মানুষের অভীষ্ট পরমপুরুষকে লাভ করতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তিনেরই প্রয়োজন৷ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে ভক্তির জাগরণ হয়৷ আর এই ভক্তিই মানুষকে ভুমানন্দ প্রাপ্তির পানে নিয়ে চলে৷
ভক্তি ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত কিন্তু জ্ঞান ও কর্ম তা নয়৷ জ্ঞানলাভ প্রায়শঃই মানুষকে অলস ও অহংকারী রূপে তৈরী করে৷ আর কর্মও মানুষের মধ্যে আনে আত্মম্ভরিতা৷ সাধক এই দু’য়ের ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কেবলা ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় না যা পরমপুরুষকে পাবার জন্যে অতীব প্রয়োজন৷ তাই ৰুদ্ধিমান সাধক সেই উপায়ই অবলম্বন করবে যা তাকে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে৷
সেজন্যে সাধককে জানতে হবে তার জ্ঞান যাতে কোনমতেই বন্ধ্যা জ্ঞানে পরিণত না হয় যা আজকের মানুষের মধ্যে সর্বদাই দেখা যায়৷ এই বন্ধ্যা জ্ঞান প্রগতির দিকে মানুষকে প্রোৎসাহিত করার পরিবর্তে চরম অবক্ষয় ও ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়৷
দেখা যায় যারা শুধুমাত্র জ্ঞানলাভের প্রয়াসে রত তারা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে৷ সর্বদা বই নিয়ে পড়ে থাকার কারণে তারা অলস ও নিষ্কর্মা হয়ে কাজ থেকে দূরে থাকে আর এতেই তাদের পতন হয়৷ নিজেকে এসব থেকে ত্রুটিমুক্ত রাখার সর্বোত্তম উপায় হ’ল মনে বিপরীত ভাবনা নিয়ে আসা ও সেই অনুযায়ী কাজ করা৷ অলসতা থেকে বাঁচতে তাই সর্বদা খুব কাজ করে যেতে হবে৷ কর্মকে (বা বস্তুকে) পরমপুরুষেরই অভিব্যক্তি মনে করে অধিক থেকে অধিকতর কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে৷ তাই বলা হয়েছে, ‘কর্ম ৰ্রহ্মেতি কর্ম বহু কুর্বিত৷’
কাজ বলতে এমন কিছু করা নয় যা থেকে কোন ফললাভই হবে না৷ সেটাই কর্ম যা সামূহিক কল্যাণের পক্ষে ফলপ্রসূ৷ সামূহিক কল্যাণকে বাস্তবায়িত করার কাজে নিয়োজিত থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ এটাই মানুষকে অলসতা ও নৈষ্কর্মের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে৷
অহংকার–জ্ঞানলাভের ফলে মানুষের মধ্যে যে অহংকার এসে যায় তার প্রভাব মানুষের জীবনে সুদূরপ্রসারী৷ এর ফলে একজন সম্পূর্ণভাবে পতিত হয়ে যায়৷ অহংকারকে তিন ভাবে ভাগ করতে পারি৷ আর এদের প্রত্যেকেরই প্রভাব খুবই অনিষ্টকারী৷
‘‘অভিমানং সুরাপানং
গৌরবং রৌরবং ধ্রুবম্৷
প্রতিষ্ঠা শুকরীবিষ্ঠা ত্রয়ং
ত্বত্ত্ব্ণা হরিং ভজেত৷৷’’
প্রথম ধরনের অহংকারকে বলে ‘অভিমান’৷ অভিমানের বশে একজন মানুষ ভাবতে শুরু করে সে সমাজ থেকে যা পাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশী পাওয়ার অধিকারী৷ এর ফলে প্রত্যেককে অবজ্ঞা করার একটা উদ্ধত মনোভাব তার মধ্যে জেগে ওঠে৷ অভিমানকে সুরাপানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যার ফলে একজন মদোমাতালের মতই কাণ্ডজ্ঞান খুইয়ে বসে৷ (মানুষ পশু থেকে পৃথক এই জন্যে যে তার মধ্যে আছে বিবেক ও ৰুদ্ধি৷ একজন পানাসক্ত যেমন করে তার অমূল্য গুণগুলোকে হারিয়ে ফেলে একজন অভিমানীগ্রস্ত ব্যষ্টি তেমনি বিবেক–ৰুদ্ধি বর্জিত হয়ে পড়ে৷) বিচারশীলতা না থাকাটা যেহেতু মৌল মানবীয় স্বভাবের (Virtues) বিরুদ্ধে তাই সুরাপান করা একটা পাপ৷ তেমনি অভিমানও পাপ ঙ্মৰাংলায় যে অর্থে অভিমান শব্দটি ব্যবহূত হয়, সংস্কৃতে তা একটু পৃথকৰ আর তা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবেই৷
দ্বিতীয় ধরনের অহংকার হচ্ছে গৌরব৷ এর অর্থ আত্মম্ভরিতা৷ অহংকারে ফুলে ফেঁপে উঠে একজন ব্যষ্টি নিজেকে অনেক অতিরঞ্জিত করে জাহির করে৷ অনেককেই বলতে শুণি যে তার বাগানে বেলুনের আকারে গোলাপ আছে অথচ বাস্তবে তার গোলাপ পিং পং বলের চেয়ে বড় নয়৷ এই ধরনের ভাবনা ও কাজে অনবরত নিয়োজিত থাকায় মন জড়ে পরিণত হয়ে যায়৷
আমরা দেখি ষাঁড় অহংকারে স্ফীত হয়ে রাস্তা দিয়ে চলেছে৷ সে ৰোঝাতে চাইছে আমি অনেক বড়–হাম বড়া৷ কিন্তু ষাঁড়টি মরে যাওয়ার পরে ষাঁড়ের আঁতরী (Intestines) দিয়ে তৈরী তারের মাধ্যমে তাঁতি যখন তাঁত বোনে আর যন্ত্রশিল্পী ত্তব্ভব্দন্ন্তুন্ত্রুগ্গ বীণা বাজায় তখন যে শব্দ বের হয়ে আসে ‘তুমিই বড়’৷ অর্থাৎ ষাঁড় ৰুঝেছে আর অন্যকেও বড় বলে মর্যাদা দিতে হবে, আর সে তার গৌরবজনিত স্পর্ধার ফলে এই শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে৷