পূর্ব প্রকাশিতের পর ইজমের কারণে মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক বিপর্যস্ত হয়৷ একজন তথাকথিত হিন্দু মুসলমানকে বিশ্বাস করে না, তেমনি একজন তথাকথিত মুসলমান হিন্দুকে বিশ্বাস করে না কেননা তারা দু’জনেই নিজ নিজ ইজমে পরম বিশ্বাসী৷ ইজমের সঙ্গে লজ্জাৰোধের (shamefulness) ঘনিষ্ট সম্বন্ধ৷ যখনই কোন একটি জাতি বা শ্রেণী বা প্রদেশ বা গোষ্ঠী তাদের আত্ম সম্মান খোয়াবার আশঙ্কা করে, তখনই তারা লজ্জাৰোধের দ্বারা প্রেষিত হয়ে তাদের আত্ম সম্মান বাঁচানোর জন্যে যে কোন নীচ কাজ করতে পিছপা হয় না৷ ইজমের সম্মান রক্ষার খাতিরে অনেকে আবার নানারকম কৃত্রিম ও লোক দেখানো আচার আচরণের আশ্রয় নেয়, যদিও তাদের মনের ভিতরে তখন অন্য ধরনের ভাবনা কাজ করে৷ ইজম্ মানুষের ৰুদ্ধিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে’ দেয় যে, যুক্তি–বিচারের কাছে একজন ইজম্–বিশ্বাসী পরাজিত হলেও সেই পরাজয় সে স্বীকার করতে চায় না৷ তাই মানুষকে তার মনের ভিতর থেকে ইজমের নাগপাশকে উৎপাটিত করতে হবে৷
জুগুপ্সা বা কপটতা এমন একটি পাশ যে তার কবলে পড়ে মানুষ নিজের অন্তরের ভাবনাকে বাইরে প্রকাশিত হতে দেয় না৷ একজন ধর্মমতাবলম্বীর যদি মনে প্রবল ইচ্ছা জাগে মাছ–মাংস খাবার তাহলে সে তার ইজমের সম্মান রক্ষার খাতিরেই মনের সেই ইচ্ছাকে জোর করে’ দাবিয়ে রাখে৷ এই জন্যে সে বাইরে হাবেভাবে দেখানোর চেষ্টা করে যে মাংসের প্রতি তার বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই৷ কূলগৌরবের সঙ্গেও ইজমের সম্পর্ক আছে৷ ব্রাহ্মণ, সৈয়দ, পাঠানদের জাত্যাভিমানের বহিঃপ্রকাশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷
শীল–এর ব্যাপারেও একই কথা, অর্থাৎ নিজের কালচার সম্পর্কে মহামন্যতাৰোধ (superiorty complex) ইজমের থেকেই জন্ম নেয়৷ যদিও মানুষের সংস্কৃতি এক ও অবিভাজ্য তবু ইজমের অনুসরণকারীরা সেকথা ৰুঝতে চায় না৷ ইজমের অনুসরণকারীরা নিজেদের ভাষা, আদব–কায়দা, অভ্যাস, বিভিন্ন অভিব্যক্তির স্থানিক বিভিন্নতা –– এগুলি প্রকৃত পক্ষে সামগ্রিকভাবে মানব সংস্কৃতিরই অঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও সেগুলি সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস নিয়ে থাকতেই বেশী পছন্দ করে৷ রাজনৈতিক ইজমের ধ্বজাধারীরা আবার ইজমের স্বার্থে জঘন্য কাজ করতেও দ্বিধা করে’ না৷ মধ্যযুগে এইভাবে সম্প্রদায়বাদ মানবতাকে পথের ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল৷ লজ্জার কথা যে এই বিংশ শতাব্দীতেও অনেকে সেই মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িকতার জিগির চাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট৷ আবার যারা মুখে ৰড় ৰড় কথা বলতে অভ্যস্ত তারা নিজেদের ইজমের স্বার্থে অসামাজিক তত্ত্বের সঙ্গেও মিতালি পাতাতে দ্বিধা করে’ না৷ সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে তারা সকলেই তামসিক শক্তির কবলে পড়ে প্রমাদগ্রস্ত৷
তাহলে মানুষের কর্তব্য কী শারীরিক অস্তিত্ব সীমিত কেন না তা পঞ্চভূত দিয়ে তৈরী৷ শরীরের অসংখ্য প্রোটোপ্লাজমিক কোষের প্রতিমুহূর্তে জন্ম ও মৃত্যু হচ্ছে৷ তাই এই দেহ কোন স্থায়ী আধার হতে পারে না৷ এই জড় জগতের অস্তিত্বও আপেক্ষিক৷ মানুষের কাছে একমাত্র পরমসত্য হলেন পরমপুরুষ৷ কিন্তু মানুষকে এই জাগতিকতার সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপন করেই সেই পথে চলতে হবে৷ স্থূল জাগতিক সুখভোগই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না৷ যদি সেটাই লক্ষ্য হয় তবে তা মানবীয় মূল্যৰোধকে ব্যাহত করবেই৷ তেমনি উল্কা বা ধূমকেতুকে কেউ জীবনের লক্ষ্য বলে গণ্য করতে পারে না৷ যদি কেউ ভুলবশতঃ তা করেও তবে তার জানা উচিত যে উল্কা বা ধূমকেতু মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর নাগালের বাইরে চলে যাবে কেননা তার আপেক্ষিক গতি পৃথিবীর গতির থেকে অনেক গুণ বেশী৷ এর অর্থ সেই অবস্থায় তা আর লক্ষ্য থাকতে পারবে না৷ যদি কেউ তোমাকে দেখায় যে গোরু যে দিকটায় চরছে সেটা অবশ্যই উত্তর দিক, তাহলে কী হবে যদি গোরুগুলো ইতোমধ্যে ঘাস খেতে খেতে পূর্বদিকে চলে গিয়ে থাকে তখন কি পূর্বদিককেই উত্তর বলে মেনে নিতে হবে তাই কোন পরিবর্ত্তনশীল সত্তাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্বীকার করা যায় না৷ উত্তর দিকটা কোন দিকে তা নির্দ্দিষ্ট ভাবে জানতে হলে ধ্রুবতারার অবস্থানকে জানতে হবে৷ কেন না ধ্রুবতারা যদিও স্থান পরিবর্ত্তন করে তবুও পৃথিবী থেকে তাকে সবসময় উত্তর দিকেই দেখা যায়৷
তাই কোন পরিবর্তনশীল তত্ত্ব জীবনের আদর্শ হতে পারে না, কেন না তা দেশ–কাল–পাত্রের আপেক্ষিকতায় আৰদ্ধ৷ সুতরাং মানুষের জীবনের চরম ও পরম আদর্শ হবে তাইই যা সর্বব্যাপক ও দেশ–কাল–পাত্রের অধিক্ষেত্রের বাইরে৷ তিনি রাম–শ্যাম–যদু–মধু মত সাধারণ বৈয়ষ্টিক সত্তা নন৷ তিনি হলেন পরম বিষয়ী সত্তা৷ যদি মানুষ এই পরম তত্ত্বকে তার ধ্যেয়–জ্ঞেয় করে’ নিতে পারে তবেই অবনমনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে পারবে৷ অনির্দিষ্ট কাল ধরে’ কোন একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক থিয়োরী (ইজম্) মানুষের মঙ্গল করতে পারে না, কেননা একই পরিধিতে অথচ ভিন্নতর কালে বা পাত্রে অন্য একটি ইজম্ তার বিরোধী তত্ত্ব হিসেবে এসে যায়৷ তা ছাড়া এটা ভাবা সঙ্গত হবে না যে, একটি ইজম্ কোন দেশে এক সময় যে রকম প্রভাবশালী ছিল পরবর্ত্তী সময়ে সেই দেশে তা একই ভাবে অনুসৃত হবে৷ তাই ইজম্ কখনও মানুষের আদর্শ (Ideology) হতে পারে না৷ অণুমনও পরিবর্ত্তনীয় সত্তা তাই অণুমনও মানুষের উদ্দিষ্ট বিষয় হতে পারে না৷ এটা নিশ্চিত যে পরমচৈতন্য সত্তা ছাড়া অন্য যে কোন সত্তাকে জীবনের ধ্যেয় হিসেবে গ্রহণ করলে ইজমেরই প্রতিষ্ঠা হবে৷ অনেকেই মাতৃভূমিকে দেবী জ্ঞানে পূজো করে’, এমন কী তার মূর্ত্তিও তৈরী হয়ে যায়৷ কিন্তু এটা সকলেরই ৰোঝা উচিত যে মাতৃভূমির সেবা করাটাও চরম তথা পরম লক্ষ্য হতে পারে না, কারণ মাতৃভূমির ধারণাটাই পরিবর্ত্তনশীল৷ আজকের মাতৃভূমি একদিন জলের তলায় তলিয়ে যেতে পারে৷ উদাহরণস্বরূপ, প্রাগৈতিহাসিক যুগের গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড আজকের ভারত মহাসাগরে পরিণত হয়েছে৷ তাই কোন একটি দেশ, রাজ্য বা জেলার ভৌগোলিক পরিসীমা নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে পড়াটা ৰুদ্ধিমত্তার কাজ নয়, তাতে সমগ্র মানব সমাজেরই শান্তি বিঘ্ণিত হয়৷ এই ধরনের ভৌগোলিক সীমাসংক্রান্ত বিরোধ নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির অধিবাসীরা ভালভাবেই মিটিয়ে নিতে পারবে৷ তাই প্রকৃত মানবিক প্রয়াসই হবে পরম আদর্শের প্রাপ্তি৷ পরমসত্তাই জীবনের সত্যিকারের আদর্শ বা লক্ষ্য৷ ব্রহ্মসাধনাকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার ভাবনা নিয়েই দেশসেবা করা উচিত৷ যে দেশে যে মানুষেরা বসবাস করছে সেই দেশের সেবা তো অবশ্যই করতে হবে, কেন না সেই দেশের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক৷ আর সেই সূত্রে সেখানকার মানুষের জন্যে সর্বাধিক সেবা করার অমূল্য সুযোগ তারা পেয়েছে৷ কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নিজের মাতৃভূমিরই শুধু সেবা করতে হবে, অন্য দেশের নয়৷ কেউ যদি অন্য দেশে যায় তবে সে সেই দেশের সেবার মাধ্যমেও সামগ্রিক ভাবে আগের চেয়ে অধিক সেবা করার সুযোগ পেয়ে যাবে৷ এই প্রসঙ্গে আমি আবার বলছি যে, ব্রহ্মভাবনাই প্রকৃত আদর্শ, আর মানবতার সেবা ব্রহ্মসাধনারই একটা অংশ৷ তাই আমার সুস্পষ্ট অভিমত হচ্ছে কোন ইজমই মানবতার ত্রাতা হতে পারে না৷ বিজ্ঞ লোকেরা পরমসত্তাকে একমাত্র আদর্শ মেনে নিয়ে দেশ–কাল–পাত্রের সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপন করতে করতে এগিয়ে চলেন৷ তাঁরা সর্বদা এটাই মনে রাখেন যে ‘‘পরমপুরুষ আমার পিতা, পরমা প্রকৃতি আমার মাতা আর সমগ্র বিশ্ব আমার দেশ’’৷ যে দেশে সে জন্মগ্রহণ করেছে সেই দেশকে ভালবাসা বা সেই দেশের জন্যে গর্ব ৰোধ করা অন্যায় কিছু নয়৷ কিন্তু ইজমের বশীভূত হয়ে অন্য দেশের প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণজাত দেশপ্রেম অবশ্যই ক্ষতিকর৷
পরম চৈতন্যই হচ্ছেন পরম বিষয়ী সত্তা (fundamental subjectivity)৷ তিনি মানুষের মনের বিষয় (object) হতে পারেন না৷ তিনি সমস্ত বহুত্বের মধ্যে এককতম, সব সমূহের এক ‘সমূহ’৷ পরমপুরুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অর্থ হ’ল নিজেকে তাঁর বিষয়ে (object) পরিণত করা, নিজের বিষয়ী ভাবকে (unit subjectivity) তাঁর পরম বিষয়ীভাবে সর্মপণ করে’ দেওয়া৷ এই পথে চলতে গেলে প্রথমে নিজের পঞ্চভূতাত্মক অস্তিত্বকে মিলিয়ে দিতে হবে বিষয় মনের সঙ্গে objective mind)৷ তারপর বিষয় মনকে নিজের বিষয়ী মনে (unit subjective mind) মিলিয়ে দিতে হবে, আর সেই বিষয়ী মনকে সমাহিত করে’ দিতে হবে পরম চৈতন্য সত্তায়৷
ইজমের সমর্থকেরা সর্বব্যাপক ও অনাদি–নন্ত ভূমাচৈতন্য সত্তায় বিশ্বাস করে না৷ সেই দিক দিয়ে তারাও প্রকৃত ধর্মভাবনার বিরোধী৷ নিজেদের অজ্ঞতার কারণেই তারা এরকম করে’ থাকে৷ তারা ৰোঝে না যে, এই বিশ্ব সেই চৈতন্য সত্তারই স্থূল বিকাশ৷ উত্তর প্রদেশ, লক্ষ্ণৌ, তথাকথিত অস্পৃশ্য বা চণ্ডাল, পিপীলিকা বা মানুষ –– সবই তাঁর এক একটি রূপ৷ ইজমে বিশ্বাসীরা সঙ্কীর্ণ মানসিকতার বশবর্তী হয়ে নিজেদেরকে ঈশ্বরের বরপুত্র মনে করে, কিন্তু অন্যদের অনার্য, কাফের বা নাস্তিক প্রতিপন্ন করতে দ্বিধা করে না৷ তারা ভাবে বিশ্বপিতা শুধু তাদের ওপরই কৃপা বর্ষণ করে’ চলেছেন, সমগ্র সৃষ্টির প্রতিটি অস্তিত্ব যেন তাঁর কৃপাধন্য নয়৷ তারা এটা ৰুঝতে চায় না যে, তথাকথিত অনার্য, ম্লেচ্ছ বা অসভ্য–বর্বর বলে’ যাদের ঘৃণা করছি তারা প্রত্যেকেই পরমপুরুষের সন্তান৷
পরমপুরুষকে যারা নিজেদের অভীষ্ট বলে’ স্বীকার করে’ নিয়েছে তাদের কাছে এই বিশ্বের সবকিছু তাঁরই বিকাশ৷ তারা জানে যে, সমস্ত মানুষকে নিজের ভাই–বোন বলে স্বীকার না করে নিলে বিশ্বপিতাকেই অবজ্ঞা করা হয়৷ আর বিশ্বপরিবারের যিনি প্রধান সেই পরমপিতাকে অসম্মান করা হলে পারিবারিক সৌহার্দ্য বজায় থাকতে পারে না৷ তাই পরমচৈতন্য সত্তাকে পুরোপুরি স্বীকার করে’ নেওয়ার আগে মানুষকে প্রথমে বিশ্বজনীন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হতেই হবে৷
লক্ষ্ণৌ, ১৯৬৮