জীবের আধার প্রয়োজন৷ আধার ছাড়া হ’লে সে ব্রহ্ম–সমুদ্রে মিশে যায়৷ যেমন পুকুরে একবাটি জল, যতক্ষণ বাটি আছে ততক্ষণ বাটির জলও আছে, কিন্তু বাটি সরিয়ে নিলে বাটির জল পুকুরের জলেই মিশে যায়৷ যে জলের আধার ছিল বাটি, সেই আধার সরিয়ে নেবার পর তার জল পুকুরের জলের সঙ্গে এক হয়ে যায়৷ এইরূপ আধার হীন হ’লে জীবও ব্রহ্মে মিশে যায়৷
কামময় কোষ ঃ শরীর না থাকলে সংস্কার আত্মায় থেকে যায়৷ কেমন করে হিরণ্ময়লোক মানুষের সবচেয়ে সূক্ষ্ম শরীর৷ জীব স্থূলশরীর আহরণ করে ভূর্লোক থেকে, যেখানে তমোগুণ প্রধান, রজোগুণ সাধারণ ও সত্ত্বগুণ অল্প৷ সংস্কৃতে এর অপর নাম অন্নময় কোষ৷ এটি খাদ্যের দ্বারা তৈরী হয় অর্থাৎ পাঞ্চভৌতিক দেহ৷ দেহের পেছনে কাজ করে মন, যা কামময় কোষ (crude mental body) দ্বারা তৈরী হয়৷ এতে তমোগুণ প্রধান, সত্ত্ব মধ্যম আর রজঃ অল্প৷... এই কোষই জীবদেহকে সঞ্চালিত করে ও স্থূল ভৌতিক দেহের চেয়ে এই কোষ সূক্ষ্মতর৷ ...কোষ–সংরচনায় কামময় হ’ল স্থূলতম৷ আর তাই একে বলা হয় স্থূলমন (crude mind)৷ এই কামময় কোষ অণুজীবের ভৌতিক এষণাকে বা শারীরিক ক্রিয়াকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে (অর্থাৎ ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা ইত্যাদি দেহ সংক্রান্ত বৃত্তি৷)
মনোময় কোষ ঃ কামময় দেহের (pure mental body) পেছনে আছে, পরম ব্রহ্মের মানসিক জগৎ–স্বর্লোক৷ এর ওপরে আছে সাধারণ মন, যা মনোময়কোষ–সৃষ্ট এতে রজঃ প্রধান, তমঃ সাধারণ, আর সত্ত্ব অল্প৷ ......কামময় কোষের চেয়ে সূক্ষ্ম হ’ল মনোময় কোষ৷ মনোময় কোষের কাজ হ’ল স্মরণ ও মনন (recollection and contemplation)৷ মনোময় কোষকে সূক্ষ্মমন বলা হয় (Subtle mind)৷
অতিমানস কোষ ঃ মনের পেছনে মানুষেরই অতিমানস সত্তা বা দেহ বা কোষ আছে, যা মহর্লোক থেকে তৈরী হয়েছে৷ এতে রজঃ প্রধান, সত্ত্ব সাধারণ, আর তমঃ অল্প৷ কোষের অর্থ দেহ৷ এই চতুর্লোকে তিনটি কোষ আছে৷ ...... এই ঙ্মতিমানসৰ কোষেই জীবের সংস্কারের স্ফূরণ হয়৷ এই কোষেই কোন্ সংস্কার ভাল কি মন্দ সেই পার্থক্য অনুভূত হয় (এই কোষেই আত্মিক প্রেরণা প্রথম জাগ্রত হয়৷)৷
বিজ্ঞানময় কোষ ঃ এতেই সংস্কারের অবস্থিতি৷ এখানে সত্ত্ব প্রধান, তমঃ সাধারণ, আর রজঃ অল্প৷ মানসিক দেহকে বিজ্ঞানময় জগৎ বলা হয়৷ এরই নাম ব্রহ্মের জনর্লোক৷ ...... এই কোষেই জীবের অস্তিত্ব বা আমিত্ব–ৰোধ নিহিত থাকে৷ এই কোষেই বিবেক ও বৈরাগ্যের স্ফূরণ ঘটে ও এই কোষে অণুজীবের সাধনার ইচ্ছা জাগে৷
হিরণ্ময় কোষ ঃ একে তপর্লোক বলা হয়৷ এখানে সত্ত্ব প্রধান, রজঃ সাধারণ ও তমঃ অল্প৷ হিরণ্ময় শব্দের অর্থ স্বর্ণ নির্ম্মিত বা সোণালী৷ ...... এই কোষে এমনকি অস্তিত্বৰোধও স্পষ্টভাবে অনুভূত হয় না৷ বৈয়ষ্টিক চেতনা থাকে বটে, তবে তা থাকে অস্পষ্ট ও আবচ্ছাভাবে৷ এটাই মনের সূক্ষ্মতম কোষ৷ বস্তুতঃ বিজ্ঞানময় কোষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য নিৰন্ধন এই কোষে আমিত্ব–ৰোধের প্রতিফলন ঘটে৷ এই কোষ সোণার মতই বিশুদ্ধ বর্ণোজ্জ্বল৷
...অতিমানস, বিজ্ঞানময় ও হিরণ্ময় কোষ, যারা কামময় ও মনোময় কোষের সূক্ষ্মতর ও সূক্ষ্মতম স্তর, তাদের একত্রে বলা হয় কারণ মন (causal or astral mind)৷ স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ মনের জন্যে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে যে চেতন (conscious), অবচেতন (sub-conscious) ও অচেতন (unconscious) বলা হয়ে থাকে তা সঙ্গত বলে মনে হয় না৷ ...অণুজীবের পক্ষে কারণমন বলাটা একটা নিছক সৈদ্ধান্তিক ব্যাপার৷ ভূমার কারণ মন থেকে অণুজীবের কারণমনের কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই৷ যদি অণুজীবের স্থূল ও সূক্ষ্ম মনকে সাধনার দ্বারা বা অন্য কোনো উপায়ে রুদ্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে তার কারণমন পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে না৷ সেক্ষেত্রে কেবল পূর্বকৃত কর্মের ৰীজরূপী সংস্কার অক্ষুণ্ণ থাকায় অণুজীবকে ভূমাসত্তা থেকে পৃথক করা সম্ভব হবে৷ যথোপযুক্ত সাধনার দ্বারাই সাধক বিশ্বের এই অদ্বিতীয় কারণমনের অনুভব করে, ৰোঝে অণু ও ভূমার মধ্যে কারণমনের ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই৷ মানস–আভোগের সূক্ষ্মত্ব নিৰন্ধন অণুমনের সূক্ষ্ম ও স্থূল অংশ ভূমামনের স্থূল ও সূক্ষ্ম অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে৷ সূক্ষ্ম যোগসাধনার মাধ্যমে মানুষ তার আভোগকে সূক্ষ্ম করে তুলতে পারে৷
সত্যলোক ও সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া
সত্যলোক সেই অবস্থা, যে স্তরে সেই সত্যস্বরূপের স্থিতি ব্যতিরেকে অন্য কোনো কিছুই উপলব্ধ হয় না৷ সেখানে জড়তার, পরিণামের বা বিকারের কোনো দ্বৈত ভাবই নেই৷ স্বরূপতঃ জীবাত্মাও সেই অমৃতময় সত্যলোকেই স্থিত রয়েছে, এর স্থান হিরণ্ময় কোষের ঊর্ধ্বে৷
‘‘হিরণ্ময়ে পরে কোষে বিরজং ব্রহ্ম নিষ্কলম্৷
তচ্ছ্রুভ্রং জ্যোতিষাং জ্যোতিস্তদ্ যদাত্মবিদোবিদুঃ৷৷’’
প্রকৃতির প্রভাবে একই পরমাত্মা সপ্তলোকাত্মক প্রতীয়মান হচ্ছেন অর্থাৎ এই সপ্তলোকাত্মক বিকাশের জন্যে তাঁর মধ্যে মহৎ–তত্ত্বাদির সৃষ্টি হচ্ছে৷ আর তাঁর মানসদেহের জড়তম বিকাশ পাঞ্চভৌতিক তত্ত্ব থেকেও জীবাত্মা নিজ নিজ সংস্কার অনুযায়ী নিজেদের স্থূল পাঞ্চভৌতিক দেহ বা অন্নময় কোষ তৈরী করে নিচ্ছে৷ আর সেই অন্নময় কোষ ও ইন্দ্রিয়সমূহের সহায়তায় তারা তাদের বহির্জাগতিক বিষয় সমূহকে ভোগ করে সুখ পাবার চেষ্টা করছে৷ বস্তুতঃ এক অখণ্ডসত্তাই আছেন৷ জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদ সম্পূর্ণ উপাধিগত৷ যেখানে তাঁকে বিরাট মহৎ বা বিরাট অহংরূপ উপাধি দিয়ে ফেলেছি, সেখানেই তাঁকে বলছি–‘পরম ব্রহ্ম’, আর যেখানে তাঁকে সংস্কার সঞ্জাত পাঞ্চভৌতিক দেহের উপাধি দিচ্ছি, সেখানে তাকে বলছি ‘জীব’৷
‘‘তয়োর্বিরোধোয়ং উপাধি কল্পিতো নবাস্তবঃ কশ্চিদুপাধিরেষঃ৷
ঈশাদ্যমায়া মহদাদি কারণং জীবস্য কার্য্যং শৃণুপঞ্চকোষম্৷’’
সাধনা এই উপাধিগত ভেদ দূর করতেই শেখায়৷
‘‘এতাবুপাধি পর জীবয়োস্তয়ো সম্যগ্নিরাসেন পর ন জীবো৷
রাজ্যং নরেন্দ্রস্য ভটস্য খেটক স্তয়োরপোহেন ভটো ন রাজা৷৷’’
রাজ্য চিহ্ণ থাকলে যাকে বলি রাজা–মুদগর উপাধি থাকলে তাকেই আবার পালোয়ান বলা হয়৷ যেমন, বিশ্বনাথের কাছে রাজ্য চিহ্ণ থাকলে তাকে রাজা বলবো, আর মুদগর থাকলে তা’কেই বলবো পালোয়ান৷ কিন্তু রাজ্য অথবা মুদগর উপাধি তুলে নিলে বিশ্বনাথ, বিশ্বনাথই থেকে যাবে৷ সেইরূপ জীব আর পরমাত্মায় উপাধির জন্যেই ভেদ আছে৷ জীব থেকে উপাধিগত ভেদ তুলে নিলে সে ব্রহ্মে মিশে যায়–নিজের স্বরূপে চলে যায়৷
উপাধিগত দোষ যেখানে নেই, সেখানেই সত্য–আর সেটাই হ’ল সত্যিকারের পরিচয়–তার জন্যেই সাধনা, অর্থাৎ অসত্যকে পরাজিত করে, সত্যের প্রতিষ্ঠা করাই সাধনা৷ লোক আর কোষ সবই বিকৃতি–সত্য নয়৷