গত পরশু সন্ধ্যায় রেণেশাঁ ক্লাবের সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল ‘‘বুদ্ধির মুক্তি’’৷ কারো কারো মনে প্রশ্ণ জাগতে পারে---মুক্তি তো মানুষের জন্যে প্রয়োজন৷ বুদ্ধির মুক্তি আবার কী রকম কথা৷ বুদ্ধি জিনিসটা হ’ল অমূর্ত বা ভাববাচক৷ যা অমূর্ত যা ভাববাচক তার আবার মুক্তি কী! এই প্রসঙ্গে আমার অভিমত হ’ল---হ্যাঁ, বুদ্ধিরও মুক্তির প্রয়োজন আছে বৈকি৷ এই জগতে যা কিছু রয়েছে---জড়, ভাব, চেতন, সকলেরই মুক্তি চাই৷ মুক্তি না ঘটলে বস্তু বা ব্যষ্টির স্বাভাবিক স্ফূরণ ঘটে না অর্থাৎ যার মধ্যে যে গুণ রয়েছে, যে সামর্থ্য রয়েছে সেই গুণ বা সামর্থ্যের পূর্ণ বিকাশ, পূর্ণ অভিপ্রকাশ যদি দেখতে চাই তাহলে সেই ব্যষ্টি বা বস্তুর মুক্তি অপরিহার্য৷
মানুষ জড়তার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চায়৷ এখন এই মুক্তি জিনিসটা কেমন ধারা৷ মানুষের এই যে জড় শরীরটা সেটা থেকে তো মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়৷ শরীর থেকে মুক্তি মানেই মৃত্যু৷ কিন্তু জড়তার যে বন্ধন তা’ থেকে মুক্তি লাভের জন্যে প্রয়াস অবশ্যই করতে হবে৷ জড় জগতে যে অর্থনৈতিক বন্ধন, রাজনৈতিক দাসত্ব, নানান ধরণের সামাজিক পরাধীনতা---এসব থেকে মুক্তিলাভের যে প্রয়াস সেটাই হ’ল জড় জগতের মুক্তি৷ এই ধরণের জাগতিক বন্ধনমুক্তির জন্যে মানুষকে চেষ্টাশীল হতে হবে৷ কোন দেশ যদি অপর দেশের কাছে পরাধীন থাকে তো সেই পরাধীনতার দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হার জন্যে সংগ্রাম অবশ্যই করতে হবে৷ তাই এই জাগতিক বন্ধন-মুক্তি মানুষের পক্ষে অত্যাবশ্যক৷ আমরা দেখেছি, যেখানে জাগতিক পরাধীনতা---সেটা অর্থনৈতিক হোক, রাজনৈতিক হোক, সামাজিক হোক--- সেখানে মানুষের অন্তর্নিহিত গুণগুলো বা তার প্রতিভার সম্যক্ বিকাশ সুদূরপরাহত হয়৷ তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুক্তি চাই, জড়ের বন্ধন থেকে মুক্তি তো চাই-ই৷
জড়ের চেয়ে সূক্ষ্ম হ’ল মন৷ মানসিক দাসত্ব থেকে মনকে মুক্ত করতে হবে৷ আমরা দেখতে পাই, মানুষের সমাজে কত রকম মানসিক চাপ, কত রকম শোষণ চলেছে৷ এই শোষণ, এই অত্যাচার, এই মানসিক বন্ধন থেকে মুক্তির জন্যে মানুষকে অবশ্যই প্রয়াসশীল হতে হবে৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিলাভের এষণা মানুষ মাত্রেরই এক স্বাভাবিক ধর্ম৷ মানব মনের যা সার অংশ তার নাম বুদ্ধি৷ বোধিকে ঠিক মনের সারাংশ বলতে পারি না৷ বাস্তবে বোধি মনের চেয়েও সূক্ষ্ম ও এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ বোধিকে বলতে পারি একাদশ সত্তা অথবা ষষ্ঠেন্দ্রিয়৷ বৌদ্ধক জগতে এই যে শুদ্ধাশুদ্ধ, নিত্যানিত্য, শুচ্যশুচি বিচার---এর একটা মাপকাঠি রয়েছে৷ এই যে মাপকাঠি, এটাকে অবশ্যই নিষ্কলুষ থাকা দরকার৷ জড় জগতে বুদ্ধির ওপর নানান ধরণের শোষণ ও অত্যাচারের বন্ধনহেতু এক রুদ্ধ বেদনায় মানুষের অন্তরাত্মা কাঁদতে থাকে৷ ঠিক তেমনি মানসিক জগতে চিন্তা করার যে শক্তি মানুষের থাকা উচিত সেই শক্তিকেও ছিনিয়ে নেওয়া হয়৷ আবার ঠিক তেমনি বৌদ্ধক ক্ষেত্রে মানুষ যেখানে পারমার্থিক তথা প্রজ্ঞার বিকাশের জন্যে চিন্তা-ভাবনা করতে চেষ্টা করে সেখানে ভাবজড়তা(dogma) এসে বাঁধা সৃষ্টি করে৷
এখন এই ভাবজড়তা জিনিসটা কী?---না, সেটা হ’ল পূর্ব-নির্ধারিত ভাববিশেষ যার বাইরে মানুষকে যেতে নিষেধ করা হয়৷ এই পরিস্থিতিতে মানুষের বুদ্ধি পুরোপুরি কাজ করতে পারে না৷ কেউ কেউ বলে, ঠিক আছে, পুরো উপযোগ না পেলেও শতকরা দশ-বিশ ভাগ তো পেতে পার৷ কিন্তু আমার অভিমত হ’ল যে ভাবজড়তার ফলে মানব-মনীষার দশ-বিশ ভাগ অংশও ঠিকমত কাজে আসে না৷ যে অল্প একটু মানুষের কাজে আসে সেটা ঠিক খাঁটি জিনিস নয়৷
মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে তার মনন শক্তি, তার বুদ্ধি৷ এই বুদ্ধিকে আমি পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারব না---এর চেয়ে বেদনাদায়ক পরিস্থিতি আর কী হতে পারে৷ তাই মনের মুক্তি চাই ও তারও আগে বুদ্ধির মুক্তি চাই৷ ভাবজড়তার ব্যাপারটা হ’ল এই রকম ঃ বুদ্ধি একটা বিশেষ রাস্তা দিয়ে চলতে চাইছে এমন সময় ভাবজড়তা চারদিকে এসে যেন বলছে---না, না, তুমি ওধারে যেতে পারবে না৷ ভাবজড়তা বলে ঃ না ওধারে এক পা-ও বাড়িয়ো না৷ যদি যাও তো তোমাকে অনন্তকাল নরকাগ্ণিতে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে, অনন্তকাল তোমার নরক বাস হবে৷ বুদ্ধি যখন জাগতিক সম্পেিদর পুরোপুরি উপযোগ নিতে চায়, তখন ভাবজড়তা এগিয়ে এসে যেন বলে---না, এটা করা চলবে না৷ মানুষের পক্ষে এটা ক্ষতিকর, অপবিত্র৷ এতে মনুষ্যত্ব খর্ব হবে৷
মানুষের বুদ্ধি যখন পূর্ণ উদ্যমে মানুষভূমিতে সাহসিকতাপূর্ণ কোন কাজ করতে তৎপর হয় তখন এই ভাবজড়তা যেন এসে বলে---না, এমনটা করা চলবে না, এতে তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে এই ভাবজড়তা মানুষের মনের ওপর, বুদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি করে৷ তাই যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বুদ্ধিকে বন্ধনমুক্ত করতে না পারছি ততক্ষণ বুদ্ধিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না৷ তাই মানবতার সেবার জন্যে এই বুদ্ধিকে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে, ভাবজড়তা থেকে, নানাবিধ অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে৷ যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন মানুষ জাতির ভবিষ্যৎ স্বর্ণোজ্জ্বল হতে পারে না৷ যদি আজকের মানুষের সামনে স্বর্ণিম প্রভাত আনতে হয় তাহলে অসীম সাহসে ভর করে এই ভাবজড়তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বুদ্ধির সর্বাত্মক বন্ধন-মুক্তি ঘটাতে হবে৷ আর সেইজন্যেই আজ পৃথিবীর সকল প্রান্তেই আমাদের সমস্ত কণ্ঠে কেবল একটি উদ্ঘোষই যেন ধবনিত প্রতিধবনিত হয়---‘‘ভাবজড়তা আমরা মানি না, মানব না’’৷
(অভিমত, ৪/১১১ সন্ধ্যাবেলা, পটনা, ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৮০)