যে মানুষের যেমন আজীব তথা আভোগ, তদনুযায়ী তার স্থূল শরীর মেলে৷ যার মনে কেবল খাবার বাসনাই রয়েছে, পরমপুরুষ তাকে শুয়োরের শরীর দেবেন, যত খুশী সে খেতে পারবে৷ যার মনে ক্রোধ বেশী, তার মোষের শরীর মিলবে---যত বেশী ক্রুদ্ধ হতে চায়, হতে পারবে৷ আবার যার মনে পরমপুরুষের সান্নিধ্য লাভের বাসনা জাগবে, সে খুব উন্নত মানব শরীর লাভ করবে, সাত্ত্বিক শরীর লাভ করবে৷ যেমন আভোগ, তদনুযায়ী মানুষকে চলতে হয়৷
আজীব মানে জীবিকাও হয়৷ তাই মনের জীবিকাও পবিত্র হওয়া উচিত৷ ভগবান বুদ্ধের যে অষ্টাঙ্গ মার্গ তাতে সম্যক দর্শন, সম্যক আজীব, সম্যক বাক, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক সমাধি ইত্যাদির কথা বলা হয়ছে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে আজীব সুন্দরও হওয়া চাই৷ তাই মানুষের কলহজীবী হওয়া উচিত নয়৷ ওরা করে কি? ওরা মানুষের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে নেয়৷ আর ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ হওয়া উচিত নয়, কারণ ধর্মের নাম নিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়ে থাকে৷ আর ‘মৃতকজীবী’ও হতে নেই৷ কারণ ওরা চায় মানুষ মরুক আর ওদের আয় বাড়ুক৷ মানুষের কুশীদজীবী হওয়াও ঠিক নয়৷ ওরা চায়---আমি টাকা বিনিয়োগ করি, পার্টি কেবল আমার মুলধনের ওপর সুদ দিয়ে চলুক, মুলধন যেন শোধ না করে৷ শাস্ত্রে এই জন্যে বলা হয়েছে, এ ধরণের লোকদের অন্নগ্রহণ করা উচিত নয়৷ ধর্মব্যবসায়ী, কলহজীবী, মৃতকজীবী, কুশীদজীবী---এদের অন্ন অভোজ্য, কারণ এদের আজীবই ঘৃণিত৷
তাই আপন আপন আজীব তথা আভোগ নিয়েই জীব ব্যাপৃত রয়েছে৷ দূরে থাকায় তারা কিছুই দেখতে পায় না, আর যারা কাছে রয়েছে তারা দেখতে পায় যে পরমপুরুষ সব কিছুই দেখছেন৷ যে নিজের চোখ ঢেকে রেখেছে, সে ভাবে পৃথিবীর কেউ তাকে দেখছে না৷ যেমন শিকারী যখন খরগোসের ওপর হামলা করে, তখন খরগোস তার কান দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে নেয়৷ ও ভাবে, আমি যেমন শিকারীকে দেখতে পাচ্ছি না, শিকারীও তেমনি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না৷ কিন্তু মানুষকে এই কথাটা মনে রাখতে হবে যে, পরমপুরুষ সর্বদাই তার সাথে সাথে রয়েছেন৷ আর সাথে আছেন, এই জন্যে মানুষের ক্ষতির তুলনায় লাভই হয় অনেক বেশী৷ ক্ষতি এটাই যে পরমপুরুষ সবকিছু দেখে নেন, ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বলে দেন, এরকম করলে কেন? লাভটা হ’ল এই যে কোন অবস্থাতেই তুমি একলা নও, তুমি দুর্বল নও, তমি অসহায় নও, সর্বদাই পরমপুরুষ তোমার সাথে রযেছেন, তাই কোন অবস্থাতেই তুমি ঘাবড়ে যাবে না, ঘাবড়াবার কথাই ওঠে না৷
‘সর্বাজীবে সর্বসংস্থে’৷ একটু আগেই বলা হয়েছে, আজীব ও আভোগ অনুসারে মানুষের শরীর মিলবে৷ তোমার মানসিক ইচ্ছা যেমন হবে, তা পূরণের জন্যে তদনুরূপ শরীর চাই৷ তুমি যদি নাক দিয়ে জলপান করতে চাও তো তুমি হাতির শরীর পাবে৷ যেমন চাইবে তেমনই পাবে৷ তোমার শরীরটাও তদনুরূপ হবে৷ তোমরা জান, যেখানে কোনপ্রকার অর্ডার আছে, সেটা চক্রাকার হবেই৷ যেমন পরমানু চক্র atomic order)৷ সেখানে একটা বিন্দু রয়েছে আর তার চারিদিকে ইলেকট্রনগুলো ঘুরে চলেছে৷ পরমাণুচক্রে ইলেকট্রনের সংখ্যায় যদি এদিক ওদিক হয়ে যায়, আকর্ষণের ক্ষেত্রেও হেরফের হয়ে যাবে৷ ওর চেয়ে বড় চক্র রয়েছে, যেমন, পার্থিব চক্র৷ পৃথিবী রয়েছে আর চারপাশে চাঁদ ঘুরে চলেছে৷ তার চেয়ে বড় চক্র হ’ল সৌরচক্র৷ মাঝখানে সূর্য, তার চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরে চলেছে৷ আর সবচেয়ে বড় চক্র হ’ল ব্রহ্মচক্র৷ কেন্দ্রস্থলে পুরুষোত্তম আর যত জীব তথা অন্যান্য সব বস্তু তার চারপাশে ঘুরে চলেছে৷ এই ঘোরার কাজটা চলতেই থাকবে৷ এটাই সব থেকে বড় চক্র৷ একে বলি ব্রহ্মচক্র---cosmological system.)৷ প্রতিটি জীব ঘুরে চলেছে কিন্তু জীবের পরাগতি হ’ল সেই পুরুষোত্তম, যিনি চক্রের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত৷ তোমরা জান, এ বিষয়ে নারায়ণের উক্তি কী৷
‘নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে যোগীনাং হৃদয়ে ন চ৷
মদভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ৷৷’
নারায়ণ কে? ‘নার’ শব্দের অর্থ প্রকৃতি আর ’অয়ন’ মানে আশ্রয়৷ পরমাপ্রকৃতির যিনি আশ্রয় অর্থাৎ নারায়ণ, পরমপুরুষ৷ ‘নারায়ণ’ আর ‘মাধব’ শব্দের একই অর্থ৷ যেমন ‘মা’ মানে পরমাপ্রকৃতি, আর ‘ধব’ মানে পতি৷ তাই মাধব শব্দেরও অর্থ হ’ল পরমপুরুষ৷ ‘‘নাহং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে’৷ লোকে বলে, নারায়ণ বৈকুণ্ঠে থাকেন৷ ‘বৈকুণ্ঠ’ বলতে ঠিক কি বোঝায় বিগতা কুণ্ঠা ইত্যার্থে বৈকুণ্ঠ৷ ‘কুণ্ঠা’ মানে সংকোচন’ contraction)৷ যেখানে পাপ অথবা লজ্জাবশতঃ অথবা যে কোন বৃত্তির ফলে মন সঙ্কুচিত crippled) হয়ে পড়ে, তাকেই কুণ্ঠা বলা হয়৷ মনে কুণ্ঠা রাখা উচিত নয়৷ যেখানে গেলে মানুষের মন পরিব্যপ্ত হয়ে পড়ে, যেখানে মনে কোনপ্রকার কুণ্ঠা থাকে না, তাকেই বৈকুণ্ঠ বলা হয়৷ ওটাই নারয়ণের আবাসস্থল৷৷ নারায়ণ বলছেন---বৈকুণ্ঠও আমার তত প্রিয় নয়৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, নারায়ণ যদি বৈকুণ্ঠে না থাকেন তাহলে থাকবেন কোথায়? ‘যোগীনাং হৃদয়ে ন চ’৷ যোগীদের হৃদয়েও থাকেন না, তো কোথায় থাকেন? বৈকুণ্ঠ হ’ল এক সুন্দর পরিবেশ, এক সুন্দর পরিস্থিতি৷ ওখানে থাকলে ব্যাপ্তি বা অবমুক্তি---কোনটার সম্ভাবনাই সেখানে নেই৷
তাই ওই জায়গাটাও খুব ভালো জায়গা নয় অর্থাৎ ওটা মুক্তি-মোক্ষ লাভের স্থান নয়৷ মুক্তি মিললেও মিলতে পারে কিন্তু মোক্ষ নয়৷ যোগীদের হৃদয়টা কেমন? যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’৷ মনের যত বৃত্তি যত propencities, সেই সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎa stage of suspention — নিরুদ্ধাবস্থা, কোন অভিপ্রকাশ নেই, কেবল একটা জায়গাতেই আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে৷ বিরুদ্ধাবস্থা হলে থাকবেটা কোথায়? ‘‘মদভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ’৷
ভক্তবৃন্দ যেখানে আমার কীর্ত্তন করেন, আমি সেখানেই থাকি৷ আর তার মানে হ’ল পরমপুরুষ এক নিউক্লিয়াস’ ভক্তবৃন্দ যেখানে কীর্ত্তন করেন, নিউক্লিয়াস সেখানে পৌঁছে যান৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনি পরিব্যপ্ত হলেও নিউক্লিয়াস তো এখানে৷ এই জন্যেই মানুষকে সাধ্যমত ভজন-কীর্ত্তন করা উচিত৷ পরমপুরুষের প্রাণকেন্দ্র সেখানে পৌঁছে যাবে, আর তার ফলে ভজন-কীর্ত্তনের সময় বেশ জোরালো স্পন্দন উৎপন্ন হবে, মন ঊধর্বমুখী হবে৷
এই যে ব্রহ্মচক্র, ভক্তরা ভজন-কীর্ত্তনের দ্বারা ব্রহ্মচক্রের এই প্রাণকেন্দ্রকে আকর্ষণ করবেন ও নিজেরাও ব্রহ্মচক্রের দিকে চলতে থাকবেন৷
(মুম্বাই ধর্মমহাচক্র, ২৬শে নভেম্বর, ১৯৭৮, সুভাষিত সংগ্রহ চতুর্থ খণ্ড’)