কোভিড পরবর্তী  অর্থনীতি ঃ দর্শন ও দিশা

লেখক
সুকুমার সরকার

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ‘নোতুন পৃথিবী ’পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, ‘‘ভারত সহ সমগ্র বিশ্ব কি মহানন্দার দিকে ধাবিত  হচ্ছে?’’ কেন জানি না, প্রাকৃতিক  দুর্দৈবিপাকে সমগ্র  বিশ্ব সত্যি সত্যিই আজ এক মহামন্দার  কবলে পড়েছে৷ এই মহামন্দা শুধু অর্থনীতিতে নয়, সমগ্র সমাজ -সামাজিকতাটাকেই ভেঙে দিয়েছে৷ আর এই মহামন্দা এসেছে এমন একটি মাধ্যমকে বাহন করে, মানুষের  আজকের  বিজ্ঞান যার সামনে  দাঁড়াবার সাহস দেখাতে পারছে না৷  লুকিয়ে বাঁচাটাকেই উপায়  হিসেবে বেছে নিয়েছিল৷ কিন্তু সেটাই বা কতদিন?

একমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান মরণ পণ লড়াই করে চলেছে৷ কিন্তু  সেই লড়াইয়ের সৈনিক ডাক্তার, নার্স বা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে প্রত্যাঘাত খেয়ে ধরাশায়ী হতে শুরু করেছেন, শেষ পর্যন্ত না তাঁদেরকেও পালিয়ে এসে সকলে এক সঙ্গে  মরতে হয়?

যদিও সমগ্র বিশ্বের  মানবকুল এখনি ধবংস হবে না৷ প্রকৃতির ওপর মানুষ যতই অত্যাচার করুক! মায়ের মতো  প্রকৃতিই মানুষকে বাঁচাবে৷ অবশ্য তাঁর জন্য  মানুষকে প্রকৃতির স্বামী পরমপুরুষের  স্মরণাপন্ন হতে হবে৷ যাইহোক, আমার আজকের আলোচনা সে সব বিষয় নিয়ে নয়৷ আমার আজকের আলোচনা, অর্থনীতিতে মহামন্দার কালো ছায়া ও  তার  থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে৷

গ্রেট ডিপ্রেসন তো সমগ্র বিশ্বে একসঙ্গে  এসে গেছে৷ পালিয়ে  বাঁচতে  গিয়ে মানুষ ঘরের মধ্যে  সিঁধে গেছে৷  কল-কারখানা, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, দোকান-পাট , ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ৷ একটি দুটি শহরে বা দেশে নয় সমগ্র বিশ্বে৷ এমতাবস্থায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি যে তলানিতে নামবে সেটা জানার জন্য অর্থনীতির ছাত্র হবার দরকার নেই৷ সবার হাঁড়ি-হেঁসেলের খোঁজ নিলেই বোঝা যায়৷ সবার হাঁড়ি-হেঁসেলেই টান পড়েছে৷ যার যেমন অবস্থা, আর এর থেকে বাঁচতে অর্থনীতিবিদরা যে চিন্তা করেছেন না,  তা নয়! চিন্তা করছেন, চিন্তা করে টাকা ছাপিয়ে গরীব মানুষদের  হাতে টাকা দেবার পরামর্শও দিয়েছেন৷ কেউ কেউ মদের দোকান খুলে এক লহমায় কোটি কোটি রাজস্ব আদায় করে অর্থনীতির  ভেঙে পড়া চালাঘর ঠেকনা দেবার নিদান দিয়েছেন৷ কোনো কোনো দেশ লকডাউন উঠিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কল-কারখানা খুলে দেবার কথা ভাবছেন, তাতে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয় হোক৷ মৃত্যু তো উভয় পথেই৷ ঘর থেকে বেরোলে করোনা হাতে মৃত্যু৷ রোজগারহীন ঘরে বন্দি থাকলে ক্ষুধার হাতে মৃত্যু! সাধারণ মানুষ আপদকালীন পরিস্থিতিতেও দুই চার ছয় মাস  ঘরে বসে থেকে কেন খেতে পারছেন না৷ এক দুই মাসেই মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে খাদ্যের মিছিলে জীবন বিসর্জন করতে হচ্ছে! কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতির এমন হাল হলো কেন?

কেন বিশ্বের মজুদ অর্থনীতির  ভাণ্ডার  বিশ্বের  মানুষকে  দু’মাস বা ছয় মাস বা এক বছর বসে খাওয়াতে পারবে না? তাহলে কি  ধরে নেবো, বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, যা দিয়ে আপদকালীন সময়ে অর্থের দিশা দেখাতে পারতো?  ধরে নেব কেন সত্যি সত্যি প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থায় এমন কোনো দিশা নেই৷ প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থার পুরোটাই গলদ৷ ঘোলা জলের মাছ যেমন বুঝতে পারে না, সে ঘোলা জলে আছে৷ যখন জলের দূষণ মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর কারণ হয়, তখনই কিছুটা বুঝতে পারে৷ কিন্তু সমগ্র পুকুরটাই যখন ঘোলা জলের, তখন আর করার কী থাকে? জল থেকে তো আর বেরিয়ে আসতে পারে না! বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি ঘোলা জলের মন্দ অর্থনীতি৷ অগত্যা মন্দ অর্থনীতির ঘোলা জলেই  বাস করতে হচ্ছে সকলকে৷ আপদকালীন কোনো দিশাই  অর্থনীতিবিদরা দেখাতে পারছেন না৷ উল্টে ভুল পথে জলের অর্থনীতিবিদরা  নিদান দিচ্ছেন অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে জোগান বাড়াবার! মদের দোকান খুলে রাজস্ব বৃদ্ধির৷ ঘরের ঝি বউরা যতই ঝাঁটা নিয়ে প্রতিবাদ করুক না কেন, সরকার মদের দোকান বন্ধ করবে না৷ উল্টে নোট ছাপিয়ে ঘরে ঘরে নোট বিলি করবে যাতে মদ, চাল, চিনি একসঙ্গে ঘেঁটে খেয়ে মারামারি কাটাকাটি করে দিন গুজরান করে৷ সরকারি  ব্যর্থতার  দিকে যেন কেউ আঙুল তোলার মতো অবস্থায় না থাকতে পারে৷ ঘোলা জলের অর্থনীতিবিদদের  মস্তিষ্ক থেকে এর চেয়ে ভালো আর কী অর্থনীতির দিশা আসবে ? ভাবনাটা এখান থেকেই শুরু৷ ঘোলা জলের অর্থনীতিবিদদের কাছে নোতুন অর্থনৈতিক দর্শন দিশার খোঁজ না থাকতে পারে৷ কিন্তু আমাদের কাছে  আছে৷

ঘোলা জলের অর্থনীতিবিদদের চোখে পুঁজিবাদের ঠুলি পরা আছে৷ সেই ঠুলি পরা চোখে তাঁরা ডাইনে বাঁয়ে দেখতে পান না৷ তাই তাঁরা দেখতে পাননি, প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থার বাইরে নোতুন এক প্রগতিশীল অর্থনীতি এসে গেছে৷ যে অর্থনীতি স্বাভাবিক সময়ের  অর্থনীতি ছাড়াও যে কোনোরকম দুর্বিপাকের সময়ের  অর্থনীতিকেও  একইভাবে চাঙ্গা রাখতে পারে৷ আমাদের সেই অর্থনীতির খোঁজ করতে হবে৷ নইলে আর উন্নত মানুষের মেধা মগজের কী মূল্য থাকলো? ঘোলা জলের জীবেদের বাঁচাতে যেমন স্বচ্ছ জলের প্রবাহ আনতে হবে৷ তেমনি আজকের এই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস থেকে মানুষকে বাঁচাতে ও প্রগতিশীল অর্থনীতির কথা ভাবতেই হবে৷ আমরা জানি, ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি তথা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার এক যুগান্তকারী অর্থনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে গেছেন৷ সেই তত্ত্বের নাম ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’৷  সংক্ষেপে প্রাউট৷ তাঁর এই অর্থনৈতিক তত্ত্ব মূলত পাঁচটি সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ এই পাঁচটি সিদ্ধান্ত হলো--- এক. কোনো ব্যষ্টিই সমবায়িক সংস্থার সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সংগ্রহ করতে পারবে না৷  দুই . বিশ্বের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক ও  আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে ও যুক্তিসঙ্গত বন্টন করতে হবে৷ তিন. মানব সমাজের মধ্যে ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগতভাবে যে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ আছে তার সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে৷ চার এই জাগতিক, মানসিক আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও সম্পদ সমূহের মধ্যে যথাযথ সন্তুলন থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়৷ পাঁচ. দেশ, কাল ও পাত্রের পরিবর্তন অনুযায়ী সমগ্র উপযোগনীতির পরিবর্ত্তন হতে পারে, আর তা উপযোগ হবে প্রগতিশীল স্বভাবের৷ ‘‘আজকের এই সার্বিক মহামন্দার  দিনে কিংবা আগত যেকোনো মহামন্দার হাত থেকে বাঁচতে শ্রী সরকারের এই নোতুন অর্থনৈতিক তত্ত্বের বিকল্প কিছু নেই৷ কেননা, আজকের এই মহামন্দা সৃষ্টির পিছনে আসল যে কারণ, তা হলো ‘কোভিড-১৯, করোনা ভাইরাস নামক আধিভৌতিক স্তরের এক অতি সুক্ষ্ম অণুজীবৎ৷ এই অণুজীবৎ কিংবা অন্য আরও  যে কোনো সুক্ষ্ম অণুজীবতের আক্রমণ হলে তার থেকে বাঁচার মতো কোনো দর্শন দিশা প্রচলিত অর্থনীতির তত্ত্বগুলিতে নেই৷ বলা চলে অর্থনীতির আলোচনায় যে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলি আসতে পারে সে ধারণাই তাঁদের ছিল না৷ সে ক্ষেত্রে শ্রী সরকারের প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের তৃতীয় ও চতুর্থ সিদ্ধান্তে এই বিষয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে৷ করোনা বাইরাস বা অন্য যে কোনো বাইরাস যেহেতু আধিভৌতিক জগতের অণুজীবৎ, সেহেতু এদের বিষয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে আধিভৌতিক স্তরের বিষয় জানতে হবে৷ (ক্রমশঃ)