মানুষের অস্তিত্ব স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন জগতেই৷ মানুষ কেবলমাত্র পাঞ্চভৌতিক জীব নয়, কেবল মানসিক জীবও নয়, আবার শুধুমাত্র আত্মিক সত্তাও নয়৷ তিনে মিলে মানুষের অস্তিত্ব৷ মানুষের অভিব্যক্তিগুলো, অভিস্ফূর্ত্তিগুলো তিনটি তত্ত্বেই, তিনটি স্তরেই হয়ে থাকে৷
মানুষ পরম পুরুষকে সেবা করবে তিনটি স্তুরেই---প্রপাঞ্চিক স্তরে, মানসিক স্তরে ও আধ্যাত্মিক স্তরে৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, প্রপাঞ্চিক স্তরে মানুষ কীভাবে সেবা করতে পারে? এই জীবজগৎ পরম পুরুষের সৃষ্টি৷ এখন, জীবের বিভিন্ন প্রকারের দুঃখ নিবারণ করে বিভিন্নভাবে জীবকে পরিত্রাণের উপায় দেখিয়ে দিয়ে ও তাদের দায়িত্ব নিয়ে , নেতৃত্ব দিয়ে যে এগিয়ে দেবে, ‘‘তুই এগো, আমি পেছনে রয়েছি’’ এই বলে নয়, ‘‘আমি এগিয়ে চলেছি, তুই আমার পেছনে পেছনে আয়৷’’ এই বলে সে জীবজগতের কল্যাণের দায়িত্ব নেবে৷
এই জগৎ পরম পুরুষের প্রিয় সৃষ্টি৷ জাগতিক জীবের---মানুষের, জীবজন্তুর, উদ্ভিদের সেবা করে আমরা পরমপুরুষকে আনন্দ দিতে পারি৷ আর এই জীব সেবাই হবে নব্য মানবতাবাদের সর্বোৎকৃষ্ট প্রয়োগ৷ জীবসেবা মুখ্যতঃ চার ভাবে করা যেতে পারে---বিপ্রোচিত, ক্ষাত্রোচিত, বৈশ্যোচিত ও শূদ্রোচিত সেবা৷ এই সেবাগুলোর কোনটাই তুচ্ছ নয়, কাউকে আমরা তাচ্ছিল্য করতে পারি না৷ মানুষ আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী অপরের সেবা করবে৷ যার বিপ্রোচিত সেবা পছন্দ, সে বিপ্রোচিত সেবা করবে৷ যার শূদ্রোচিত সেবা ভালো লাগে সে শূদ্রোচিত সেবা করবে৷ কিন্তু সবচেয়ে ভাল হয় যদি মানুষ সবরকম সেবাই করতে পারে৷
যারা ভাল মানুষ, তথাকথিত ভাল মানুষ, তারা যদি সকল স্তরের জীবকে কল্যাণের পথে নেতৃত্ব দিতে না পারে তা’হলে তাদের ভাল মানুষ বলতে পারি না, তাদের গোবেচারা বলতে পারি, ভাল লোক বলতে পারি না৷ ভাল লোক সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলবে, বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে মূক জনসাধারণকে চলার পথে রসদ যোগাবে আর অপরকেও এগিয়ে চলতে উদাত্ত আহ্বান জানাবে৷
তেমনি আমাদের অস্তিত্ব মানসিক স্তরে রয়েছে৷ আর মানুষের জীবনে মনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস৷ মানসিক স্তরে পরমপুরুষকে আনন্দ দেওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হ’ল আত্যন্তিকী নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে কীর্ত্তন করা৷ কারণ, পরমপুরুষ যখন দেখবেন যে, একটা মানুষের মন অথবা অনেকগুলি মানুষের মন তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে, পরমপুরুষ তাতে নিশ্চয়ই একটা আনন্দময় স্পর্শ অনুভব করবেন৷ আর এই যে এগিয়ে চলা, এতে ব্যষ্টি জীবনেরও লাভ আছে, সমষ্টি জীবনেরও লাভ আছে৷ সেটা হচ্ছে এই যে মন একের দিকে এগিয়ে চলাই বহুসংঘর্ষজাত যে জটিলতা আজকের সমাজকে পেয়ে বসেছে তার কিছুটা কমবে৷ আজকের মানুষের এই জটিলতাময় জগতে প্রচুর পরিমাণে মানসিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছে৷ মানুষ পাগল হচ্ছে, আত্মহত্যা করছে৷ তারও কারণ এই যে মানুষ বহুদৈশিক জটিলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছে না৷ মানুষের মস্তিষ্কের সামর্থ্য আর কতটুকু! মানুষের স্নায়বিক শক্তিই বা কতটুকু! তাই ক্রমবর্ধমান জটিলতার চাপ সে সহ্য করতে পারছে না৷ কিন্তু এই যে কীর্ত্তন, এ যেমন মানসিক জগতে পরমপুরুষকে আনন্দ দিচ্ছে তেমনি মানুষকেও এককভাবে ও সমষ্টিগতভাবে আনন্দ দিচ্ছে ও কল্যাণের পথ দেখাচ্ছে বহুদৈশিক জটিলতা থেকে মানুষকে মুক্ত করছে, মানুষের বুদ্ধিও রোগমুক্ত হচ্ছে৷ মানুষ সহজভাবে ও যথাযথভাবে চিন্তা করবার সুযোগও পাবে৷
তাই বুদ্ধিমান মানুষ যত বেশী পারে কীর্ত্তন করবে৷ কোন একটা মানসিক জটিলতা থেকে চিন্তার জট পাকিয়ে গেছে, মানুষ কী করবে ভেবে পারছে না এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তখন কোন ব্যষ্টি বা সমষ্টি যদি বসে খানিকক্ষণ প্রাণ ভরে কীর্ত্তন করে তাতে মানসিক জটিলতা দূর হয়ে যাবে, সমাধানের সূত্র সামনে সে পেয়ে যাবে৷ তাই যদি হাতে পাঁচ মিনিটও সময় থাকে তো পাঁচ মিনিটের জন্যেও কীর্ত্তন করবে আর যদি একলা থাকে তো একলাই কীর্ত্তন করবে৷ যদি এক হাজার সাধক থাকে তো এক হাজার সাধক মিলেই কীর্ত্তন করবে৷
তোমরা জান, পরমপুরুষের একটি নাম আশুতোষ৷ ‘আশু’ মানে শীঘ্র আর আশুতোষ মানে যাঁকে খুব সহজে অল্পেতেই সন্তুষ্ট করা যায়৷ ভাল হোক, মন্দ হোক, মানুষ যদি মন-প্রাণ দিয়ে অল্পক্ষণের জন্যেও কীর্ত্তন করে তাতেও পরমপুরুষ সন্তুষ্ট হয়ে যান৷ তা হলে দেখছি পরমপুরুষকে সন্তুষ্ট করা খুব কঠিন কাজ নয়৷ বহু সাধক যখন মিলিতভাবে কীর্ত্তন করেন আর সকলের মিলিত মন পরমাত্মার দিকে, পরমপুরুষের দিকে চলতে থাকে তখন পরমপিতার মনেও অপারআনন্দ হয় এই ভেবে যে অতগুলো মন তাঁর দিকে ছুটছে---অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিভরে কীর্ত্তন করছে৷ এই আনন্দে তিনিও অভিভূত হয়ে যান৷
এখন, পরমপুরুষ তো সবাইকে ভালবাসেন৷ আর যাঁরা কীর্ত্তন করছেন তাঁদের তো আরও বেশী ভালবাসেন৷ তাঁদের আদর করে ডেকে বলেন---এসো, আমার কাছে এসো, আরও কাছে এসো৷ মানসিক ক্ষেত্রে পরমপুরুষের সেবা করার এইটাই হ’ল উত্তম পন্থা, ঠিক উপায়৷
যাঁরা খাঁটি ভক্ত তাঁরা বিদ্বান হতেও পারেন, না-ও হতে পারেন উচ্চশিক্ষিত হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন৷ কিন্তু তাঁরা যদি কীর্ত্তন করেন তাহলে তাঁরা মানসিক ক্ষেত্রে পরমপুরুষের সেবা অবশ্যই করতে পারবেন৷ তাই আন্দমার্গের ছেলেমেয়েরা, তোমরা অবহেলায় এই দামী সুযোগ নষ্ট করো না৷ তোমরা উন্নত মানব শরীর পেয়েছ, দেহ ও মন দিয়ে পরমপুরুষের সেবা করে এই মানব অস্তিত্বটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাও৷
আর আত্মিক জগতে পরমপুরুষের সেবা করার একটাই উপায়--- তা হ’ল কঠোর সাধনা করা৷ কঠোর সাধনার দ্বারা পরমপুরুষের নিকট থেকে নিকটতর সম্পর্কে চলে এস৷ আর তুমি যখন এভাবে চলতে চলতে তাঁর একেবারে কাছটিতে এসে পৌঁছবে, দেখবে আগে থেকেই তাঁর কোলে একটা স্থান কেবল তোমারই জন্যেই খালি পড়ে রয়েছে৷ পরমপুরুষের কোটি কোটি সন্তান, সবাই তো তাঁর দিকেই আসছে৷ তবুও দেখবে, পরমপুরুষের কাছটিতে তোমার জন্যে একটি স্থান আগে থেকে সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে৷