কুম্ভীরাশ্রু নয়, সত্যিকারের প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন!

লেখক
সুকুমার সরকার

গত ৫ই আগষ্ট ২০২৪, বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করার আগে-পরে বাংলাদেশে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রধান আঁচ এসে পড়েছে সেদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর৷ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ দলের নেতা-মন্ত্রীদের ওপরও আঘাত এসেছে৷ কিন্তু তা রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয়৷ কিন্তু হিন্দুদের ওপর যে আঘাত এসেছে তা বিরুদ্ধ ধর্মমতীয় সেন্টিমেন্ট থেকে৷ এটা বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম সেন্টিমেন্টের ধর্মমতীয় সহজাত প্রবৃত্তি বললে ভুল হবে না৷

একাত্তরের ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং যুদ্ধের ডাক দেওয়ার পর পাকিস্থানী মিলিটারিদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে হিন্দুরা যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের আশেপাশের গ্রামের প্রায় সকল মুসলমানেরাই বলতে শুরু করেছিলেন, ’নৌকায় ভোট দিয়েছো, এখন নৌকার মতো ভাসতে থাকো’৷ ভাবখানা এমন যেন হিন্দুরাই কেবল নৌকামার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জিতিয়েছিলেন৷ আজও একইভাবে হাসিনা সরকারের ওপরের সকল আক্রশের জন্য আবার হিন্দুদেরকেই টার্গেট করা হয়েছে৷ এটাই বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলমানদের ধর্মমতীয় সেন্টিমেন্ট৷ তাঁরা মূলত পৌত্তলিকতা বিরোধী এবং ভারত বিরোধী৷ আজ বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর এই যে এত আক্রমন চলছে তা এই দুই বিরোধী সেন্টিমেন্টের কারণে৷ এক্ষেত্রে ভারত সরকার বাংলাদেশের ওপর যদি শুধু মৌখিক চাপ সৃষ্টি করে, তাতে লাভ খুব একটা হবে না৷ উল্টে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বাড়বে৷

অতীতে বাংলাদেশের যেকোনো জাতীয় সমস্যায় হিন্দুদের ওপর যখন আঘাত এসেছে, হিন্দুরা ভারতরাষ্ট্রে এসে আশ্রয় নিয়ে বেঁচেছেন৷ এটা ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে দেশভাগ করার দায় থেকে অতীতের ভারত সরকার করেছেন৷ কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকারের সে দায় নেই৷ বিজেপি যতই হিন্দুর দল বলুক, তাঁরা আসলে বাঙালী বিদ্বেষী পুঁজিবাদীদের দল৷ সে বাঙালী হিন্দুই হোন আর মুসলমান৷ এটার জ্বাজ্জল্যমান প্রমাণ আসামে বার লক্ষ হিন্দু বাঙালী এবং সাতলক্ষ মুসলিম বাঙালীকে এন. আর. সি.-র নাম করে নাগরিকত্বহীন করা৷ সি. এ. এ. -তে নাগরিকত্ব দেবার নাম করে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু বাঙালীদেরকে চিহ্ণিত করণের প্রক্রিয়া৷ যাতে করে তাঁদেরকে নাগরিকত্বহীন করা যায়৷ নইলে সহজ শর্তে নাগরিকত্ব দিতে পারতেন, যেভাবে ১৯৭১-এর আগে আসা হিন্দুদের দেওয়া হয়েছে৷

২০২৪ -এ বাংলাদেশের উদ্ভুত পরিস্থিতির পর বিজেপি সরকার তো এতটাই বাঙালী বিদ্বেষের পরিচয় দিলেন, হিন্দু বাঙালীরা সীমান্তে মাথাঠুকে মরলেন, অথচ সীমান্তের দরজা খুললেন না৷ পৃথিবীর কোনো প্রতিবেশি রাষ্ট্রে এমটা হয় না৷ এমনকি বাংলাদেশের এত জনসংখ্যার চাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছেন৷ বাংলাদেশী হিন্দুদের ক্ষেত্রে ভারত সরকার এতটা নির্দয় কী জন্য হলেন ? হিন্দু বাঙালীদের জন্য যদি সামান্য দরদ থাকতো তাহলে সীমান্তে এত কড়াকড়ি করতে পারতেন না৷ ভিসা বন্ধ করতেন না৷ এক হাসিনা এবং তাঁর কিছু নেতা-মুন্ত্রীদের ছাড়া কাউকেই ভারতে ঢুকতে দিচ্ছেন না৷ এমনকি ভারতে বাংলাদেশী হিন্দুদের জন্যও ভিসা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ এমতাবস্থায় বাংলাদেশী হিন্দুদের মরন অথবা ধর্মান্তরিত হওয়া ছাড়া গতি নেই৷ বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদীরা সেটাই চান৷ সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে বাংলাদেশী হিন্দুদের ভিসা দিয়ে তাঁদের আপাতত বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া৷ মুসলমান আটকাতে চাইলে তাঁদের জন্য আলাদা ভাবনা করতে পারেন৷

বাংলাদেশে হিন্দুরা বিপন্ন৷ তাঁদের জান-মান রক্ষার দায়িত্ব সেদেশের সরকারের৷ ভারত আলাদা রাষ্ট্র৷ কূটনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া কিছু করার নেই, এটা ঠিক৷ কিন্তু হিন্দু-মুসলিম জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের কারণে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া হিন্দুদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিন্তু শুধু কূটনৈতিক চাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে সেদেশের হিন্দু যাঁরা ১৯৪৭ বা ১৯৭১ -এ আসতে পারেননি তাঁদের প্রতি অন্যায় করা হবে৷ বর্তমানের ভারত সরকার, সম্প্রতি বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা বন্ধ করলেও পণ্য রপ্তানি কিন্তু বন্ধ করেননি৷ এবং সেটা করবেও না৷ বাংলাদেশে হিন্দু বাঙালীদের ভারতে আসতে না দিয়ে তাঁদেরকে জিম্মি করে কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে বাণিজ্য আগ্রসন চালিয়ে যাবে৷ বেনিয়ার দল বিজেপি সরকারের ওটাই আসল উদ্দেশ্য৷ এই উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে আমরা শুধু শুধু চিৎকার করছি৷ আর এপারের চিৎকার যত বাড়বে ওপারে মুসলিম সেন্টিমেন্ট ততবেশি দানা বাঁধবে৷ হিন্দু সেন্টিমেন্ট কিন্তু তত প্রবল নয় ! ফলে বাংলাদেশে হিন্দুরা মার খেতেই থাকবে৷

১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে শুধু কূটনৈতিক চাপে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি৷ ভারতরাষ্ট্রের সসৈন্য প্রত্যক্ষ চাপও ছিল৷ বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর যদি অন্যায় অত্যাচার হয়, সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে ভারতরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেই পারে৷ এটা হিন্দু-মুসলিম জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া খণ্ডিত বাঙলার বাংলাদেশী হিন্দুদের প্রতি ভারতরাষ্ট্রের সর্বকলের দায়৷ এ দায় অস্বীকার করে বর্তমান ভারতরাষ্ট্র এবং তাঁদের বিজেপি দল যে মায়াকান্না করছেন, তা কুম্ভীরাশ্রু, সত্যিকারের প্রতিকার নয় ! সত্যিকারের প্রতিকার হবে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া৷ সম্ভব হলে সহজ শর্তে নাগরিকত্ব দিয়ে ভারতরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া৷