সেই ইংরেজ আমলের কথা৷ ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের একটি সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ইংরেজরা এদেশীয় মেয়েদেরই রক্ষিতা হিসাবে রাখতো৷ ইউরোপীয় মেয়েদের রক্ষিতা করে রাখা সাহেব সমাজে ছিল নিষিদ্ধ৷
কিন্তু এই রক্ষিতাদের সাথে অনেক সাহেব ভালাবাসা ও বিবাহসূত্রে, আবদ্ধ হয়ে পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন৷ এদেশীয় হিন্দুরমনী বিয়ে করে রক্ষিতা নয়, তাদের রীতিমতো স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন৷
কোলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক সহমরণগামী একটি পনের বছরের মেয়েকে উদ্ধার করে তাকে পত্নীরূপেই গ্রহণ করেছিলেন৷ সহমরণে অনিচ্ছুক মেয়েটিকে তিনি একরকম চিতা থেকেই বলপূর্বক তুলে এনেছিলেন৷ মেয়েটি ছিল জাতিতে ব্রাহ্মণ৷ উইলিয়াম হেজেসের ডায়রিতে এর উল্লেখ আছে৷ আবার কেউ কেউ বলেন, জব চার্নক মেয়েটিকে ফুসলে এনেছিলেন৷ মেয়েটির স্বামী নাকি জীবিত থাকাকালীনই চার্ণক তাকে প্ররোচিত করেছিলেন তাঁর সঙ্গে পালিয়ে আসতে৷
যাই হোক, জব চার্নক ১৬৭৮ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি মেয়েটিকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে কুড়ি বছর সংসার করেছিলেন৷ এই মেয়েটির প্রভাবে তাঁর খ্রীষ্টধর্মে শিথিলতা এসে গেছলো৷ হিন্দুদের মতো তিনি প্রায় পৌত্তলিক হয়ে পড়েছিলেন৷ তাঁর চালচলন আচার ব্যবহার দেখে তাঁকে আধাহিন্দু আধা খ্রীষ্টান বলে মনে হতো৷ বারো বছরের সংসার জীবনে হিন্দু পত্নীর গর্ভে জব চার্ণকের তিনটি সন্তান হয়৷ সবই কন্যা তাঁর ওপর স্ত্রীর এতই প্রভাব ছিল যার ফলে কন্যাদের তিনি খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষিত করতে পারেননি৷ অবশ্য স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি কন্যাদের একসঙ্গে গীর্জায় নিয়ে গিয়ে দীক্ষা দিয়েছিলেন৷
মেয়েদের নামকরণে কিন্তু সাহেবআনা বজায় রেখেছিলেন৷ বড় মেয়ে মেরীর বিয়ে হয়েছিল গভর্নর চার্লস আয়ারের সাথে৷ মেরীর মৃত্যু হয় ১৭৬৭ খ্রীষ্টাব্দে৷ মেজ মেয়ে এলিজাবেথকে বিয়ে করেছিল উইলিয়ম বাউরিজকে৷ ছোট মেয়ে ক্যাথরিন বিয়ে করেছিল জোনাথন হোয়াইটকে৷ জোনাথন হোয়াইট বাংলার ফ্যাক্টরী কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন৷ ক্যাথারিনের মৃত্যু হয় ১৭০১ খ্রীষ্টাব্দে৷
স্ত্রীর মৃত্যুতে জব চার্নক অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন অনেকের ধারণা স্ত্রী বিয়োগই তার অকাল মৃত্যুর হেতু৷ কারণ স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভালবাসতেন৷ প্রতি বছর মৃত্যু তিথিতে তিনি স্ত্রীর কবরের ওপর একটি মোরগ বলি দিতেন৷ পাটনায় থাকাকালীন বিহারীদের পাঁচ পীরের উদ্দেশ্য মোরগবলি দিতে দেখে হয়তো তিনি সেই প্রথা অনুকরণ করতেন৷ কথিত আছে, হেস্টিংস স্ট্রীটের সেন্টস জন গীর্জার মধ্যে একই সমাধিস্তম্ভের নীচে জব চার্ণক ও তাঁর হিন্দু স্ত্রী উভয়েরই সমাধি আছে৷ তাঁদের ভালবাসার অভিসার মর্ত্যলোকের সীমানা ছাড়িয়ে বুঝি পরলোকেও পাড়ি দিয়েছিল৷
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য চার্ণকের স্ত্রী ছিলেন পাটনার মেয়ে৷ ১৬৭৮ খ্রীষ্টাব্দে পাটনায় থাকাকালীন একদিন চার্ণক গঙ্গা তীরে ভ্রমণ করছিলেন৷ তখন ভারতে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল৷ স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে জ্বলন্ত চিতায় সহমৃতা হতে হতো৷ স্বেচ্ছায় কোন সতী যদি সহমরণে অনিচ্ছা প্রকাশ করতো তবে তাকে বলপূর্বক জ্বলন্ত চিতায় তুলে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হতো৷ এমনি একটি সতী দাহের ঘটনায় সুন্দরী যুবতীকে সহমরণে উদ্যত হতে দেখে চার্ণক তাকে প্রহরীদের দ্বারা উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে আসেন ও অবশেষে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন৷
গভর্নর হেজেস বলেন অন্যকথা৷ তাঁর কাছে একদিন সকালে একটি এদেশীয় লোক নালিশ জানিয়ে যায় যে চার্নক একজন স্ত্রী লোককে ফুসলিয়ে নিয়ে এসে নিজের কাছে রেখেছেন স্ত্রী লোকটির স্বামী জীবিত৷ হুগলী ও কাশিম বাজারের শাসনকর্র্ত বুলচাঁদ সেই লোকটিকে হেজেসের কাছে পাঠিয়ে দেন৷ এই বুলচাঁদ অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে চার্ণকের বউ জনৈক হিন্দুর স্ত্রী৷ সোনাগয়না ও টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে এসে চার্নকের কাছে আশ্রয় নেয়৷ হেজেস তাঁর ডায়েরিতে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করে যান৷
কিন্তু হেজেস লিখিত চার্ণকের হিন্দুপত্নী সম্বন্ধীয় এই আখ্যান প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উইলসন ফার্মিজার সাহেব বিশ্বাস করেন না৷ কারণ হেজেস ছিলেন চার্ণকের শত্রু৷ তাই চার্নক সম্বন্ধে তাঁর অভিমত নিরপেক্ষ না হওয়াই স্বাভাবিক৷
তবে একথা সত্যি চার্ণক তাঁর হিন্দুপত্নীকে যথার্থ ভালোবেসেছিলেন৷ তাঁকে নিয়ে কুড়ি বছর ঘর সংসার করেছিলেন৷ স্ত্রীর মৃত্যুতে এতই আঘাত পেয়েছিলেন যে তারপর আর বেশিদিন তিনি বাঁচেননি৷
- Log in to post comments