...‘‘ঈশ্বর–প্রণিধান’’ জিনিসটা... দাঁড়াচ্ছে–মনকে সেই পরমাশ্রয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁর পানে ছুটিয়ে নিয়ে চলা৷ তাই ঈশ্বর–প্রণিধান জিনিসটা সম্পূর্ণ ভাবাশ্রয়ী–সম্পূর্ণতই একটা মানস ঙ্মআধ্যাত্মিকৰ প্রচেষ্টা৷ এতে চীৎকার করে লোক জড় করবার বা ঢ়াক–ঢ়োল পিটিয়ে ভক্তি দেখাবার অবকাশ নেই৷....
ঈশ্বরের এই যে ভাব নেওয়া এতে মনকে প্রথমে বস্তুতান্ত্রিক প্রপঞ্চ থেকে সরাতে হয় (ভূতশুদ্ধি), তার পরে সরাতে হয় ক্ষুদ্র–আমিত্বের স্বার্থসচেতনতা থেকে (আসনশুদ্ধি), তারপরে সেই বিন্দুভূত মনের সামনে বিরাটের ভাবকে তুলে ধরে (চিত্তশুদ্ধি) নিজের সংস্কার অনুযায়ী বর্ণ–প্রতিষ্ঠিত মন্ত্রে তাঁর ভাব নিতে হয় ঙ্মমন্ত্রচৈতন্যের ৰোধি যুক্ত সিদ্ধ ইষ্টমন্ত্র সহ মানসাধ্যাত্মিক জপক্রিয়াৰ৷ তিনি সহজ সত্তা৷ তাই কেবল ভাবেতেই তাঁকে পাওয়া যায়–আর কোন কিছুতে নয়৷...
ঈশ্বর–প্রণিধানে মানসিক জপই সর্বশ্রেষ্ঠ৷ মন যাঁর ভাব নিচ্ছে, মনই সেই ভাব উচ্চারণ করবে, মনই সেই ভাবের কথা শুণে যাবে৷ এই মানসিক জপ উপযুক্ত পাত্রের কাছ থেকে যথাবিধি শিখে নিয়ে নিয়মিতরূপে যথাবিধি অভ্যাস করলে অল্প দিনের মধ্যেই মন একটি বিশেষ ধারাপ্রবাহে এগিয়ে যেতে থাকবে৷ এই এগিয়ে যাওয়াটা হতে থাকে ৰ্রহ্মেরই প্রতিসঞ্চরের পথ ধরে৷....
সাধনার অন্যান্য অঙ্গ নির্জনে এককভাবে অনুশীলন করাই বাঞ্চনীয়৷ কিন্তু ঈশ্বর–প্রণিধান একক ও মিলিত উভয় ভাবেই করা যায়৷ মিলিত ঈশ্বর–প্রণিধানে সকলের যৌথ মানস প্রচেষ্টা এক সঙ্গে কাজ করতে আরম্ভ করে বলে উন্নত ভাবলক্ষণগুলিও অত্যল্পকালের মধ্যেই স্ফূর্ত্ত হয়৷ তাই অন্যান্য সাধনার ন্যায় ঈশ্বর–প্রণিধানও এককভাবে তো করবেই, তাছাড়াও যখনই কয়েকজন সুবিধাজনক ভাবে একত্রিত হবে, মিলিত ঈশ্বর–প্রণিধান করে নেবার সুযোগ ছেড়ো না৷ এই মিলিত ঈশ্বর–প্রণিধানের ফলে যে দুর্দমনীয় মনঃশক্তি জেগে ওঠে তা ছোট–বড় পৃথিবীর যে–কোনো সমস্যার সমাধানে তোমাদের সাহায্য করবে৷ ঠিক এই কারণে সাপ্তাহিক ধর্মচক্রে নিয়মিতরূপে অংশগ্রহণের জন্যে সর্বদা সচেষ্ট থেকো৷
ঈশ্বর–প্রণিধানের ফলশ্রুতি
সবিকল্প সমাধি
‘প্রণিধান’ শব্দের অর্থ হ’ল, জপ–ক্রিয়ার দ্বারা লব্ধ ভক্তি৷ তাই ঈশ্বর–প্রণিধানের অর্থ হ‘ল ঈশ্বর–সূচক ভাব নিয়ে ঈশ্বর–বাচক শব্দের জপ করে যাওয়া৷ ঈশ্বর–প্রণিধানের অর্থ দুনিয়াকে ফাঁকি দেওয়া নয়, কাপুরুষের মত দায়িত্ব থেকে রেহাই পাওয়া নয়, ঈশ্বর–প্রণিধান হ’ল সাহসীর বীর্যদৃপ্ত সাধনা৷ যদিও ঈশ্বর–প্রণিধানের দ্বারা চিত্তের ভাবধারা সরলরেখাকার হয়ে যাওয়ায় তার ফলে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব, তবু অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির পক্ষে ঈশ্বর–প্রণিধানের চেয়েও ধ্যান–ক্রিয়া অধিকতর সুগম৷
ঈশ্বর–প্রণিধানক্রিয়্ সবিকল্প সমাধির পক্ষে অধিকতর উপযোগী, কারণ এতে মন অল্পকালের মধ্যে একাগ্রভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ও তার পরেও যে সামান্য আমিত্ব–ৰোধ অবশিষ্ট থাকে তা ধ্যান–ক্রিয়াতে সহজেই ত্যাগ করা যায় ও সেই আমিত্ব–ৰোধের ত্যাগেতেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির প্রতিষ্ঠা হয়৷
নির্গুণের উপাসনা হয় না, উপাসনা হয় সগুণের বা তারক ৰ্রহ্মের৷ বিষয়–বিষয়ী ভাব যতক্ষণ আছে উপাসনার সুযোগ ততক্ষণ৷ অনাদিকাল থেকেই যদি কোনও পুরুষ ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয় থেকে মুক্ত হয়ে থাকেন তাঁর উপাসনা নিরর্থক৷ জীব কর্মের ফলেই ক্লেশ ভোগ করে, ক্লেশ থেকে জাগে বিপাক, বিপাক থেকে বিপাকানুরূপ বাসনা বা আশয়ের উদ্ভব হয়৷ যার এসবের কোনো কিছুই অভিজ্ঞতা নেই, যার মন বলে কিছু নেই তার উপাসনায় আর যা কিছুই পাওয়া যাক না কেন, কৃপা পাওয়া যায় না৷ মানুষকে কৃপা করার অধিকার অনাদিমুক্ত বা নির্গুণ পুরুষের কি করে থাকতে পারে? এই অধিকার আছে সেই মুক্ত পুরুষের যিনি এককালে ৰদ্ধ ছিলেন অর্থাৎ সগুণ ৰ্রহ্মের, আর আছে তারক ৰ্রহ্মের যার মন সগুণ–নির্গুণের স্পর্শবিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত৷ যে সকল পুরুষ বদ্ধ ছিলেন, বর্তমানে মুক্ত, ভবিষ্যতেও বদ্ধ হবেন না তাঁরাও সগুণ ৰ্রহ্মেরই সমান, তাঁদের বলা হয় মহাপুরুষ৷ কৃপা করার অধিকার তাঁদেরও আছে৷
ব্রহ্ম–কৃপায় ঈশ্বর–প্রণিধানের পথে দ্রুত অগ্রসর হয়ে তাঁর ধ্যানে, তাঁর সত্তায় নিজের আমিত্বকে উৎসর্গ করে জীব পরমাশান্তি লাভ করতে পারে, আর সেই অবস্থাতেই সে ভব–ৰন্ধন থেকে অর্থাৎ প্রাকৃতিক বৈকারিক ও দাক্ষিণ ৰন্ধন থেকে স্থায়ীভাবে মুক্ত হতে পারে৷ জীবের এই যে মুক্তির সাধনা যার চরম ফল সমাধি তা কোনো মনের বিকার নয়৷ তাই তাতে নিশ্চয়াত্মক বা ঋণাত্মক ভাবের কোনো অবকাশ নেই৷ সমাধির সাধনা তাই পৌরুষের বলদৃপ্ত অগ্রগতি, এতে পলায়নী বৃত্তির কোনো স্থান নেই৷..