পুরাণের যুগে তো রীতিমত অনেক গল্প তৈরী করা হয়েছিল দেবী-দেবতাদের নিয়ে৷ তাতে গণেশের স্ত্রী হচ্ছেন তুলসী ৷ কিন্তু কোন কোন পুরাণের মতে গণেশের স্ত্রী হলেন ষষ্ঠী দেবী৷ পৌরাণিক সমাজে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার একমাসের মধ্যে ষষ্ঠীর একটা পূজো হয়৷ আবার কোনও কোনও পুরাণের মতে কার্ত্তিকের স্ত্রী হলেন ষষ্ঠী৷ আবার ভারতের কোন কোন অংশে প্রচলিত স্থানীয় পুরাণের মতে গণেশের স্ত্রীর নাম সন্তোষী দেবী৷ পুরাণকারদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ অত্যন্ত প্রবল ৷ যাইহোক, গণেশের পাশে যে কলা-বৌ থাকে সে কি গণেশের স্ত্রী নয়? সে কে তাহলে?
প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ রসায়ন বিদ্যা সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানত না---বুঝত না৷ রোগের ওষুধ তারা গাছগাছড়া থেকে পেত৷ মানুষ যে সমস্ত গাছের মধ্যে ঔষধীয় গুণ বেশি পেত সেগুলোকে তারা দেবতা বলে মনে করত৷ আসলে আয়ূর্বেদ শাস্ত্রে রয়েছে যে যত রকমের গাছগাছড়া আছে সবের মধ্যে কোন না কোন ঔষধীয় গুণ রয়েছে৷ তবে যেসব গাছগাছড়ার বেশী গুণ রয়েছে সেগুলোকে লোকে বেশী সম্মান করে, বিশেষ যত্ন করে গাছগুলোকে রোপণ করে ইত্যাদি৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ ওষুধ তৈরী করতে জানত না---গাছগাছড়াই ব্যবহার করত৷ সে সময়কার মানুষ বিশেষ করে ভারতবর্ষে এমন ন’ রকমের গাছের সংস্পর্শে এসেছিল যার মধ্যে নানা ধরণের গুণ ছিল---ঔষধীয় গুণ, খাদ্যগত গুণ ইত্যাদি৷ এই ন’ রকমের গাছেরও তারা সেকালে পূজো করেছিল৷--- ঠিক দেবী-দেবতা জ্ঞানে নয়, একটা উপকারী জিনিস এই হিসেবে৷ গাছের মধ্যে দেবত্ব বা দেবীত্ব ভাব আরোপিত হয়েছিল৷ পরবর্তীকালে এই ন’ রকমের গাছ ভারতের মানুষ যার মধ্যে ঔষধীয় ও খাদ্য দুই গুণই পেয়েছিল৷ তারা হচ্ছে ---১) কদলী, ২) কচু, ৩) হরিদ্রা, ৪) জয়ন্তী, ৫) অশোক, ৬) বিল্ব ৭) দাড়িম্ব, ৮) মান ও ৯) ধান্য৷
কদলী একটা খুব পুষ্টিকর খাদ্য৷ পালা জ্বর বলে এক রকমের যে জ্বর হয় একদিন অন্তর বা দু’দিন অম্তর---রোগটার নাম তোমরা শুণে থাকবে--- তার ঔষধ কদলী৷ যকৃত. অগ্ণ্যাশয়, কিডনি এই তিনের কাজ ভাল রাখে কদলী৷ ডিসেন্ট্রি রোগের খুব ভাল ঔষধ কদলী, আবার মৃত বৎসা নারীর পক্ষে খুব ভাল খাদ্য এই কদলী৷ যে নারীর সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়, এমন রোগের ঔষধ হ’ল কদলী৷ কোন শিশুর যদি মাতৃবিয়োগ হয়, আর মাতৃদুগ্দ না পাওয়া যায় সেই শিশু যদি অস্থিচর্মসার হয়ে যায়--- রোগারোগা হয়ে যায়, সেই রোগের খুব ভাল ঔষধ হচ্ছে মজা কলা, অর্থাৎ যে কলার খোলাটা কালচে হয়ে গেছে৷ সেটা চটকে খাওয়ালে মাতৃদুগ্দের চেয়েও তাঁর গুণ বেশী৷ কোন বাছুরের যদি মাতৃবিয়োগ হয়--- দুধ না পায়, তাকেও ওই মজা কলা আর তার দ্বিগুণ ওজনের ছাতু মিশিয়ে জলে গুলে খাওয়ালে সেও হৃষ্টপুষ্ট হয়ে যায়৷ কদলীর অজস্র গুণ৷ তাই কদলীকে সে যুগের মানুষ পূজা করতে শুরু করল৷
দ্বিতীয় হ’ল কচু৷ কচুর খাদ্যগুণ খুব কম কিন্তু কচু কিডনির পক্ষে খুব ভাল৷ তৃতীয় হ’ল হরিদ্রা৷ হরিদ্রা মানে হলুদ ৷ হলুদ একটা ভাল মশলা ৷ আবার সেটা দারুণ বিষক্রিয়ানাশকও antiseptic)বটে৷ এখানে হলুদ মানে শুঁট হলুদ নয়, কাঁচা হলুদ৷ তোমরা হয়তো জান, গাছ থেকে যে হলুদটা মাটি থেকে তোলা হ’ল তাকে বলব কাঁচা হলুদ৷ সেই হলুদকে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে নিয়ে তার নাম হয় যায় শুঁট হলুদ৷ বাজারে লোকে যে হলুদ কেনে, যে হলুদ বাটে, গুঁড়ো করে, তা হ’ল শুঁট হলুদ৷ শুঁট হলুদই রান্নায় ব্যবহার করা হয়, কাঁচা হলুদ হয় না৷ কাঁচা হলুদের বিষক্রিয়া আছে বেশী খেলে মানুষ মরে যায়, কিন্তু কাঁচা হলুদ হ’ল বিষক্রিয়ানাশক৷ কাঁচা হলুদে চর্মরোগ সারে৷ কাঁচা হলুদ এরকমই প্রখর জিনিস যে কুমীরও কাঁচা হলুদে মরে যায়৷ কুমীরের পেটে কাঁচা হলুদ গেলে সে মরে যায়৷ যেখানে অনেক মানুষ জড় হয় সেখানে রোগ ছড়াতে পারে, তাই প্রাচীন বাংলায় নিয়ম ছিল যে কোন সামাজিক উৎসবের আগে লোকে কাঁচা হলুদ বেটে গায়ে মেখে স্নান করে নেবে, আজকালও তা কিছু কিছু করে--- বলা হয় গাত্রহরিদ্রা বা গায়ে হলুদ৷ তাহলে তোমরা বুঝে গেলে তো কেন লোকে হলুদ মাখে৷
তারপরে হ’ল জয়ন্তী৷ জয়ন্তীর মূল ওষুধে লাগে৷ জয়ন্তী ধবল কুষ্ঠর ঔষধ৷ চামড়ায় যে সাতরকমের কুষ্ঠরোগ হয় তার মধ্যে চার রকমের ঔষধ হচ্ছে এই জয়ন্তী৷ তাই জয়ন্তীকেও ওই রকম ভাবে মানুষ পূজা করত৷
তারপরে হ’ল অশোক--- যাকে হিন্দীতে বলে সীতা-অশোক৷ হিন্দীতে শুধু অশোক বললে তার মানে হয়ে যায় দেবদারু৷ আর এই অশোক হ’ল সীতা-অশোক৷ এই অশোক হ’ল সমস্ত স্ত্রী-ব্যাধির খুব ভাল ঔষধ৷ এই অশোক থেকে যে মদ তৈরী হয় তাকে বলা হয় অশোকারিষ্ট--- অশোকাসব৷ এর ঔষধীয় গুণ খুব বেশী মাত্রায় রয়েছে৷
তারপরে বিল্ব---বেল৷ বেল সমস্ত উদর রোগের সবচেয়ে ভাল ঔষধ৷ কাঁচা বেল পুড়িয়ে খেতে হয়৷ পাকা বেল এত ভাল ঔষধ নয়৷ সংস্কৃতে ‘লি’ আর হিন্দীতে ‘লি’ মানে হ’ল ছোট ছোট ছ্যাঁদা৷ ফুটোকেও হিন্দীতে লি বলে ‘লি’ মানে যাতে ছ্যাঁদা ছ্যাঁদা রয়েছে৷ যা ছ্যাঁদার ভেতর দিয়ে ঢুকে শরীরে ভাল কাজ করে তা হ’ল ‘বিল্ব’৷ বেলের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হ’ল ‘বিল্ব’৷ এর অসামান্য গুণের জন্যে সংস্কৃত ভাষায় এর আরেকটা নাম ‘শ্রীফল’৷
তারপরে দাড়িম্ব৷ দাড়িম্ব মানে ডালিম৷ ডালিমের ছাল, শেকড় ও ফুল--- সমস্ত স্ত্রীরোগের খুব ভাল ঔষধ৷ ভারতের আয়ুর্বেদে আর চীনের আয়ুর্বেদে স্বীকৃত ডালিমের এই গুণ৷
তারপরে হ’ল মান৷ আমাদের যত রকমের ষ্টার্চ জাতীয় (শ্বেতসার) খাদ্য আছে যা শরীরে মাংস তৈরীতে সাহায্য করে তার মধ্যে মান হ’ল অতুলনীয়৷ মানের গুণ আলুর চেয়ে বেশী, এমনকি কাঁটাল বীজের চেয়েও বেশী৷ আলুর চেয়ে কাঁটাল বীজের গুণ প্রায় আড়াই গুণ বেশী৷ আলু এদেশে আসার আগে লোকে কাঁটাল বীজ ব্যবহার করত৷ আর কাঁটাল বীজের চেয়েও মানের গুণ বেশী৷ আবার মান স্নিগ্দকারকও অর্থাৎ গরমের সময় শরীর গরম হতে পারে, মানুষের নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে, সেই সময় মান ঔষধের কাজও করে৷ মান আহার আর ঔষধ দুই-ই৷
আর আছে ধান্য৷ ধান্য বা ধান মানে যা থেকে চাল তৈরী হয়৷ ধানের গুণ আর কি বলব! তবে এক্ষেত্রে ধানের ব্যবহার সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে ধান থেকে অতি সহজে মদ্য প্রস্তুত করা যেত আর সেই মদ্য থেকে নানা ধরণের ঔষধও তৈরা হত৷ ধানের এই বিশেষ গুণটার দিকে নজর রাখা হয়েছিল সেকালে৷
এই ন’ রকমের গাছের বিশেষ গুণ থাকায় মানুষ এই গাছগুলোকে শ্রদ্ধা করত৷ প্রাচীন কালের মানুষ সিঁদুর লাগিয়ে পূজাও করত এই গাছগুলোকে৷ তারপরে যখন শিবোত্তর তন্ত্রের যুগ এল তখন এই ন’ টা গাছকে ধরা হ’ল--- চণ্ডিকা শক্তিরই ন’ রকমের অভিব্যাক্তি৷ তাই না এদের মধ্যে থেকে এতরকমের ঔষধীয় গুণ পাই! এই রকম ভাবতে শুরু করেছিল সেকালের মানুষ৷
তারা কদলীতে যে চণ্ডিকা শক্তির অভিপ্রকাশ আছে বলে ভাবত---আসলে এগুলো তো কল্পনা, পৌরাণিকদের কল্পনা---তার নাম তারা দিয়েছিল ব্রাহ্মণী শক্তি৷ কচুতে যে শক্তিটা, যে ঐশ্বরীয় গুণটা, তার নাম দিয়েছিল কালিকা শক্তি৷ হরিদ্রাতে যে গুণটা পেয়েছিল তার নাম দিয়েছিল দুর্গাশক্তি৷ জয়ন্তীতে যে গুণটা পেয়েছিল তার নাম দিয়েছিল কার্ত্তিকী শক্তি অশোকে যে গুণ, তার নাম দিয়েছিল শোকরহিতা শক্তি৷ বিল্বে যে গুণ, তার নাম দিয়েছিল শিবা৷ দাড়িম্বে যে শক্তি---চণ্ডিকা শক্তি, তার নাম দিয়েছিল রক্তদন্তিকা৷ মানেতে যে শক্তি তার নাম দিয়েছিল চামুন্ডা৷ আর ধান্যে যে শক্তি, তার নাম দিয়েছিল লক্ষ্মী৷ এখনও গ্রাম্য অশিক্ষিত লোকেরাও, হয়তো বা শিক্ষিতরাও পায়ে ধান লেগে গেলে বলে ‘‘মা লক্ষ্মী’’ আর হাতটা কপালে ঠেকায়৷
এই যে ন’ রকমের গাছপত্রিকা, গাছপালা--- এর মধ্যে যে ন’ রকমের চণ্ডিকাশক্তির যে অভিব্যাক্তি বলে তারা ভেবেছিল, তাদের ধারণা হয়েছিল--- এই রকমের শক্তির মিলিত নাম হলো নবদুর্গা, আর এই ন’রকম গাছের মিলিত নাম হ’ল নবপত্রিকা৷ যখন পৌরাণিক মতে দুর্গার কথা বলা হ’ল --- আজ থেকে ১৩০০ বছর আগে , তখন তার সঙ্গে এই নবপত্রিকার পূজাই প্রবর্ত্তন করেছিল৷ মূর্ত্তির কথাটা পরে এসেছিল অষ্টভূজা বা দশভূজা৷ এই হ’ল নবদুর্গা ও নবপত্রিকা৷ এই নবপত্রিকার মধ্যে এই যে কলাগাছ একটি আছে, এই কলা গাছটিকে গণেশের পাশে শাড়ি পরিয়ে রেখে দেওয়া হয়৷ যেন দেখেই মনে একজন মেয়েছেলে৷ গণেশের পাশে আছে মাথায় ঘোমটা রয়েছে--- লোকে ভাবতে শুরু করলে ও বুঝি গণেশের স্ত্রী , দুর্গার পুত্রবধূ--- কলা বৌ৷ না, তা নয়৷ কদলীতে যে শক্তি তার নাম ব্রাহ্মণীশক্তি--- একটু আগেই বললুম৷
কলা-বউ কেউ নয়৷ আর কলা--বউয়ের সঙ্গে গণেশের যে সম্পর্ক নেই তার একটা প্রমাণ দিচ্ছি৷ প্রাচীন আর্য ও আর্যেতর তথা তান্ত্রিক সমাজে নিয়ম ছিল যে পুরুষের বাঁ দিকে থাকে স্ত্রী৷ তাই সংস্কৃতে স্ত্রীর একটা নাম হ’ল ‘বামা’৷ বামা মানে যিনি বাঁ দিকে থাকেন, অর্থাৎ বামা মানে নারী৷ রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখছেন---
‘‘অন্নপূর্র্ণ উত্তরিলা গাঙনীর তীরে,
‘পার কর’ বলিয়া ডাকিলা পাটনীরে,
সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী,
ত্বরায় আনিলা নৌকা বামাস্বর শুণি’’৷৷
‘বামা’ মানে নারী৷ এই যে কলা-বউ --- এতো আছে গণেশের ডানদিকে৷ গণেশের স্ত্রী হলে ডান দিকে থাকত নাকি? বাঁ দিকে থাকত৷ বাঁ দিকে রাখবে কোথায় ? বাঁ দিকে তো অন্যান্য, দেবী-দেবতারা রয়েছেন৷ তা হলে বুঝলে, এই কলা-বউ দুর্গার পুত্রবধূও নন, গণেশেরও কেউ নন৷ অনেকে ভাবে, এই কলা বউ গণেশের স্ত্রী৷
তোমরা এবার বুঝে গেলে এই নবপত্রিকা ও এই নবদুর্গা ব্যাপারটা৷ কলা-বউ গণেশের স্ত্রী নয়৷ গণেশের স্ত্রীর নাম তুলসী৷ কোন কোন পুরান মতে গণেশের স্ত্রীর নাম ষষ্ঠী৷ কোন পুরাণের মতে কার্ত্তিকের স্ত্রী হলে ষষ্ঠী৷
(নমঃ শিবায় শান্তায়)