স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, অমৃতের পুত্রকন্যা মানুষ৷ সব দিক দিয়ে স্রষ্টা, যথা---বিদ্যা,বুদ্ধি, বোধি, বিবেক, চেতনা উন্নত মস্তিষ্ক, বিচার ক্ষমতা যথা, ভাল-মন্দ, সৎ---অসৎ, সু-কু করণীয় অবকরণীয়, চর্য-অচর্য, পাপ---প্রত্যরায়---প্রভৃতি বিষয়ে মানুষকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন৷ এক কথায়, ইতিবাচক প্রতিসঞ্চর ধারায় মানুষ মুক্তি মোক্ষের দোর গড়ায় উপনীত হয়েছে৷ এর পিছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে - মানুষের অভিষ্ট লাভ, ঈশ্বর সম্প্রাপ্তি৷ জন্ম-মৃত্যুর ঘুর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার করে মানুষকে মুক্তি-মোক্ষ প্রদান৷ এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করার জন্য, সাত হাজার বছর পূর্বে সদাশিব, সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ ও বিংশ শতকে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তারকব্রহ্মরূপে আবির্ভূত হয়েছেন৷ তারা মানুষকে সৎপথের নির্দেশনা দিয়েছেন, আলোরপথে চলার পথ ও পাথেয় দিয়েছেন৷ প্রসঙ্গত স্মরণীয় ---সদাশিব, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী একই পূর্ণব্রহ্মের অভিন্ন সত্তা, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন নামে, বিভিন্নরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন৷ তাই তো গুরুপূজার সময় মানুষের মন্ত্র হচ্ছে---‘‘গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বরগুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈই শ্রী গুরুবে নমঃ৷’’ এই পরমব্রহ্ম---এক অনাদি, অনন্ত, নিরাকার সত্তা৷ তিনি অন্তরিক্ষে থেকে সকল মানুষের কার্যকলাপ ও চিন্তাভাবনা অবলোকন করছেন৷ ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয় সত্তা৷ এবং ব্রহ্মৈব গুরু, না পর৷ ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে---‘‘আনন্দং ব্রহ্ম ইত্যহু৷ প্রভাত সঙ্গীতে বলা হয়েছে, ‘‘তুমি নয়ন মাঝারে রয়েছ, তাই নয়ন পারে না দেখিতে৷ নিজ রূপেতে পেরেছ লুকোতে, তাই নয়ন পারে না দেখিতে৷ তারকব্রহ্ম মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘আমি এই ভৌতিক শরীর নই, এই ভৌতিক শরীরটাও, আমি নয়৷ যদি আমাকে জানতে চাও তবে আমার আনন্দমার্গ মিশনের জন্য খুব করে কাজ করো৷ কারণ আমি নিজেকে এই মিশনের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়েছি৷’’
যাই হোক, ধর্ম সম্বন্ধে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ধর্ম হচ্ছে প্রতিটি বস্তু তথা, প্রতিটি জীব ও মানুষের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷’’ যেমন জলের ধর্ম---ভিজিয়ে দেওয়া, আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেওয়া, দুধের ধর্ম তার ধবলতা৷ আর মানুষের ধর্ম হচ্ছে বিরাট সত্তা, পরমপুরুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া৷ বৃহৎ এষনা প্রণিধানঞ্চ মানবধর্ম, ভাগবত ধর্ম৷ এই ধর্মাচারণ সম্বন্ধে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ধর্ম সাধনার জন্য বাহ্যিক আড়ম্বর, উপাচার, নৈবেদ্য ইত্যাদির কোন প্রয়োজন নেই৷ এটা সম্পূর্ণরূপে ভক্তি সম্পৃক্ত মানসিক---ব্যাপার৷ প্রভাত সঙ্গীতে তিনি বলেছেন---‘‘ধূপ, দীপ, আলপনা, কিছুই লাগবে না৷ মনকে ধরিতে মন করে যাবে আরাধনা৷’’ সিদ্ধ পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন---‘‘ আতপ চাল, আর পাকা কলা কাজ কী রে সে আয়োজনে, ভক্তি সুধা খাইয়ে তারে তুষ্ট কর আপন মনে৷ বাউল কবিরাও গেয়েছেন, ‘‘মন রে কৃষি কাজ জানো না৷ এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফল্তো সোনা৷ ধর্ম নেই তিলক নেই ফোঁটায়, ধর্ম নেই পুরাণে কোরাণে, ধর্ম নেই মন্দির, মসজিদ, গীর্র্জয়, গুরুদ্বারে৷ ধর্ম আছে মানুষের আচরণে, ব্যবহারে ও কর্মে৷’’
বর্তমান যুগের যুগাবতার তারকব্রহ্ম, মহাউন্মার্গগামী মানুষকে সাবধানবাণী শুনিয়ে বলেছেন, ‘‘মানুষ, মানুষ! হারায়ে হুঁস কোথায় চলেছ তুমি৷ আকাশ বাতাস বিষিয়ে দিয়ে নরক করে মর্ত্তভূমি৷’’ তিনি দিয়েছেন মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বাত্মক দর্শন,চর্যাচর্য, সুনির্দিষ্ট আচরণ বিধি, জীবনচর্যা৷ এমন কোন দিক নেই, যার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেননি৷ পিতৃসুলভ বাৎসল্য প্রেমে তিনি মানুষকে ডেকে চলেছেন, সমুদ্রের গর্জনে বজ্রের হুঙ্কারে, মেঘের বজ্রনিনাদে,উল্কার অনল জ্বালায়ে ও প্রভাত সঙ্গীতের সুমধুর সুরে৷ প্রভাত সঙ্গীতে তিনি বলেছেন, ডাক দিয়ে যাই যাই৷ আলোকের পথ ধরে যারা যেতে চায়৷ তিনি আবার বলেছেন, ‘আলোকের এই যাত্রা পথে আঁাধারে কেন বসে থাকো, দ্যুলোকের এই দ্যুতির রথে ভেদ, বিদ্বেষ কেন রাখো৷ প্রভাত সঙ্গীতে তিনি আবারো বলেছেন এগিয়ে চল সকল মানুষ ভাই, আমন্ত্রণ সবারে জানাই৷’’চরম আশাবাদী ৰাৰা আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘চল চল চল, গান গেয়ে চল৷ আশার আলোক শিখা অতি উজ্জ্বল৷ অবণীকে করে তুলি মুক্তাঞ্চল৷ তিনি সকল মানুষের মুক্তি মোক্ষের জন্য, ভব সাগর পার করার জন্য, সোনার তরী সাজিয়ে রেখেছেন৷ তিনি বলেছেন, আনন্দমার্গ দর্শন ও মিশন পরশমণি৷ যে কোন বস্তুতে স্পর্শ করালে তা সোনায় পরিণত হবে৷ সর্ববিধ সমস্যার সমাধান হবে৷ আর্তমানবতার মুক্তির জন্য সব মানুষের পরিত্রাণ ও মুক্তি মোক্ষের জন্য তিনি সংকল্প নিয়ে ধরার ধূলিতে অবতীর্ণ হয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, সবার তরে আসা আমার সবারই ভার আমি নেব, নইকো আমি দূরের কেহ, সবার গৃহে আমার গেহ৷’’
যে শুনেছে তাঁর অমোঘ আহ্বানবাণী, ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে,সঙ্কট আবর্ত মাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন, মৃত্যুর গর্জন শুনেছে সে সঙ্গীতের মত৷ তাই তো দেখা যায় হাজার হাজার সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনী ছোট পরিবারের গন্ডী পেরিয়ে বৃহৎ বিশ্ব পরিবারের কল্যাণ কামনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন৷ আর তাঁর মন্ত্রমুগ্দ ভক্তরা তাঁর বন্দনা গীতি গেয়ে চলেছেন প্রভাত সঙ্গীতের সুরে৷ ‘‘তুমি যে এসেছ আজ ব্যথিত জনের কথা ভাবিতে৷ সবার মনের কালো নাশিতে সকল জীবের ভালবাসিতে৷’’ তুমি এসেছ, ভালবেসেছ প্রিয় বিশ্বে তোমার নাই কোন তুলনা৷ আনন্দ আবেশে,রয়েছে মিশে, সবার মাঝারে তুমি, সবার অজানা৷’’ ভক্তজনেরা আবারো গাইছেন, ‘‘তুমি রূপে ভূূবন আলো করা৷ গানে নাচে ছন্দে ভরা৷ তোমার উপমা নাই, তুলনা না পাই, একা তুমি সারা জগৎ জোড়া৷’’ তিনি মানুষের শারীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক নিদ্রার জাগরণের জন্য স্মেহভরে প্রভাত সঙ্গীতে বলেছেন ‘‘ প্রভাতের রবি বলে, ঘুমায়ে থেকো না আর, কর্মের স্তুপ সুমুখে জমিয়া আছে তোমার৷’’ তাঁর আন্তরিক আবেদন---‘‘উক্তি? জাগ্রত প্রাপ্য রবাণনিবোধতা৷’’
পরমআরাধ্য, পরমপ্রিয় ৰাৰা আনন্দমূর্ত্তিজী মানুষকে বরাভয় দিয়ে আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, কোন মানুষই পাপী নয়৷ সবাই অমৃতের সন্তান৷ পাপ ধুলা বালীর মত৷ ঝেড়ে দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ তিনি বলেছেন ‘‘একবার ৰাৰা নাম যত পাপ হরে৷ পাপীদের সাধ্য নেই তত পাপ করে৷ তাছাড়া সদ্গুরুর কাছে সিদ্ধমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করলে পাপেব ক্ষয় হয়৷ এই দীক্ষার মাহাত্ম হচ্ছে ‘‘দীপজ্ঞানং যতো দদাৎ, কুযাৎ পাপ ক্ষয় তত৷’’ তিনি বলেছেন ‘‘কেউ নীচ নয়৷ সবাইকার এর পিতা গৌরী মাতা, স্বদেশ ভুবনত্রয়ম৷’’ তাই আনন্দমার্গ বলে, ‘‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই ৷ উঁচু কিম্বা নীচু নাই৷ সব মানুষের ধর্ম এক৷ তাই মানুষের মধ্যে কোন জাতিভেদ বা ধর্মভেদ নাই৷ কর্ণের শোচনীয় মৃত্যুর সময় শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছেন, জাতিভেদ প্রথার কঠোরতার জন্য আজ তোমার এই করুন পরিণতি৷ পরবর্তীকালে আমি জাতিভেদ প্রথাকে সমূলে উৎপাচিত করবো৷ তাই তো দেখি শ্রীকৃষ্ণ আজ আনন্দমূর্ত্তি নামরূপের মাধ্যমে এসে জাতিভেদ প্রথা দূর করার জন্য বৈপ্লবিক বিবাহ প্রথা প্রবর্তন করেছেন৷ তিনি আবার বলেছেন মানুষের মুক্তি মোক্ষলাভের জন্য শুধু ধ্যান ধারণা, সাধনা ভজনাই যথেষ্ট নয়৷ এজন্য মানুষের সমাজসেবা অত্যাবশ্যক৷ তিনি এই নিয়মও চালু করেন৷ তারকব্রহ্ম মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘আমি কৃষ্ণের মত অর্জনের সারথী হয়ে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবো না সুদর্শন চক্র দিয়ে৷ এজন্য তিনি দিয়েছেন সুদর্শন যার দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়ে মানুষ সৎপথের অনুগামী হবে না, তাদের দমন পীড়ন আমি নিজে করবো না৷ কারণ সবাই আমার স্নেহের সন্তান৷ তাই দুষৃকতিদের দমনপীড়ন ও কৃতকর্মে প্রায়শ্চিত্তের দায়িত্ব প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিয়েছি৷ এ প্রসঙ্গে একটি গল্পের কথা মনে পড়ে৷ বাস্তব গল্পটি হচ্ছে--- এক পিতার দুই ছেলে ---একটি সুবোধ ছেলে, অন্যটি দুষ্ট, দুরন্ত ও দুর্দমনীয়৷ সুবোধ ছেলেটি পিতার কাছে কোলে এল৷ দুষ্টু ছেলেটি পিতার ডাকে সাড়া না দিয়ে বিপদগামী হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে নর্দমার মধ্যে পড়ে যায়৷ পিতা তাঁকে নর্দমা থেকে তুলে এলে তাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে কোলে নিয়ে আদর করেন৷ ৰাৰা আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘কারো ধর্মমতে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করো না৷ তাকে যুক্তি দিয়ে---বোঝাবার চেষ্টা করবে৷ তাকে আঘাত করলে আনন্দমার্গকেই আঘাত করা হবে৷ প্রভাত সঙ্গীতে তিনি বলেছেন, ‘‘যত ভাষা, যত মত, রহিয়াছে যত পথ৷ সবারে শ্রদ্ধা করি অবিরত৷’’ শ্রীকৃষ্ণ এসে মহাভারত রচনা করেছেন, আর শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি এসে মহাবিশ্ব রচনা করেছেন৷ তিনি সকলকে বরাভয় মুদ্রায় মাভৈঃ মন্ত্র দিয়ে মানুষকে উঁচু শিরে চলতে বলেছেন৷ কারণ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিমান পুরুষ ব্রহ্ম প্রত্যেকের মধ্যে বিরাজমান৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এক নিরাকার অনাদি, অনন্ত পরমব্রহ্মই সকল জীবের একমাত্র উপাস্য৷ তিনিই জগৎ গুরু৷ তিনি আজ আনন্দমূর্ত্তি নামরূপের মাধ্যমে এসে ব্রহ্ম বিদ্যা প্রকাশ করেছেন৷ তাঁর মাহাত্ম সকলকে জানিয়ে দিতেই হবে৷’’
তিনি সকলকে অবিরাম ডেকে চলেছেন আলোর পথ ও পাথেয় দিয়েছেন৷ তিনি দিয়েছেন বিজ্ঞানভিত্তিক অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনা, দিয়েছেন চর্যাচর্য যম নিয়ম ষোড়ষবিধি, পঞ্চদশশীল, আনন্দমার্গ দর্শন, ধর্মনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি (প্রাউট) শিক্ষানীতি,কৃষিনীতি,চিকিৎসানীতি ও মাইক্রোবাইটামের অভিনব বিজ্ঞানের নীতি৷ তাছাড়া তিনি সাফল্যলাভের মুক্তির মোক্ষলাভের সহজতর উপায় হিসাবে দিয়েছেন অষ্টাক্ষরী সিদ্ধমন্ত্র---‘‘ৰাৰা নাম কেবলম্’’ কীর্ত্তন৷
তাই হে মানুষ! অহেতুক কাল বিলম্ব না করে বলো---‘‘সুমুখের পানে চলে যাব আমি, তোমার নামটি সাথে নিয়ে৷’’ বলো, তোমার নামের তরী বেয়ে সাগর হবো পার, সাগর হবো পার আজিকে৷’’
- Log in to post comments