এটা মানব মনের স্বভাব যে, সে সব সময় অনুকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায়৷ আমরা কদাচিঠ এ কথা বলি–‘‘হে পরমাত্মা, তুমি আমাকে কত কিছু না দিয়েছ, কত বৌদ্ধিক সম্পদে আর মানসোত্তর উপসম্পদায় না আমাকে ভূষিত করেছ তুমি আমাকে এত বেশী দিয়েছ কিন্তু আমি এর উপযুক্তই নই৷’’ মানুষ সাধারণতঃ নিজের অনুপপত্তিটাই, তার সীমিতত্ব বা ত্রুটিগুলিকেই বড় করে দেখে৷ তার কী নেই–সে সম্পর্কেই সে বেশী সচেতন থাকে৷ কিন্তু যখন তার কাছে অনেক ধনসম্পদ, অনেক মানসম্মান বা অন্য কোনো সম্পদ এসে যায়, সে কখনই বলে না–‘‘হে প্রভু, আমার কোনো যোগ্যতা নেই, তবু আমাকে এত বেশী দিচ্ছ’’ এ ধরনের কথা কখনই মানুষ বলে না৷ এভাবে মানুষ কখনই চিন্তা করে না৷ আবার, মানুষ যখন কোনো অবাঞ্ছনীয় কাজ, কোনো কুকর্ম বা হীনকর্ম করে ফেলে, সে ভাবে এসব তো সাধারণ ব্যাপার পরমাত্মা নিশ্চয়ই এ সমস্ত দেখছেন না৷ কিন্তু যখন বিপদে পড়ে, তখন বলে, ‘‘হে পরমাত্মা, তুমি আমার প্রতি এ কি অবিচার করলে তোমার এটা করা উচিত ছিল না’’ আমি এজন্যেই বলেছি, মানুষের এ ধরনের চিন্তা করা, এ ধরনের বলাটাই স্বভাব৷
কোনো কোনো পুরাণে এই ভাবে বন্দনা করা হয়েছে–‘‘রূপং দেহী, জয়ং দেহী, যশো দেহী, দ্বিষো জহী’’–হে ঈশ্বর, আমাকে সৌন্দর্য দাও, আমাকে বিজয় দাও, আমাকে যশ দাও, আমার শত্রকে বিনাশ কর৷ ঈশ্বরের কাছে এই ধরনের প্রার্থনা করা কি মানুষের উচিত?
এখন দেখা যাক, পরমপুরুষের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কী সম্পর্ক? পরমপুরুষ হলেন কারণ সত্তা, পরম রচনাত্মক সত্তা, পরম সর্জন তত্ত্ব৷ তাঁর অনন্ত মনে আধৃত রয়েছে সমগ্র বস্তু জগৎ৷ সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে? পরমপুরুষের মনের দ্বিতীয় অংশে [বস্তু জগৎ ভূমামানসের প্রক্ষেপ], অর্থাৎ পরমপুরুষের স্বরূপ স্থিতির দিক থেকে ধরলে তৃতীয় পর্যায়ে [পরমপুরুষ থেকে ভূমামানসের সৃষ্টি৷ আবার ভূমামানস থেকে বস্তুজগতের সৃষ্টি৷] কত কিছু আসে, থাকে, লয়প্রাপ্ত হয়৷
সৃষ্টির এই গতিপ্রবাহে প্রতিটি বস্তু–প্রতিটি অণুসত্তা, প্রতিটি জীবিত প্রাণী, একটা বিরাট হাতী থেকে একটা ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত, একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে একটা ক্ষুদ্র তৃণখণ্ড পর্যন্ত সবার অস্তিত্ব পরমপুরুষে বিধৃত৷
তাই মানুষ, জীবজগৎ, জড়বস্তু–সবার জন্যে কী হওয়া উচিত বা কী হয়েছে বা কী হচ্ছে–তা নির্ধারণ করতে পারেন কেবলমাত্র পরমপুরুষই–যিনি পরম বিষয়ীসত্তা৷ যে বিষয়ভূত সত্তা, যে [ক্ষুদ্র] বস্তু মাত্র–তার এটা চিন্তা করার বা এ ধরনের বলার কোন অধিকারই নেই–‘‘হে পরমাত্মা, আমাকে এটা দাও, আমাকে ওটা দাও৷’’ কেন না, যখন এই বিশ্বের সৃষ্টি করা হয়েছিল, তখন বিষয়সত্তা বা বস্তুসত্তার সে সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছিল না, সেটা ছিল কেবল বিষয়ীসত্তার–যিনি এর নির্মাতা–যিনি ব্রহ্ম–যিনি পরমপুরুষ৷
তাই কোনো মানুষের এ কথা বলার অধিকার নেই যে–‘‘হে পরমাত্মা, আমাকে এটা দাও৷ হে পরমাত্মা, তুমি এটা কী করলে৷’’ এ ধরনের কথা বলা মানুষের অধিকার সীমার বাইরে৷
আমরা কী করতে পারি? আমাদের কী করা উচিত? আমরা এটাই বলতে পারি–‘‘হে পরমপুরুষ, যদি তুমি আমার কাছ থেকে অধিক কাজ নিতে চাও, তাহলে তার জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি দাও৷ আমাকে যে সামর্থ্য তুমি দিয়েছ–তার যেন সদুপযোগ করতে পারি, তুমি আমাকে সেই আশীর্বাদ করো৷ যদি তুমি আমাকে দিয়ে আরও বেশী কিছু করাতে চাও, তাহলে কৃপা করে তুমি সেই অধিক ক্ষমতা আমাকে দাও৷ তোমার অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে আমার উপযোগ করে নাও–তোমার এই বিরাট বিশ্বলীলা নাট্যে আমাকে উপযুক্ত ভূমিকায় ঠিক ভাবে কাজে লাগিয়ে নাও৷’’
আমি একটু আগেই বলেছি, সমস্ত জীবের অবস্থান পরমপুরুষের মহান অস্তিত্বের তৃতীয় অংশে৷ এখন, প্রতিটি বস্তুর সঞ্চালন, তার গতিময়তা বিভিন্ন যন্ত্রের দ্বারা সাধিত হয়৷ এই সব যন্ত্র তাঁর দ্বারাই নির্মিত৷ তবে এ সমস্ত যন্ত্র স্বয়ংচালিত৷ কিন্তু এই যে স্ব–সঞ্চালন ক্ষমতা তা পরমপুরুষেরই দেওয়া৷ তিনি এর জন্যে কিছু নিয়ম তৈরী করে দিয়েছেন৷ আর সেই নিয়ম হ’ল, প্রতিটি ক্রিয়ায় ঠিক সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটবে–যদি স্থান–কাল–পাত্র এই তিন মূল তত্ত্ব বা তাদের by products অপরিবর্তিত থাকে৷
তাই পরমপুরুষ বলছেন–‘‘কর্মফল সংযোগ সমাবৎ তৎ প্রজায়তে৷’’
কোনো কার্য বিশেষ রূপে কার্যান্বিত হবে কীভাবে তা কিন্তু পরমপুরুষ ঠিক করে দেন নি৷ পরমপুরুষ নিজের সন্তানকে দিয়ে অসৎ কাজ করান না৷ কাজ করার দায়িত্ব মানুষের৷ মূল কার্য ও তার প্রতিক্রিয়ার জন্যে দায়ী মানুষই, পরমপুরুষ নয়৷ এটাই নিয়ম যে, কর্ম যেমন হবে, সেই অনুসারে কর্মফল ভোগ করতে হবে৷
এ জন্যে পরমপুরুষ দায়ী নয়৷ পরমপুরুষের দ্বারা নির্মিত যন্ত্রের এইটাই নিয়ম৷ আর এই যন্ত্রের নাম হ’ল প্রকৃতি বা স্বভাব৷ পরমা প্রকৃতি যে বিধি অনুসারে কাজ করেন তাকেই বলে ‘স্বভাব’ বা ‘প্রকৃতি’৷ স্বভাবের নিজস্ব কোনো বৈয়ষ্টিক অস্তিত্ব নেই তা নিবৈয়ষ্টিক যা একটি style–এর সঙ্গে সম্বন্ধিত৷ আর পরমপুরুষের নির্দেশ অনুসারে সেই বিধিব্যবস্থা (style) কাজ করে চলেছে৷