কৌশিকী নৃত্য

লেখক
সুভাষপ্রকাশ পাল

আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে এই ধূলার ধরনীতে  পরমপুরুষ নরদেহ ধারণ করে তারকব্রহ্মরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর দিব্য আবির্ভাবে অধ্যাত্মবিদ্যা,শিক্ষা,চিকিৎসাশাস্ত্র,সঙ্গীত,নৃত্য,বিবাহব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা সবকিছুতেই একটা নোতুনত্বের ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল৷ আমাদের কাছে তিনি সাধারণ মানুষ নন৷ তাঁকে আমরা শিব বলে চিনেছি,জেনেছি,মানুষের সমাজে তাঁর অবদানের কথা বলে শেষ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাঁর অনেক  অবদানের মধ্যে অন্যতম হল ‘তাণ্ডবনৃত্য’৷ এটি নারীদের জন্য নিষিদ্ধ  শিবের সময় এই নৃত্যের প্রচলন ছিল সর্বাধিক, কিন্তু কালের গতিতে এই নৃত্যের কথা মানুষ ক্রমশঃ বিস্মৃত হতে থাকল ও তা শিবের নটরাজমূর্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হল৷

মহাকৌল সদ্‌গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি তাণ্ডব নৃত্যের বহুবিধ উপকারিতা লক্ষ্য করে তিনি তাঁর শিষ্যদের মধ্যে এই নৃত্যের পুনপ্রচলন করলেন,মার্গী দাদা ও ভাইরা এটি অভ্যাস করে সুফল পেলেন৷ মার্গী দিদি ও বোনেরাও চুপ করে  বসে থাকলেন না৷  তাঁরাও বাবার কাছে বায়না (আবদার) রাখলেন মহিলাদের উপযোগী কোনকিছু দেওয়ার জন্য৷ আনন্দূর্ত্তিজী (শিষ্যরা তাঁকে ‘বাবা’ বলেই ডাকেন) সেটা অনুভব করেছেন৷ তিনি তাঁর প্রবচনে উল্লেখ করলেন---‘‘তাণ্ডব অভ্যাস নারীদের পক্ষে ঠিক নয়, কারণ তাদের মধ্যে কিছু শারীর-বৈজ্ঞানিক অসুবিধা রয়েছে কিন্তু তাদের জন্যেও তো কিছু চাই৷ তাই আমি পটনাতে থাকাকালীন এক ধরনের নোতুন নৃত্যের (কৌশিকী নৃত্য) উদ্ভাবন করেছিলুম৷ এই কৌশিকী নৃত্য উপকারের দিক থেকে তাণ্ডবের প্রায় সমান৷ তাণ্ডবের মত অত ফলপ্রদ না হলেও তাতে বেশ কিছুটা সুফল তো অবশ্যই পাওয়া যাবে৷ কৌশিকী নৃত্য নারী পুরুষ উভয়ের জন্যেই উপকারী’’---আনন্দবচনামৃতম্‌ (২২খণ্ড)

১৯৭৮ সালের ৬ই সেপ্ঢেম্বর পটনায় বাবা ‘কৌশিকী নৃত্য’ প্রবর্তন করেন৷ মহিলাদের জন্য এটি একটি উত্তম শারীরিক ব্যায়াম ও  মহৌষধও বটে৷ আচার্য কেশবানন্দ অবধূত বাবার কথা প্রসঙ্গে ‘তোমার কথা মনে পড়ে’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন--- ‘এটা একটা মানসাধ্যাত্মিক নৃত্য যা মানসস্তরে শুরু হয় ও আত্মিক স্তরে শেষ হয়৷  কৌশিকী শব্দটা সংস্কৃত ‘কোষ’ শব্দ থেকে এসেছে যার মানে মনের কোষ Cell of the mind)৷ সেই জন্যে কৌশিকী নৃত্যের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ শক্তির যথার্থ অভিব্যক্তি হয়--- মনের বিকাশ ঘটে৷’’

শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীও তাঁর আনন্দবচনামৃতম (ষষ্ঠখণ্ড) পুস্তকে উল্লেখ করেছেন--- ‘‘এইটি নৃত্য ব্যায়াম ও বাইশটি রোগের ঔষধ দুই-ই৷ এটা সমস্ত স্ত্রীরোগের নিরাময় করতে পারে৷ আবার অল্পবয়স্ক যুবকদেরও অনেক রোগ সারাতে পারে,যকৃতের সমস্ত প্রকার রোগের এটা মহৌষধ৷ এতে স্ত্রীলোকের প্রসব নিরাপদ হয় ও বৃদ্ধাবস্থা বিলম্বে আসে৷’’

আশির দশকের শুরুতে আমি তখন মদনমোহনচকে চৌধুরী বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করি৷ সবেমাত্র কৌশিকী ও তাণ্ডব নৃত্য অভ্যাস  করতে শুরু করেছি৷ কৌশিকী ও তাণ্ডব নৃত্যের উপকারিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা তখনও হয়নি৷ সাধনার পরে আসন, কৌশিকী ও তাণ্ডব  করতে হয়, তাই করি, একদিন রাত্রিতে স্বপ্ণ দেখলাম--- বাবা নিজে এসে আমাকে কৌশিকী শেখাচ্ছেন ভুলগুলো সংশোধন করে দিচ্ছেন, আমিও নূতন উদ্যমে কৌশিকী ও তাণ্ডব নৃত্য অভ্যাস শুরু করলাম, বাবাকে স্বপ্ণে দেখার কিছুদিন পরেই হুগলি জেলার তারকেশ্বরে এই প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়েছে৷ তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত চারদিনের ক্যাম্পে আমিও যোগ দিলাম৷ দাদাদের সংখ্যাটাই বেশী৷ মার্গীদের সংখ্যা হাতে গোণা,নিয়মিত ক্লাশ করলাম ও সমস্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম৷ সমাপ্তি দিবস সকালে অনুষ্ঠিত হল ক্যাম্পে যোগদানকারী সমস্ত সন্ন্যাসী দাদা ও মার্গীদের নিয়ে কৌশিকী ও তাণ্ডব প্রতিযোগিতা, দাদাদের সঙ্গে একসাথে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে সঙ্কোচবোধ করলাম, তাছাড়া সন্ন্যাসী দাদাদের সঙ্গে  প্রতিযোগিতায় পেরে উঠব না বলেই মনে মনে একটা ধারণা ছিল, শেষ পর্যন্ত দাদাদের অনুপ্রেরণায় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম৷ প্রতিযোগিতার শেষে দেখা গেল আমি কৌশিকীতে প্রথম হয়েছি, শুধু তাই নয় তাণ্ডব প্রতিযোগিতাতেও প্রথম,সেই মুহূর্তে মনে পড়ল স্বপ্ণে বাবার কৌশিকী প্রশিক্ষণের বিষয়টি অনুভব করলাম বাবার কৃপাতেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি৷ তাঁর কৃপা হলে পঙ্গুও পর্বত লঙ্ঘন করতে পারে---

‘মূক্যং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্‌

যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্‌৷’

আর একদিনের ঘটনা মনে পড়ে৷ মেদিনীপুর দীঘা বাস রাস্তার মধ্যবর্ত্তী ‘বেলদা’ নামক স্থানে একবছর প্রথম স্তরীয় ডায়োসিস সেমিনারের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে,বছরে দুবার আনন্দনগরে ধর্মমহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ ঐ সম্মেলনের পরে পরেই সেমিনারের  ক্রম চলতে থাকে, উপরোক্ত সেমিনারটিকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আচার্য পরিতোষানন্দ অবধূত দু’সপ্তাহ আগে থেকে ঐ এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন, সেমিনারে মার্গী সমাগম ভাল হয়েছিল ও মধ্যবতী দিনের প্রকাশ্য সমাবেশটি বহু শ্রোতার উপস্থিতিতে জমজমাট হয়েছিল৷ সেমিনারের প্রথা অনুযায়ী আসন, কৌশিকী ও তাণ্ডবের ক্লাশও ভালভাবে হয়েছে৷ শেষের দিন সকাল অনুষ্ঠিত হল কৌশিকী ও তাণ্ডব প্রতিযোগিতা৷ আমি কৌশিকী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম৷ আমার পুত্র পার্থসারথি কৌশিকী ও তাণ্ডব দুটোতেই অংশগ্রহণ করল৷ কৌশিকী প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা হল৷ দেখা গেল বহু প্রতিযোগীর মধ্যে আমি প্রথম হয়েছি ও আমার পুত্র পার্থসারথি হয়েছে তৃতীয়, সবার মধ্যে সে কী হাততালি৷ কারও কারও মন্তব্য-এরা পিতা-পুত্র মিলে সব প্রাইজই নিয়ে নেবে মনে হচ্ছে৷ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল স্বপ্ণে দেখা বাবার সেই প্রশিক্ষণের কথা৷ এও অনুভব করলাম--- বাবা কৃপা করে কৌশিকী শিক্ষা দিলেন৷ কৌশিকীর কী উপকারিতা তখন না বুঝতে পারলেও এই পরিণত বয়সে এসে উপলদ্ধি করেছি এই নৃত্যের মহিমা৷ নিজে তো উপকৃত  হচ্ছি ও সবাই যাতে ব্যষ্টিগত জীবনে কৌশিকী অভ্যাস করে সে ব্যাপারে সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷ কৌশিকী নৃত্য বাইশটি রোগের ঔষধ৷ তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি উপকারিতা নিম্নরূপ ঃ---

(১) মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত গ্রন্থি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যায়াম হয়৷ (২) আয়ু বাড়ায়

(৩) প্রসব সুগম করে৷ (৪) মেরুদণ্ড, কোমর ঘাড় ও অন্যান্য সংযোগস্থলের ব্যথা দূর করে৷ (৫) মাসিকের অনিয়মতা দূর করে৷(৬) মূত্রনালী ও মূত্রাশয়ের কষ্ট দূর হয়৷ (৭) মুখে ও ত্বকে ঔজ্জ্বল্য আসে৷ (৮) অলসতা দূর করে৷ (৯) অনিদ্রা দূর করে৷ (১০) মৃগী রোগ সারায়৷ (১১) মেরুদণ্ডের যন্ত্রণা,অর্শ,হার্নিয়া, হাইড্রোসিল,ঠিক করে দেয়, স্নায়ুর ব্যথা দূর করে ও স্নায়ুর অক্ষমতা সারিয়ে দেয়৷ (১২) মূত্রগ্রন্থি ও পিত্তকোষের সমস্যা, বায়ুদোষ, অজীর্ণ ও অম্লরোগ, আমাশয়, উপদংশ, প্রমেহ,স্থূলতা, কৃশতা ও যকৃতের দোষ

(১৩) ৭৫-৮০ বৎসর বয়স পর্যন্ত শরীরের কর্মদক্ষতা বজায় থাকে৷ (১৪) নৈরাগ্য দূর করে৷

(১৫) ভীতম্মন্যতা দূর করে দেহ-মনে সাহস যোগায়৷

কৌশিকী নৃত্যটি ১৬মাত্রা বিশিষ্ট৷ ডানদিকে ঝুঁকে ৫, বামদিকে-৫, সামনে-৩ ও পিছনের দিকে ঝুঁকে-৩ মাত্রা এই নিয়ে ১৬মাত্রা৷ সাধকরা কীর্ত্তন সহযোগে এই কীর্ত্তন করতে পারবেন৷ মহান দার্শনিক,ঋষি, সদ্‌গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী মার্গী-অমার্গী,ধনী-দরিদ্র, পণ্ডিত-মূর্খ, সাদা-কালো, জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কল্যাণার্থে এই কৌশিকী নৃত্যের উদ্ভাবন করেছেন৷ যাঁরাই এই নৃত্যের অভ্যাস করবেন, তাঁরাই এর ফল লাভ করবেন৷