এখন সংক্ষেপে ‘‘ওঁকার ও ইষ্টমন্ত্র’’ সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলব৷ জেনে বা না জেনে প্রতিটি জৈবিক সত্তা পরমপুরুষকে ভালবাসে, তাঁর ভালবাসা পেতে চায়৷ আর সৃষ্টির ঊষালগ্ণ থেকেই (আমি মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে না বলে বলছি মানুষ সৃষ্টির প্রথম অবস্থা থেকে) তাদের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জ্ঞাতে–জ্ঞাতে সেই পরমপুরুষের দিকেই প্রধাবিত হয়ে চলেছে৷
ওঁম্–কার কী? বেদে ওঁম্–কার সম্বন্ধে বলা হয়েছে–
‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি৷
যদিচ্ছন্তো ৰ্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’
‘‘সবে বেদা’’–সর্ব প্রকার বেদ৷ সংস্কৃতে মূল ধাতু বিদ মানে জানা৷ তাই বেদ মানে জ্ঞান৷ সুতরাং সবরকম ক্রিয়াত্মক প্রয়াসে–অর্থাৎ তা জ্ঞানাত্মক বা কর্মাত্মক যাই হোক–লক্ষ্য ছিলেন পরমপুরুষ৷ আর এখনও তিনিই লক্ষ্য, ভবিষ্যতেও পরমপুরুষই লক্ষ্য থেকে যাবেন৷ ‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি’’–অর্থাৎ যাঁর অনুসন্ধান বা যাঁকে জানতে.....৷
‘‘তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি’’–তপঃ মানে কৃচ্ছ সাধন–নিজে কষ্ট স্বীকার করে অন্যের মঙ্গলসাধন৷ আর আধ্যাত্মিক দিক থেকে তপঃ মানে কেবলমাত্র পরমপুরুষের সন্তোষ বিধানে কষ্টবরণ করা৷ তাই ‘‘তপাংসি সর্বাণি.....’’ কথাগুলির অর্থ অধ্যাত্মপিপাসুরা তাঁকে সন্তুষ্ট করতেই তপসাধনে রত৷
‘‘যদিচ্ছন্তো ৰ্রহ্মচর্যং চরন্তি’’–অর্থাৎ ৰ্রহ্মচারীরা তাঁকে পেতে তাঁর মধুর সংস্পর্শে আসতেই ৰ্রহ্মচর্যের অনুশীলন করে থাকেন৷
‘ৰ্রহ্মচারী’ কথাটার সঠিক অর্থ তোমরা জান কি? মানুষের জীবন আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যে নির্দিষ্ট৷ এ ছাড়া জীবনের অন্য উদ্দেশ্য, অন্য কামনা, অন্য কোন লক্ষ্য থাকতে পারে না৷ কিন্তু তোমার শরীর যা দিয়ে তুমি সবকিছু কর তা জড় জগতের মধ্যেই আছে৷ তাই দেহ পরিপোষণের জন্যে তোমার চাই খাদ্য, বস্ত্র, একটি গৃহ ও অন্যান্য অনেক কিছু৷ সেই জন্যে তোমার চিন্তাভাবনার একটি অংশ–ওই সব জাগতিক বস্তুতে সংলিপ্ত থাকবেই৷ তাহলে তোমার কী করা উচিত? দৈহিক বা মানসিকভাবে তুমি যখন এই সব বস্তুর সংস্পর্শে আস তখন তোমাকে ওই বস্তুসমূহের ওপর ৰ্রহ্মভাবনার আরোপণ করতে হয়৷ এই ভাবে তুমি যখন প্রতিটি জাগতিক বস্তুর ওপর ৰ্রহ্মভাবনা তথা নারায়ণ ভাবনা আরোপ করতে থাকবে তখনই তুমি প্রকৃত ৰ্রহ্মচর্যের অনুশীলনকারী হবে৷
‘‘যদিচ্ছন্তো ৰ্রহ্মচরং চরন্তি
তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’
–অর্থাৎ যম বলছেন, ‘‘সেই পরমপদে পৌঁছানোর জন্যে, তাঁকে পাবার জন্যে আমি ওঁঙ্কারের উচ্চারণ করি৷’’
তোমরা জান এই মহাবিশ্বে কিছুই স্থির নয়৷ অচঞ্চল নয়৷ সব কিছুই চলে চলেছে৷ আর তা চলছে দেশ–কাল পাত্রাধিগত আপেক্ষিকতার পরিভূর মধ্যে৷ সমগ্র মহাবিশ্ব আবার এক সামবায়িক অস্তিত্ব হিসেবে নিজেও গতিশীল৷ কেননা ভূমাসত্তার কল্পনা ধারায় তথা মানস প্রক্ষেপণেও গতিশীলতা আছে৷ যেখানেই গতি, সেখানেই স্পন্দন আর কোন না কোন জড় শক্তির ন্দ্বুন্দ্বব্জন্ধম্ভগ্গ অভিপ্রকাশ৷ তোমরা জান সব রকমের শক্তিই পরস্পর পরিবর্তনশীল ঢুব্ধন্দ্বব্জ–ব্ধব্জ্ত্র্৷ আলোকশক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে৷ তেমনি মানুষের প্রাণশক্তি বা প্রাণাঃ দ্দন্ব্ধ্ত্রপ্ত ন্দ্বুন্দ্বব্জন্ধম্ভগ্গ আধ্যাত্মিক শক্তিতে, এমনকি বিদ্যুৎশক্তিতে, আলোকশক্তি ও শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে৷ তুমি যখন কথা বলছ তখন তোমার প্রাণশক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে৷
এখন এই রূপান্তরণ চলছে অনাদি থেকে অনন্তের দিকে৷ আর এই দুইয়ের মাঝখানে (অনাদি ও অনন্তের মধ্যে) থেকে যাচ্ছে যে বিশাল পরিসর, তার মধ্যেই আমাদের এই মহাবিশ্ব, এই পরিদৃশ্যমান জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান–যা এক ও অদ্বিতীয় কারণ–সত্তা থেকেই সৃষ্ট৷ এই গতিশীলতার জন্যেই উৎসারিত হচ্ছে মহাজাগতিক ধ্বনিগত অভিপ্রকাশ৷ নিষ্ঠাবান সাধক নিজ সাধনার মাধ্যমে নিজের কাণকে উপযুক্ত ভাবে প্রশিক্ষিত করে এই ধ্বনি শ্রবণ করতে পারে৷ সেই ধ্বনিই হচ্ছে ওঁং–কার৷ এই মহাবিশ্বের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যত ধ্বনি আছে, ওঁঙ্কার হচ্ছে তাদের সামবায়িক বা মিলিত ভাব৷
এখন সৃষ্টির সমস্ত তরঙ্গ, সমস্ত স্পান্দনিক অভিব্যক্তি উৎসারিত হচ্ছে একই কেন্দ্রবিন্দু থেকে৷ সেই ত্রব্ভহ্মব্জন্দ্বপ্পন্ ত্ত্ব্ত্র্লন্দ্ব থেকে স্থূলতার দিকে সৃষ্টির যে গতি তা যদি ধনাত্মক হয় তাহলে ত্রব্ভহ্মব্জন্দ্বপ্পন্ ত্ত্ব্ত্র্লন্দ্ব–এর পানে অগ্রসর হবার জন্যে সাধকের যে প্রয়াস তা অবশ্যই হবে ঋণাত্মক৷ এই প্রয়াস প্রথমে হবে শারীরিক–মানসিক স্তরে৷ দ্বিতীয় স্তরে, বিশুদ্ধ মানসিক তৃতীয় স্তরে, মানস–আধ্যাত্মিক, আর শেষ স্তরে তা হবে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক৷ সংস্কৃতে এই চারটি স্তরকে বলে–ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ বা চতুর্বর্গ৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে ওঁঙ্কারের সূত্রপাত–বিন্দুটি ভূমা মানস–সত্তার সঙ্গে নিকট সম্পর্কযুক্ত (ওঁঙ্কারের আগের স্তরেই হচ্ছে ‘নাদ’৷ তার আগে কামৰীজ বিন্দু ও তার আগে ভূমাসত্তা)৷ আর অন্য প্রান্তে আছে অণুমানস সত্তা (যার প্রকৃত লক্ষ্য ভূমাসত্তা বা পরমপুরুষ)৷ ওঁঙ্কারকে প্রণব বলা হয় (যা এসেছে প্র–নু+অল্ প্রত্যয় যোগে)৷