিকা পালন করেছে সেটা, আর তাদেরই সৃষ্ট এই গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের মুখোশ খুলে দেওয়া৷ ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই কম্যুনিষ্ট পার্টিই ক্ষাঙলাকে বিভক্ত করার শ্লোগান তুলেছিল৷ সেই সময়েই তারা গোর্খাদের জন্যে পৃথক ভূমির শ্লোগানও দিয়েছিল৷ প্রকৃতপক্ষে এই ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ শব্দটা চল্লিশ বছরের পুরনো আর কম্যুনিষ্টপার্টি দাবী করেছিল যে সিকিম, নেপালের অংশবিশেষ আর উত্তরৰঙ্গের দার্জ্জিলিং সহ কয়েকটি জেলা নিয়ে এই গোর্খাল্যাণ্ড ঘটিত হোক৷ এটা হবে গোর্খাদের নিজস্ব বাসভূমি৷ এই গোর্খাল্যাণ্ড দাবীর মাধ্যমে কম্যুনিষ্ট পার্টি আসলে গোর্খাদের মধ্যে একটা শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরী করতে চেয়েছিল কিন্তু সেইসময় এই আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি৷
১৯৭৭ সালে কম্যুনিষ্টরা যখন ক্ষমতায় এল, মার্ক্সিষ্ট কম্যুনিষ্ট পার্টি এই পুরোনো গোর্খাল্যাণ্ড আবেগকেই পুনর্জাগরিত করল, যা আজ রাজ্যের উত্তরাংশে এক চরম অব্যবস্থা, বিশৃঙ্খলা আর রক্তস্নানের স্থান হয়ে উঠেছে৷ নিরীহ, শান্তিপ্রিয় সেখানকার ক্ষাঙালী অধিবাসীরা দার্জিলিং–এ নিজেদের বাসগৃহ ত্যাগ করে পালিয়ে এল, আর তারা আজ উদ্বাস্তু হয়ে কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জেলায় বাস করছে৷ এইভাবে ক্ষাঙালীর নিজেদেরই রাজ্যে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু বহিরাগত গোর্খারাই দাবী করছে যে ক্ষাঙালীরা দার্জ্জিলিং ছেড়ে চলে যাক৷
দার্জিলিং–এর মূল অধিবাসী লেপ্চা–ভুটিয়ারা কোচ জাতিভুক্ত৷ এই কোচেরা আদি ক্ষাঙালী৷ ‘কোচ’ জনসাধারণের একটা অংশ সিকিম–ভুটানে সংকোচ নদীর দুই ধারে বসতি স্থাপন করেছিল, আর তাদেরই একটা অংশ ৰরেন্দ্রভূমি থেকে এসে ক্ষাঙলার উত্তরাংশের আরো উত্তরে পর্বত অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল৷ লেপ্চা–ভুটিয়ারা ক্ষাঙালী জীবন আর সংসৃক্তির মূলস্রোতের সঙ্গে সবসময় সম্বন্ধিত থেকেছে৷ অন্যদিকে গোর্খারা স্পষ্টতই বহিরাগত৷
প্রায় দু’শ বছর আগে ক্ষাঙলার বাইরে থেকে গোর্খারা জীবিকার সন্ধানে এসে দার্জিলিং পর্বতাঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল৷ ১৮৭২ সালের জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী সে সময় এদের সংখ্যা এত নগণ্য ছিল যে তাদের সেই রিপোর্টে রেকর্ডভুক্তই করা হয়নি, শুধু এইটুকু উল্লেখ করা হয়েছিল যে তারা বহিরাগত মাত্র৷ ওই অঞ্চলের উচ্চতর পার্বত্য এলাকায় লেপ্চা আর ভুটিয়ারা বাস করত৷ সমতলে বাস করত ক্ষাঙালীরা৷
এছাড়া যারা নেপালী বলে পরিচয় দেয় আর দার্জিলিং অঞ্চলে বসবাস করে, তাদের একটা বড় অংশ আদৌ গোর্খা নয়৷ নেপালীদের পনেরোটি গোষ্ঠী যেমন–তামাং, গুরুং, নেওয়ারী ইত্যাদি দার্জিলিং অঞ্চলে বসবাস করে৷ তারা গোর্খা নয় আর তাদের ভাষাও গোর্খালী নয়৷ আসলে গোর্খালী খুবই ছোট একটি গোষ্ঠীর উপভাষা৷ ব্যাপারটা ঠিক এইরকম–ভারতীয় ভাষা বলে যেমন কোনো ভাষা বলা যায় না, কেননা ভারতে ৩২৩ টি মুখ্য বা গৌণ ভাষা–আর উপভাষা আছে, আর সব ভাষাগুলিই ভারতীয় ভাষা৷ ঠিক তেমনি নেপালে প্রায় বত্রিশটি ভাষা আর উপভাষা আছে আর তাদের মধ্যে প্রত্যেকটিই নেপালী ভাষা৷ গোর্খালী ভাষা সেই অর্থে ঠিক নেপালের রাজভাষাও নয়৷ এই গোর্খারা এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হয়েও তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থপূর্তির জন্যে গোর্খাল্যাণ্ডের দাবী তুলেছিল, আর এইভাবে তারা দার্জিলিং পর্বতাঞ্চলে বসবাসকারী সরল ও নিরীহ মানুষদের ভুল ক্ষোঝাতে শুরু করলেন৷
এই গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের পিছনে কোনো ঐতিহাসিক, সামাজিক অথবা আর্থিক যৌক্তিকতা নেই৷ লেপচা আর ভুটিয়া যারা সেখানকার মাটির সন্তান, তারা গোর্খাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী৷ তাই যারা আজ ‘গোর্খাল্যাণ্ড গোর্খাল্যাণ্ড’ বলে চিৎকার করছে তারা কেবলমাত্র তাদের হাতকে কলঙ্কিত করে এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক খেলায় মেতেছে৷ ঠিক যেরকম গোর্খালী ভাষা সংখ্যালঘুদের ভাষা আর তা ক্ষৃহদংশের ওপরে কোনোভাবেই চাপিয়ে দেয়া যায় না, ঠিক তেমনি গোর্খারা দার্জিলিং জেলায় বসবাসকারী অধিবাসীদের মধ্যে খুবই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আর তাদের এই জন্যেই ওই অঞ্চলে উস্কানির রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়৷ কিন্তু গত চল্লিশ বছর ধরে এই রাজনীতি লালিত–পালিত হতে দেওয়া হয়েছে, আর গোর্খাল্যাণ্ডের পিছনে আছে এই গোর্খারাই৷ এই গোর্খারা সিকিম, ভুটান, আর অসম থেকে উঠে এসে এই দার্জিলিং জেলায় একত্রিত হয়েছিল৷ পশ্চিম ক্ষাঙলার বামফ্রন্ট সরকারই জঙ্গল সাফ করে তাদের সেখানে বসিয়েছিল, আর গোর্খালীকে রাজ্যের ভাষার মধ্যে একটি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ তাই মার্ক্সিষ্টরাই গোর্খাদের তাদের নিজস্ব বাসভূমির জন্যে উস্কানী দিয়েছিল৷ ক্ষাঙলার মার্ক্সিষ্টদের বিপজ্জনক আর জঘন্য রাজনীতির এটা একটা নমুনা মাত্র৷
এখন দেখা যাক এই ব্যপারে ভারতের সংবিধান কী বলে? অলিখিতের চেয়ে একটা লিখিত সংবিধান মানুষের অপেক্ষাকৃত ভাল আশ্রয়৷ ভারত, ফ্রান্স, আর আমেরিকার সংবিধান লিখিত কিন্তু ইংল্যাণ্ডের সংবিধান অলিখিত যদিও তার সঙ্গে সেখানকার মানুষেরা ভালভাবেই পরিচিত৷ ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্দিষ্ট উপজাতিভুক্ত এলাকাগুলি বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে৷ অর্থাৎ যেখানে উপজাতিদের অ–উপজাতিদের দ্বারা পরিচালিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানকার উপজাতিরাই এই সাংবিধানিক অধিকারভুক্ত৷ এইরকম কয়েকটি উপজাতির উদাহরণ হ’ল গারো, খাসিয়া, কাছারী ইত্যাদি যারা অসম ও মিজোরামের কিছু জেলায় বসবাস করে৷ ভারতীয় সংবিধানের এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র উপজাতিদের জন্যে, অন্য কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্যে নয়৷ আর এই সুবিধা কেবলমাত্র পূর্বোত্তর ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্য কোনো অঞ্চলের জন্যে নয়, এমনকি ভারতের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী উপজাতিদের জন্যেও নয়৷ অবশ্য এই সাংবিধানিক অধিকার কোনো দেশে খুব অল্প সময়ের জন্যেই প্রচলিত থাকা বাঞ্ছনীয়৷
ত্রিপুরা এই সাংবিধানিক সুবিধার আওতাভুক্ত নয়, তা সত্ত্বেও এই কম্যুনিষ্ট পার্টি সেই রাজ্যে এর অপব্যবহারের সুযোগ নিতে ছাড়েনি৷ তারা সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংখ্যার জোরে বিধানসভায় উপজাতি পার্বত্য কাউন্সিল বিল অনুমোদন করিয়েছিল৷ বস্তুতঃ এই আইন ভারতের সংবিধান বিরোধী, আর তা ভারতীয় একতারও পরিপন্থী৷
ক্ষাঙলাতেও ঠিক তেমনি দার্জিলিং–এ আজকের গোর্খা হিল কাউন্সিল ভারতীয় সংবিধান বিরোধী, কেননা গোর্খারা উপজাতিভুক্ত নয়৷ স্বার্থপর কম্যুনিষ্ট নেতা আর গোর্খা প্রধানদের মধ্যে এই সম্ঝোতা বা চুক্তি শুধু বেআইনীই নয়, অসংবিধানিকও বটে৷ সংবিধান অনুসারে গোর্খারা কোনোমতেই ‘গোর্খা হিল কাউন্সিল’ আইনে এই অধিকারভুক্ত হতে পারে না৷ যারা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তারা বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে৷ তাই সরকার আর গোর্খাদের এই চুক্তির কোনোভাবেই উপজাতি সম্বন্ধিত হতে পারে না৷ আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি বেআইনী ও সংবিধান বিরোধী৷ সুপ্রিমকোর্টে যদি উপযুক্ত বিচার হয় তাহলে এটা সেখানে টিকবেও না৷
(১৯৮৮ সালের ৩০শে আগষ্ট গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলন প্রসঙ্গে–প্রাউট প্রবক্তার বিশেষ প্রবচন৷)