ওঁ–কার ও ইষ্টমন্ত্র

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

এখন সংক্ষেপে ‘‘ওঁকার ও ইষ্টমন্ত্র’’ সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলব৷ জেনে বা না জেনে প্রতিটি জৈবিক সত্তা পরমপুরুষকে ভালবাসে, তাঁর ভালবাসা পেতে চায়৷ আর সৃষ্টির ঊষালগ্ণ থেকেই (আমি মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে না বলে বলছি মানুষ সৃষ্টির প্রথম অবস্থা থেকে) তাদের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জ্ঞাতে–জ্ঞাতে সেই পরমপুরুষের দিকেই প্রধাবিত হয়ে চলেছে৷

ওঁম্–কার কী?  বেদে ওঁম্–কার সম্বন্ধে বলা হয়েছে–

‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি৷

যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’

‘‘সবে বেদা’’–সর্ব প্রকার বেদ৷ সংস্কৃতে মূল ধাতু বিদ মানে জানা৷ তাই বেদ মানে জ্ঞান৷ সুতরাং সবরকম ক্রিয়াত্মক প্রয়াসে–অর্থাৎ তা জ্ঞানাত্মক বা কর্মাত্মক যাই হোক–লক্ষ্য ছিলেন পরমপুরুষ৷ আর এখনও তিনিই লক্ষ্য, ভবিষ্যতেও পরমপুরুষই লক্ষ্য থেকে যাবেন৷ ‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি’’–অর্থাৎ যাঁর অনুসন্ধান বা যাঁকে জানতে.....৷

‘‘তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি’’–তপঃ মানে কৃচ্ছ সাধন–নিজে কষ্ট স্বীকার করে অন্যের মঙ্গলসাধন৷ আর আধ্যাত্মিক দিক থেকে তপঃ মানে কেবলমাত্র পরমপুরুষের সন্তোষ বিধানে কষ্টবরণ করা৷ তাই ‘‘তপাংসি সর্বাণি.....’’ কথাগুলির অর্থ অধ্যাত্মপিপাসুরা তাঁকে সন্তুষ্ট করতেই তপসাধনে রত৷

‘‘যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি’’–অর্থাৎ ব্রহ্মচারীরা তাঁকে পেতে তাঁর মধুর সংস্পর্শে আসতেই ব্রহ্মচর্যের অনুশীলন করে থাকেন৷

‘ব্রহ্মচারী’ কথাটার সঠিক অর্থ তোমরা জান কি? মানুষের জীবন আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যে নির্দিষ্ট৷ এ ছাড়া জীবনের অন্য উদ্দেশ্য, অন্য কামনা, অন্য কোন লক্ষ্য থাকতে পারে না৷ কিন্তু তোমার শরীর যা দিয়ে তুমি সবকিছু কর তা জড় জগতের মধ্যেই আছে৷ তাই দেহ পরিপোষণের জন্যে তোমার চাই খাদ্য, বস্ত্র, একটি গৃহ ও অন্যান্য অনেক কিছু৷ সেই জন্যে তোমার চিন্তাভাবনার একটি অংশ–ওই সব জাগতিক বস্তুতে সংলিপ্ত থাকবেই৷ তাহলে তোমার কী করা উচিত? দৈহিক বা মানসিকভাবে তুমি যখন এই সব বস্তুর সংস্পর্শে আস তখন তোমাকে ওই বস্তুসমূহের ওপর ব্রহ্মভাবনার আরোপণ করতে হয়৷ এই ভাবে তুমি যখন প্রতিটি জাগতিক বস্তুর ওপর ব্রহ্মভাবনা তথা নারায়ণ ভাবনা আরোপ করতে থাকবে তখনই তুমি প্রকৃত ব্রহ্মচর্যের অনুশীলনকারী হবে৷

‘‘যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচরং চরন্তি

তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’

–অর্থাৎ যম বলছেন, ‘‘সেই পরমপদে পৌঁছানোর জন্যে, তাঁকে পাবার জন্যে আমি ওঁঙ্কারের উচ্চারণ করি৷’’

তোমরা জান এই মহাবিশ্বে কিছুই স্থির নয়৷ অচঞ্চল নয়৷ সব কিছুই চলে চলেছে৷ আর তা চলছে দেশ–কাল পাত্রাধিগত আপেক্ষিকতার পরিভূর মধ্যে৷ সমগ্র মহাবিশ্ব আবার এক সামবায়িক অস্তিত্ব হিসেবে নিজেও গতিশীল৷ কেননা ভূমাসত্তার কল্পনা ধারায় তথা মানস প্রক্ষেপণেও গতিশীলতা আছে৷ যেখানেই গতি, সেখানেই স্পন্দন আর কোন না কোন জড় শক্তির (energy) অভিপ্রকাশ৷ তোমরা জান সব রকমের শক্তিই পরস্পর পরিবর্তনশীল (Inter-transmutable)৷ আলোকশক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে৷ তেমনি মানুষের প্রাণশক্তি বা প্রাণাঃ (Vital energy) আধ্যাত্মিক শক্তিতে, এমনকি বিদ্যুৎশক্তিতে, আলোকশক্তি ও শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে৷ তুমি যখন কথা বলছ তখন তোমার প্রাণশক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে৷

এখন এই রূপান্তরণ চলছে অনাদি থেকে অনন্তের দিকে৷ আর এই দুইয়ের মাঝখানে (অনাদি ও অনন্তের মধ্যে) থেকে যাচ্ছে যে বিশাল পরিসর, তার মধ্যেই আমাদের এই মহাবিশ্ব, এই পরিদৃশ্যমান জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান–যা এক ও অদ্বিতীয় কারণ–সত্তা থেকেই সৃষ্ট৷ এই গতিশীলতার জন্যেই উৎসারিত হচ্ছে মহাজাগতিক ধ্বনিগত অভিপ্রকাশ৷ নিষ্ঠাবান সাধক নিজ সাধনার মাধ্যমে নিজের কাণকে উপযুক্ত ভাবে প্রশিক্ষিত করে এই ধ্বনি শ্রবণ করতে পারে৷ সেই ধ্বনিই হচ্ছে ওঁং–কার৷ এই মহাবিশ্বের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যত ধ্বনি আছে, ওঁঙ্কার হচ্ছে তাদের সামবায়িক বা মিলিত ভাব৷

 

এখন সৃষ্টির সমস্ত তরঙ্গ, সমস্ত স্পান্দনিক অভিব্যক্তি উৎসারিত হচ্ছে একই কেন্দ্রবিন্দু থেকে৷ সেই Supreme Nave থেকে স্থূলতার দিকে সৃষ্টির যে গতি তা যদি ধনাত্মক হয় তাহলে Supreme Nave–এর পানে অগ্রসর হবার জন্যে সাধকের যে প্রয়াস তা অবশ্যই হবে ঋণাত্মক৷ এই প্রয়াস প্রথমে হবে শারীরিক–মানসিক স্তরে৷ দ্বিতীয় স্তরে, বিশুদ্ধ মানসিক তৃতীয় স্তরে, মানস–আধ্যাত্মিক, আর শেষ স্তরে তা হবে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক৷ সংস্কৃতে এই চারটি স্তরকে বলে–ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ বা চতুর্বর্গ৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে ওঁঙ্কারের সূত্রপাত–বিন্দুটি ভূমা মানস–সত্তার সঙ্গে নিকট সম্পর্কযুক্ত [ওঁঙ্কারের আগের স্তরেই হচ্ছে ‘নাদ’৷ তার আগে কামবীজ বিন্দু ও তার আগে ভূমাসত্তা]৷ আর অন্য প্রান্তে আছে অণুমানস সত্তা [যার প্রকৃত লক্ষ্য ভূমাসত্তা বা পরমপুরুষ]৷ ওঁঙ্কারকে প্রণব বলা হয় (যা এসেছে প্র–নু + অল্ প্রত্যয় যোগে)৷ ‘প্রণব’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সেই সত্তা যা তোমাকে অর্থাৎ অণুমানস–সত্তাকে সেই পরম সত্তার দিকে নিয়ে চলে বা প্রেষিত করে৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ওঁং–কার যেহেতু মহাজাগতিক ক্ষেত্রে সমস্ত ধ্বনির মিলিত ভাব মুখে উচ্চারণ করবার নয়৷ তা [অন্তঃকর্ণে] শুণতে হয়৷ কেননা তোমার জিহ্বা ঠিকভাবে তা উচ্চারণ করতে পারবে না৷ এটা তার সামর্থ্যের বাইরে৷ (আগেই বলা হয়েছে) ওঁং–কার হ’ল এক অন্তহীন শব্দপ্রবাহ৷ এ জন্যেই একে শব্দব্রহ্মও বলা হয়৷

এখন দেখা যাক ‘ইষ্ট’ শব্দের মানে কী? ‘ইষ্ট’ শব্দের তাৎপর্য অনেকগুলি–‘‘সবচেয়ে প্রিয়’’, ‘‘ভালবাসার পাত্র’’, ‘‘আকর্ষক তত্ত্ব’’, ‘‘লক্ষ্য’’, ‘‘পরম কামনার ধন’’ ‘‘যাত্রা পথের অন্তিম বিন্দু’’ ইত্যাদি৷ ‘মন্ত্র’ শব্দের অর্থ–‘‘মননাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ মন্ত্রঃ পরিকীর্তিতঃ’’৷ ‘‘মনন’’ মানে আন্তরিক অভিভাবন বা মনে বার বার উচ্চারণ করা৷ আর ‘‘তারয়েৎ যস্তু’’ মানে যা আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন থেকে ত্রাণ করে৷

সাধকের পক্ষে তার ইষ্টমন্ত্রই হচ্ছে প্রণব৷ কারণ তা তাকে পরমপুরুষের দিকে প্রেষিত করে৷ শুধু তাই নয়৷ এই ইষ্টমন্ত্র সাধককে পরমপুরুষের নিকটতম সংস্পর্শে আসতে, তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলেমিশে এক হয়ে যেতে সাহায্য করে৷ সেই জন্যে সাধকের কাছে ওঁং–কার প্রণব নয়, তার কাছে নিজের ইষ্টমন্ত্রই হচ্ছে প্রণব [কেননা ওঁঙ্কার পরমতত্ত্বের সঙ্গে মনকে একীভূত করতে পারে না]৷ এই কারণে সাধনার ক্ষেত্রে ইষ্টমন্ত্রকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ প্রত্যেক সাধকের নিজস্ব ইষ্টমন্ত্রই তার কাছে সবচেয়ে অর্থবহ তথা মূল্যবহ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা শব্দনিচয়৷ সাধকের কাছে নিজের ইষ্টমন্ত্র ছাড়া অন্যের ইষ্টমন্ত্রের কোন মূল্যই নেই৷

তোমরা হনুমান সম্পর্কে পুরাণের গল্পটা জানতো? পুরাণের গল্প অনুযায়ী হনুমান রামের পরম ভক্ত ছিলেন৷ একবার হনুমানকে অন্যান্য ভক্তেরা বললেন– ‘‘হনুমান, তুমি তো জান ‘রাম’ আর ‘নারায়ণে’র মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তাঁরা দু’জনে তো আসলে একই সত্তা৷’’

‘রাম’ শব্দের অর্থ–‘‘রমন্তে যোগীনঃ যস্মিন্’’–যোগীর সবচেয়ে প্রিয়, পরম কামনার ধন৷ তিনি কে?–না, পরমপুরুষ৷ ‘রাম’ মানে পরমপুরুষ৷ আর ‘নারায়ণ’ মানে কী? ‘নার’ মানে প্রকৃতি, ভক্তি বা জল৷ তাহলে ‘নার শব্দের তিনটি অর্থ–‘নার’ মানে নীর অর্থাৎ জল (সংস্কৃতে জলের পর্যায়বাচক শব্দগুলি হচ্ছে ‘নীরম্’, ‘জলম্’, ‘পানীয়ম্’, ‘তোয়ম্’, ‘উদকম্’, ‘কম্বলম্’)৷

‘নার’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থ ভক্তি৷ প্রাচীনকালে ‘নারদ’ নামে এক মহামুনী ছিলেন৷ [‘দ’ মানে ‘বিতরণকারী’ ]৷ তাঁর কাজ ছিল ভারত, তিব্বত, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ঘুরে ঘুরে পরমপুরুষের নাম কীর্ত্তন করা–অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভক্তি বিতরণ করা৷ তাই তিনি ‘নারদ’ নামে জনপ্রিয় ছিলেন–‘‘নার দেনেবালা’’ অর্থাৎ ভক্তি বিতরণকারী৷

‘নার’ শব্দের প্রথম অর্থের ক্ষেত্রে তোমরা জান–রেলওয়ে ষ্টেশনে কিছু লোকের দায়িত্ব থাকে যাত্রীকে জল বিতরণ করা৷ তারাও তো সেই অর্থে ‘নারদ’৷ তাই না? যাই হোক, তাদের বলা হয় ‘পানী পাড়ে’৷

‘নার’ শব্দের তৃতীয় অর্থ হচ্ছে পরমাপ্রকৃতি, মহামায়া, মহালক্ষী–অর্থাৎ পরমপুরুষের সর্জনকারী শক্তি, সগুণাত্মক তত্ত্ব৷ নারায়ণের ‘অয়ন’ শব্দের অর্থ আশ্রয়৷ কালির জন্যে দোয়াত যেমন আশ্রয়৷ তেমনি ‘নার’ অর্থাৎ প্রকৃতির আশ্রয় হলেন ‘নারায়ণ’ অর্থাৎ পরমপুরুষ৷

তাহলে দেখা গেল দার্শনিক দিক থেকে ‘নারায়ণ’ আর ‘রামে’ কোন তফাৎ নেই৷ কেননা ‘রাম’ মানেও পরমপুরুষ, নারায়ণ মানেও পরমপুরুষ৷ তাই হনুমানকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে–‘‘হে হনুমান, তুমি বড় ভক্ত৷ তুমি উচ্চস্তরের সাধক৷ তাহলে তুমি কেন শুধু রাম নামেরই উচ্চারণ কর৷ ভুলেও তো নারায়ণের জপ করনা৷’’ আসল ব্যাপারটা হ’ল হনুমানের ইষ্টমন্ত্র ছিল রাম৷ তাই এ সম্পর্কে হনুমানের যে উত্তর ছিল তা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা তোমাদের সর্বদা স্মরণ  রাখা উচিত৷ হনুমান বললেন –

‘‘শ্রীনাথে জানকীনাথে চাভেদ পরমাত্মনি

তথাপি মম সর্বস্ব শ্রীরাম কমললোচন৷’’

–‘‘আমি জানি শ্রীনাথ (‘শ্রী’ মানে পরমাপ্রকৃতি আর ‘নাথ’ মানে প্রভু ‘শ্রীনাথ’ মানে পরমাপ্রকৃতির প্রভু অর্থাৎ নারায়ণ বা পরমপুরুষ) ও জানকীনাথের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই৷ কেননা জানকীনাথ মানেও রাম–জানকীর নাথ বা পতি অর্থাৎ রাম অর্থাৎ পরমপুরুষ৷ তাই এদের মধ্যে সত্যিকারের কোন প্রভেদ নেই৷ কিন্তু হে প্রিয় সজ্জনেরা, শুণুন৷ আমার কাছে একমাত্র অর্থবহ শব্দ হচ্ছে আমার ইষ্টের নাম অর্থাৎ রাম৷ তাই ‘শ্রীনাথ’, ‘নারায়ণ’ এই শব্দগুলি আমার কাছে মূল্যহীন৷ আমার কাছে এই শব্দগুলির কোন স্বীকৃতিই নেই৷’’

তোমরা আমার ছেলেমেয়েরা, সাধকেরা, এই মহাবিশ্বে তোমাদের কাছে পরম মূল্যবান শব্দ হচ্ছে, তোমার পরম অবলম্বন হচ্ছে তোমার নিজস্ব ইষ্টমন্ত্র*৷ আর বাকী শব্দগুলি [অন্যের ইষ্টমন্ত্র] তোমার কাছে মূল্যহীন৷  

সান্ধ্যকালীন দর্শন, ২২ নবেম্বর ১৯৭০, হায়দ্রাবাদ