এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই দেশ–কাল–পাত্রে আধৃত৷ কাল জিনিসটা কী? ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ –– Mental measurement of motivity of action৷ দেশ আছে৷ সে চক্রাকারে বিবর্ত্তিত হয়ে চলেছে৷ এই মাপাটার নাম কাল৷ ব্যাপকভাবে এই কালকে বলব মহাকাল৷ আর তার খণ্ডগত হিসেবকে বলব কাল৷ দেশগত বিবর্তন না থাকলে কাল থাকে না৷ অর্থাৎ দেশ–পাত্র রহিত কাল হয় না৷
আমরা কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় অনাদিকাল বলি, অনন্তকাল বলি – সেটা ব্যাপকতা ৰোঝাবার জন্যে৷ কিন্তু যখন এই পৃথিবীটা ছিল না, যখন পৃথিবীর মানুষ ছিল না, তখন কালের পরিমাপের কোন ব্যবস্থা ছিল না৷ পরিমাপক না থাকায় কালও ছিল না৷ তবে এই পৃথিবীটাই তো সব কিছু নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই রকম আরও অনেক গ্রহ আছে, অনেক তারাও আছে, আর আজ যেখানে তারা নেই, হয়তো ভবিষ্যতে সেখানে থাকবে৷ সুতরাং কোথাও না কোথাও ছিল৷ সমষ্টিগত কালকে বলি মহাকাল৷
আমাদের এই পৃথিবীতে কাল কিভাবে নির্দ্ধারিত হচ্ছে? চন্দ্রের হিসেবে ও সূর্যের হিসেবে৷ পৃথিবীকে স্থির ধরে সূর্য ঘুরছে এরকম মনে করে যে গণনা তাকে বলি সোলার সিষ্টেম –– সৌর বর্ষ, সৌর পরিমাপ৷ আর পৃথিবী স্থির আছে, চাঁদ ঘুরছে এই ধরে চন্দ্র পরিমাপ৷ আজ আমাদের যে আন্তর্জাতিক নববর্ষ দিবস (ইণ্টার ন্যাশনাল নিয়ূইয়ার্স ডে) এটা হ’ল সৌর পরিমাপ৷ এক কালে মার্চ মাস থেকে এর গণনা শুরু হত৷ মার্চ ছিল প্রথম মাস৷ সে বিচারে সেপ্ঢেম্বর ছিল সপ্তম মাস, অক্টোবর অষ্টম মাস, নভেম্বর নবম মাস, ডিসেম্বর দশম মাস, জানুয়ারী একাদশ ও ফেব্রুয়ারী দ্বাদশ মাস৷ ল্যাটিনে সেপ্ঢ মানে সপ্ত, অক্টো মানে আট, নোভা মানে নয়, ডিসম মানে দশ৷ কিন্তু পরবর্ত্তীকালে রোমান রাজাদের চেষ্টাতেই পরিবর্ত্তন করে জানুয়ারী থেকে গণনা শুরু হয়৷ সে গণনাও বেশ কিছুকাল চলে৷ কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে ফেব্রুয়ারী মাস নিয়ে৷ তখন ঠিক করা হ’ল, প্রতি চার বৎসর লীপ্ ইয়ার করে হিসাবটাকে মানিয়ে নেওয়া হবে৷ যেমন ৰাঙলাতেও করা হ’ল –– পুরোনো হিসেব ছেড়ে দিয়ে পরে জয়ন্ত পাণিগ্রাহী নোতুন ৰাঙলা হিসেব চালু করেন৷ তেমনি নোতুন এই যে পঞ্জিকার হিসেব এও অনেকদিন ধরে চলেছে৷ এও একটা কাল৷ অর্থাৎ ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ –– মানুষই মাপতে শিখল৷ এখন যে মানুষ মাপছে, সেই মানুষই চলছে, খাচ্ছে, মুখে হাসছে, ব্যথায় কাঁদছে৷ তার এই হাসা–কাঁদা, তার এই এগিয়ে চলা, তার হাঁটু ভেঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া –– সবই কালের সঙ্গে সম্বন্ধিত৷ কালবর্জিত তো কেউ নেই যদিও সেই গণনাটা মানুষের মানসিকতার দ্বারাই হয়ে চলেছে৷
নোতুন বৎসর এল৷ এই গণনাটা মানুষই করছে৷ আবার এই হিসেবের ভেতর মানুষকে চলতে হবে, হাসতে হবে, কাঁদতে হবে, সুখ–দুঃখ–ব্যথা–বেদ্ নিয়ে অনেক কিছুই করতে হবে, সমাজকে নোতুন ভাবে গড়তে হবে, অনেক গড়া জিনিসকে ভেঙ্গে আরও নোতুন ভাবে গড়তে হবে –– কত কিছুই না করতে হবে৷
আমি আশাবাদী৷ আমি জানি, পরমপুরুষ যা করেন বা করে চলেছেন, তা অপূর্ণতা (Imperfection) থেকে পূর্ণতার (perfection) দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে৷ Human movement is a movement towards perfection. So for everything, for anything and everything for this universe, each and every person should be optimistic. ছোট বড় প্রতিটি ব্যাপারে, প্রতিটি পদবিক্ষেপে প্রতিটি মানুষকে আশাবাদী হতে হবে৷ আমি মানুষকে আশার গান শুণিয়ে এসেছি, শুণিয়ে যাবো৷ কারণ আমি জানি, যার লক্ষ্য সম্পূর্ণতার দিকে তার জয় অবশ্যম্ভাবী৷
আমি আশা করব, এই বৎসর যারা ধর্ম ৰুদ্ধিপ্রেষিত হয়ে এ পৃথিবীতে চলছে, তাদের পক্ষে এ বৎসর আনন্দের বৎসর হবে –– জয়ের বৎসর হবে৷ আনন্দে তাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, উল্লসিত হবে৷ আমি আশা করব, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানবাত্মা –– যারা কেঁদে চলেছে অথচ যাদের চোখের জল মোছাবার কেউ নেই, এই বৎসর তাদের চোখের জল মুছিয়ে দেবে৷ আর আমি আশা করব –– যে দানব বা দানবেরা মানুষকে কাঁদাচ্ছে, মানুষকে অশেষ ভাবে নির্যাতনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যে দানবেরা মানুষকে সবসময় দাসত্বের শৃঙ্খলে আৰদ্ধ করে রাখতে চাইছে, এ বৎসর তাদের কাছে কাল বৎসর বলে গণ্য হবে৷ আমি চাই, তোমরা হাসতে হাসতে ডিউটি করে যাও, তোমরা হাসতে হাসতে অন্যের চোখের জল মুছে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলো৷
‘‘ঊনবিংশ অশীতিবর্ষস্য অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু৷
হিতায় ভবতু, সর্বার্থ সাধকায় ভবতু, কল্যাণমস্তু৷৷’’
(১ জানুয়ারী ১৯৮০, কলিকাতা)