ব্যঞ্জনের বর্গীয় বর্ণমালার আদিতে ‘ক’ বর্গের প্রথম বর্ণ ‘ক’, অন্তে ‘প’ বর্গের শেষ অক্ষর ‘ম’৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, কেন আগে ‘ক’, আর শেষে ‘ম’? এই জগৎ সৃষ্টি–স্থিতি–লয়াত্মক্৷ সৃষ্টির ৰীজ ‘অ’৷ তাই স্বরবর্ণে যত অক্ষর আছে তাদের সৰার আগে ‘অ’৷ আগে সৃষ্টি, তবে তো অন্য কিছু৷ তারপরে পালনের ৰীজ ‘উ’ আর প্রণাশের ৰীজ ‘ম’৷ তাই সৃষ্ট জগৎ এই অ–উ–ম তিন ধ্বনিতে বিধৃত৷ এই তিন ধ্বনির মিলিত নাম ‘ওম্’ (ূউূমঞ্চওম্)৷
‘ক’ হ’ল কার্যব্রহ্মের ৰীজ অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের একটি অংশ কারণ রূপে রয়ে গেছেন, অন্য অংশটি কার্যরূপ পরিগ্রহ করেছে৷ একটি অংশ Causal, অপর অংশ
Effect বা objectivated. তাই এই ‘ক’ কে ৰৌদ্ধদর্শনে বলা হয়ে থাকে ‘সংবৃত্তিৰোধিচিত্ত’৷ তাই যেহেতু কার্যকলাপের বীজ ‘ক’, তাই ‘ক’–ই প্রথম ব্যঞ্জন আর ‘ম’ যেহেতু প্রণাশের ৰীজ তাই ‘ম’ শেষ বর্ণ৷
হ্যাঁ বলছিলুম ওঙ্কারের কথা৷ এই অ–উ–ম নিয়ে ‘ওম্’৷ এই ‘ওম্’ কিন্তু অভিব্যক্ত জগতের জন্যে৷ অভিব্যক্ত ও অনভিব্যক্ত এতদুভয়ের জন্যে যদি কোন ধ্বন্যাত্মক ৰীজ ব্যবহার করতেই হয় তাহলে ‘ওম্’ লিখলে চলৰে না – লিখতে হবে ‘ওঁম্’৷ এক্ষেত্রে ‘ও’ এর মাথায় যে ৰিন্দু চিহ্ণটি রয়েছে সেটি নির্গুণ ব্রহ্মের দ্যোতক৷ নির্গুণ ব্রহ্মকে মুখেও বলা যায় না৷ তাই অক্ষরে লিখতে গেলে যে সর্বাল্প স্থান লাগে সেটি বিন্দু দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করা হয় (বিন্দুর অবস্থান আছে কিন্তু পরিমাণ নেই৷ A point has got position, but no magnitude) আর ৰিন্দুর নীচে কতকটা চন্দ্রকলার মত যে দীর্ঘায়ত চিহ্ণ, সেটা নির্গুণ থেকে সগুণে রূপান্তরণের দ্যোতক৷ একে সংস্কৃত ভাষায় নাদ ৰলা হয় অর্থাৎ নির্গুণা সংস্থিতি নাদ বা ধ্বনির সাহায্যে সগুণ ব্রহ্মে রূপান্তরিত হচ্ছে৷ একথা মনে রেখো, এটা ঠিক চন্দ্রবিন্দু বলতে যা ৰোঝায় তা নয়৷ এটা কতকটা ৰাংলায় ঈশ্বর চিহ্ণের ( ) মত৷ প্রাচীন প্রথানুযায়ী আজও মৃত মানুষের নামের পূর্বে এই নাদ ৰিন্দু–চিহ্ণটি (চন্দ্রৰিন্দু ৰলা ঠিক হৰে না) ব্যবহার করা হয়৷ পড়বার সময় এই নাদৰিন্দুকে পড়ি ‘ঈশ্বর’ ৰলে৷ জীবিত অবস্থায় যে মানুষটির নাম শ্রীকুমুদ চন্দ্র মাইতি, মৃত্যুর পরে তার নামের পূর্বে আর ‘শ্রী’ ব্যবহার করা যাৰে না৷ নাদৰিন্দুর ঠিক পরেই লিখতে হবে কুমুদ চন্দ্র মাইতি, ( কুমুদ চন্দ্র মাইতি) আর পড়বার সময় পড়তে হবে ‘ঈশ্বর কুমুদ চন্দ্র মাইতি’৷
এই ওঙ্কারের অপর নাম প্রণব যার ভাবরূঢ়ার্থ হচ্ছে– যে সত্তা লক্ষ্যের দিকে প্রেষিত করে৷ তোমরা হয়তো জানো, প্রাচীন কালে সেই কুসংস্কারের যুগে এই ‘ওঙ্কার’ উচ্চারণ করার অধিকার সবাইকার ছিল না৷ অন্ত্যজ জাতি ও নারীরা ওঁম্ উচ্চারণ তো করতে পারতেনই না, তাঁদের শোণার অধিকারও খর্ব করে দেওয়া হয়েছিল৷ কেউ ওঙ্কার ধ্বনি কাণে শুণলে, শোণা যায়, – তার কাণে সীসে গলিয়ে ঢ়েলে দেওয়া হত যাতে চিরদিনের জন্যে তার শ্রুতিশক্তি শেষ হয়ে যায়৷ কী কুসংস্কারের যুগই না ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এই কুসংস্কার পরিব্যাপ্ত ছিল৷ কেবল যে নারীদের ওপরই এই নির্যাতন চলত তাই নয়, পুরুষদেরও এজন্যে কম ভোগান্তি হয় নি৷ হঠাৎ সামাজিক কুসংস্কারের একটা গল্প মনে পড়ে গেল৷ গল্পটা পাঠান যুগের সুৰুদ্ধি রায়কে নিয়ে৷ সুৰুদ্ধি রায় ছিলেন পাঠান যুগের ৰাঙলার প্রধান মন্ত্রী৷ তাঁর সামাজিক সম্মানও (আমি ইচ্ছে করেই সামাজিক ‘মর্যাদা’ শব্দটা ব্যবহার করলুম না৷ ‘মর্যাদা’ শব্দটার যথার্থ মানে হচ্ছে সীমারেখা বা গণ্ডী৷ ৰাংলায় ভুল করে সম্মান অর্থে ‘মর্যাদা’ শব্দের ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা না করাই বাঞ্ছনীয়) ছিল যথেষ্ট৷ কিন্তু কোন এক ঘটনায় তাঁর মুখে বদনার পানী লেগে যায়৷ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সভা ৰসল৷ তাঁরা ৰললেন – এক একটা গুরুতর পাপ........ গুরুতর অপরাধ৷ এজন্যে সুৰুদ্ধি রায়কে প্রায়শ্চিত্ত করতে হৰে৷ হ্যাঁ, ৰলতে ভুলে গেছলুম, সুৰুদ্ধি রায় ছিলেন সে কালের ব্রাহ্মণদের গোষ্ঠীপতি ....... ব্রাহ্মণদের প্রতিভূ৷
সেই সুৰুদ্ধি রায়ের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ সমাজ খড়গহস্ত হয়ে উঠল৷ সুৰুদ্ধি রায়ের মুখ ভয়ে ভাবনায় আমশি৷ (আম্রপেশী > আম্বত্রশী > আমোশি > আমশি৷) প্রায়শ্চিত্তের বিধান নেৰার জন্যে তাঁকে নবদ্বীপের পণ্ডিতদের শরণাপন্ন হতে হল৷ নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন তূষানল প্রায়শ্চিত্তের৷ তূষানল প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে ধানের তূষকে আগুনে গনগনে লাল করে দিয়ে অপরাধীর সামনে ঢ়েলে রেখে দেওয়া হত অপরাধীর দৈহিক উচ্চতার ৬৪ গুণ পরিমিত ভূমিতে৷ অপরাধীকে তার ওপর দিয়ে নগ্ণ পায়ে হঁেঁটে যেতে হৰে৷ তার পরেও যদি সে ৰেঁচে থাকে, তাহলে ৰুঝতে হৰে তার প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে৷ আর যদি মরেই যায় তো ফুরিয়ে গেল৷
এই তূষানল প্রায়শ্চিত্তের ভয়ে সুৰুদ্ধি রায় গেলেন কাশীতে৷ রাজা সুৰুদ্ধি রায় ভাবলেন কাশীর পণ্ডিতরা তো আরও ৰড়.......... আরও তাগড়া তাগড়া৷ তাঁরা অন্য কোন বিধান দিলেও দিতে পারেন৷ সেখানে গিয়ে তিনি পণ্ডিতদের কাছে সৰ কথা খুলে ৰললেন ঃ
‘‘প্রায়শ্চিত্ত পুছিল তেঁ পণ্ডিতের স্থানে
তারা কয় তপ্ত ঘৃত খাইয়া ছাড় প্রাণে৷’’
কাশীর পণ্ডিতেরা ৰললেন – নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা কিস্সু জানেনা৷ এজন্যে বিধান হচ্ছে তপ্ত ঘৃত৷ ঘি খুৰ গরম করে গলিয়ে তরল করে সেই ঘি পান করতে হৰে৷ আর ততক্ষণ ধরে পান করতে হৰে, যতক্ষণ না মৃত্যু হচ্ছে৷ একেই ৰলে ‘তপ্তঘৃত প্রায়শ্চিত্ত’৷ রাজা সুৰুদ্ধি রায় দেখলেন, রামে মারলেও অপঘাত মৃত্যু, রাবণে মারলেও অপঘাত মৃত্যু৷ তার চেয়ে ভাল বরং গঙ্গায় ডুৰে মরা৷
রাজা সুৰুদ্ধি রায় গঙ্গার ঘাটের দিকে চললেন৷ এদিকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব তখন নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবনের পথে কাশীতে অল্পকাল থেকে যাচ্ছেন বৃন্দাবনের দিকে৷ সুৰুদ্ধি রায়কে সেই অবস্থায় দেখে তিনি ভাবলেন – লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষিত, সম্মানিত অথচ মুখে বিষাদের ছায়া, কপালে চিন্তার ৰলিরেখা এই অসময়ে গঙ্গার দিকে যাচ্ছে – জিনিসটা সন্দেহজনক৷ চোখ–মুখ দেখে মনে হয় লোকটি ৰাঙলারই মানুষ৷ তিনি তাঁকে শুধোলেন –
কী হয়েছে? আপনি কে? কোথায় চলেছেন?
সুৰুদ্ধি রায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সৰ কথা জানালেন৷ মহাপ্রভু চৈতন্যদেব পণ্ডিতদের অমানুষিক কার্যকলাপ দেখে তো অবাক তিনি তাঁদের তীব্র ভাষায় ধিক্কার দিয়ে
ৰললেন ঃ
‘‘প্রভু কয় ইহা হৈতে যাও বৃন্দাবন
নিরন্তর কৃষ্ণনাম কর সংকীর্ত্তন৷
এক নামাবেশে তোমার পাপ দূরে যাৰে
আর নাম লইতে কৃষ্ণ শরণ পাইৰে’’৷
মহাপ্রভু ৰললেন, ‘‘ওসৰ ধাপ্পাৰাজীর ৰশে থেকোনা৷ চল বৃন্দাবন৷ কৃষ্ণের নাম নাও৷ ওই ৰদনার পানীর পাপ একবার ‘কৃষ্ণ’ ৰললেই দূর হয়ে যাৰে৷ আর দ্বিতীয়ৰার কৃষ্ণ ৰললে ৰুঝবে তুমি কৃষ্ণের শরণেই এসেছো৷ সুৰুদ্ধি প্রাণে ৰাঁচলেন৷ সামাজিক অত্যাচারের যূপকাষ্ঠ থেকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব তাঁর মাথাটা উদ্ধার করে দিলেন৷